অলিম্পিক্স পদকজয়ী সাইনা নেহাওয়াল ৩৪ বছর বয়সেই ভাবতে শুরু করেছেন অবসর নেওয়ার কথা। —ফাইল চিত্র।
বাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন সাইনা নেহওয়াল। পরিস্থিতি এমন যে, ব্যাডমিন্টনে এককালের বিশ্বসেরা এবং অলিম্পিক্স পদকজয়ী তারকা ৩৪ বছর বয়সেই ভাবতে শুরু করেছেন অবসর নেওয়ার কথা। হতাশ সাইনা বলেই ফেলেছেন, ‘‘আট-ন’ঘণ্টা ধরে খেলা সম্ভব হচ্ছে না। হাঁটুর অবস্থা খারাপ। এই পা নিয়ে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে পাল্লা দেব কী করে! হয়তো আমাকে এটাই মেনে নিতে হবে। অবসরের কথা ভাবতে হবে।’’ আসলে বাত এখন আর বয়সকালের রোগ নয়। অল্পবয়সিরাও সাইনার মতোই বাতের ব্যথায় কাবু হন। সেই ব্যথা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় দাঁড়ি টানতে বাধ্য হন কেউ কেউ। হুইলচেয়ার-বন্দি হতে হয়। পেশা ছাড়ার কথাও ভাবতে হয়। যেমনটা ভেবেছেন সাইনা। বলিউডের অভিনেত্রী বিপাশা বসুও স্বীকার করেছেন, তাঁর হাঁটুর অবস্থা ৮০ বছরের বৃদ্ধার মতো। তাঁর পক্ষে আর ছোটাছুটি, লাফালাফি করা সম্ভব নয়!
কিন্তু বাত কি এতটাই অকেজো করে দিতে পারে? চিকিৎসকেরা বলছেন, বাতের সমস্যা মারাত্মক রূপ নিতে পারে, সেটা যেমন ঠিক, তেমনই এ-ও ঠিক যে, জীবনযাত্রায় বদল এনে এবং যথাযথ চিকিৎসায় ব্যথাকে নিয়ন্ত্রণেও রাখা সম্ভব। অস্থিচিকিৎসক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায় যেমন বলছেন, বাত বা আর্থ্রাইটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখার পদ্ধতি নির্ভর করে আর্থ্রাইটিস কী ধরনের, তার উপর। তিনি বলছেন, ‘‘বাত বা আর্থ্রাইটিসের অনেক ধরন আছে। চিকিৎসার আগে সেটা জানা প্রয়োজন। আর জানা দরকার, শরীরে আর্থ্রাইটিসের প্রভাব কোন পর্যায়ে রয়েছে।’’
কী কী ধরনের আর্থ্রাইটিস হতে পারে?
বুদ্ধদেব বলছেন, ‘‘আর্থ্রাইটিস অনেক ক্ষেত্রেই হয় জিনগত কারণে। পরিবারের কারও হয়ে থাকলে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আবার এক ধরনের আর্থ্রাইটিস হয় আমাদের ইমিউন সিস্টেমের জন্য। যে ক্ষমতা শরীরে রোগ প্রতিরোধ করে, সেটিই টিস্যু-মাসলের জন্য ক্ষতিকারক অ্যান্টিবডিও তৈরি করে। একে বলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। যে কোনও বয়সের মানুষকে ওই ধরনের আর্থ্রাইটিস কাবু করতে পারে।’’ এর পাশাপাশি, জীবনযাপনের ধরন থেকেও আর্থ্রাইটিস হতে পারে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। বুদ্ধদেব বলছেন, ‘‘যিনি শারীরিক ভাবে অতি সক্রিয়, যেমন ধরুন ফুটবল খেলোয়াড়, তাঁদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে আর্থ্রাইটিস হচ্ছে। আবার আমরা যাঁরা বসে কাজ করি, দৈনন্দিন হাঁটাচলা কম, তাঁদেরও মোটা হওয়ার কারণে শরীরে আর্থ্রাইটিস আসার প্রবণতা বাড়ে।’’
বসে কাজে আর্থ্রাইটিস বাড়ছে?
একটি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের শহুরে অঞ্চলে আর্থ্রাইটিসের হার মোট জনসংখ্যার ৪.৫ শতাংশ। তুলনায় গ্রামে ওই হার ০.৬ শতাংশের আশপাশে। কারণ হিসাবে চিকিৎসকেরা দায়ী করছেন জীবনযাত্রাকে। বুদ্ধদেব বলছেন, গ্রামের মানুষকে তাঁদের অবস্থানগত কারণেই বেশি কাজ করতে হয়। তাঁদের হাঁটাহাঁটি বেশি হয়। কায়িক পরিশ্রমও বেশি। তুলনায় শহুরে মানুষের কায়িক শ্রমের মাত্রা অনেক কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডেস্কে বসে কাজ। এ ছাড়া, শহুরে মানুষ ফাস্টফুড বেশি খান। এই সব কিছু মিলিয়ে শহরের মানুষের মধ্যে অল্প বয়সে মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। হাড়ের উপর চাপানো ওজনও বাড়ছে। ক্ষতি হচ্ছে কার্টিলেজের। জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিরও।
আর্থ্রাইটিসেও এগিয়ে ভারত
গত কয়েক বছরে ভারতে অনেকটাই বেড়েছে বাত বা আর্থ্রাইটিসের সমস্যা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯০ সালে ভারতে অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ কোটি ৩৫ লক্ষ মানুষ। ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি ২৪ লক্ষে। চিকিৎসকেরা বলছেন, সরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও কোভিড পরবর্তী ভারতে অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিসের (সবচেয়ে বেশি যে আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হন ভারতীয়েরা) পরিসংখ্যানে অবনতি হয়েছে। অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার হারও অন্যান্য দেশের থেকে বেশি। ২০২৩ সালেরই একটি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে ওই ধরনের বাতের রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ০.৯২ শতাংশ। যেখানে গোটা পৃথিবীতে ওই হার কেবল ০.৪৬ শতাংশ।
কোন আর্থ্রাইটিস হয়েছে বুঝবেন কী করে?
এর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। তবে নয়াদিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক যশ গুলাটি বলছেন,আর্থ্রাইটিসকে মূলত দু’ ভাগে ভাগ করতে পারেন। প্রথম ভাগে রাখা যেতে পারে বয়সের কারণে হওয়া বাতের ব্যথা বা শরীরে অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে যে সমস্ত বাতের ব্যথা হয়, সেগুলি। এগুলি হয় সাধারণত হাঁটু, কোমর, শিরদাঁড়ার সন্ধিতে। এতে কার্টিলেজ নষ্ট হয়। অস্থিসন্ধির মধ্যে থাকা ফাঁকা জায়গা সঙ্কীর্ণ হয়ে আসে। এটা অপেক্ষাকৃত কম বিপজ্জনক। দ্বিতীয় ভাগে রাখা যেতে পারে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসকে। যা কম বয়সে শরীরে হানা দেয় এবং বলেকয়ে আসে না। ওই দ্বিতীয় দফার আর্থ্রাইটিস দ্রুত চিহ্নিত করা জরুরি। কারণ, এখন ওষুধের মাধ্যমে ওই আর্থ্রাইটিসের সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু যদি চিকিৎসায় দেরি হয়, তবে অস্ত্রোপচার জরুরি হয়ে পড়ে।
সমাধান কী ভাবে?
বুদ্ধদেব বলছেন, ‘‘পরিবারে যদি আর্থ্রাইটিসের সমস্যা থাকে, তবে আগে থেকে সতর্ক হয়ে এই রোগকে দূরে রাখা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের দৈনন্দিন রুটিনে আরও বেশি এক্সারসাইজ় রাখতে পারেন। যাতে মোটা না হয়ে যান, সে ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। ফাস্টফুড জাতীয় খাবার এড়িয়ে চললে এবং দৈনন্দিন কাজে কায়িক শ্রমের মাত্রা বাড়লে সেটা সম্ভব। বাকিদের ক্ষেত্রে বাতের ব্যথা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা যাচাই করার পরে পরবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসা করানো জরুরি। আর্থ্রাইটিস ওষুধেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। ফিজিয়োথেরাপির মাধ্যমেও বশে রাখা যেতে পারে। তবে একান্তই কাজ না হলে তখন নানা রকম সার্জারি রয়েছে, সে সবও করানো যেতে পারে।’’ পুণের দীননাথ মঙ্গেশকর হাসপাতালের অস্থিচিকিৎসক মহেশ কুলকার্নি বলছেন, ‘‘আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা এখন অনেক উন্নত। ওষুধের মান অনেক বেড়েছে। রোবোটিক আর্মের মতো প্রযুক্তিও এসেছে। যার সাহায্যে অস্ত্রোপচারে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। সব সময়েই প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে লিগামেন্ট রিপেয়ারের মতো অস্ত্রোপচারেও কাজ হচ্ছে। অনেক খেলোয়াড়ও ওই ধরনের চিকিৎসায় উপকৃত হয়েছেন। দেখা গিয়েছে, আর্থ্রাইটিসে যে পঙ্গুত্ব আসে, তারও সমাধান করা যাচ্ছে। রোগী বাকি জীবন ভাল ভাবে কাটাচ্ছেন।’’ তবে চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনযাত্রায় বদল আনার ব্যাপারেও গুরুত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy