ক্যানসার শরীরের যে কোনও অংশেই হতে পারে। তাই বলে ঠোঁটে?
মুখ বা ত্বকের ক্যানসারের যত প্রকার রয়েছে, তার মধ্যে ঠোঁট ব্যতিক্রম নয়। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, তা অত্যন্ত বিরল। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে, আমেরিকার মতো দেশে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ ঠোঁটের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ভারতের ক্ষেত্রেও সংখ্যাটা হাতেগোনা। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, মুখগহ্বরের ক্যানসার কিন্তু ঠোঁট পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। ‘পাবমেড’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা গিয়েছে, এ দেশে যত প্রকার ক্যানসারের বাড়বাড়ন্ত রয়েছে, তাদের মধ্যে মুখগহ্বরের ক্যানসারের স্থান বেশ উপরের দিকেই।
ঠোঁটের উপর অস্বাভাবিক কোনও মাংসপিণ্ড বা আঁচিল গজিয়ে ওঠা থেকে বিষয়টি শুরু হতে পারে। ছোট একটি ব্রণ কিংবা বোতামের মতো দেখতে সেই মাংসপিণ্ড চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘স্কোয়ামাস সেল’ নামে পরিচিত। তেমন কিছু দেখা দিলে সতর্ক হতে হবে। এ ছাড়া, ঠোঁট থেকে অস্বাভাবিক রকম ছাল ওঠা, ঘা হওয়া কিংবা অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে যাওয়া, ক্ষত না শুকোনোও ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। তবে এই ধরনের উপসর্গ মূলত ঠোঁটের নীচের অংশ, অর্থাৎ অধরেই বেশি দেখা যায়।
মহিলাদের রূপটানে বিশেষ একটি প্রসাধনী হল লিপস্টিক বা ওষ্ঠরঞ্জনী। এমন বহু মহিলা রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত লিপস্টিক ব্যবহার করেন। অনেকেরই ধারণা, পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে ঠোঁট না রাঙালে সাজ সম্পূর্ণ হয় না। নানা ধরনের, রঙের লিপস্টিক সংগ্রহ করা এবং তা ঠোঁটে ব্যবহার করা অনেকের কাছেই নেশার মতো। তা থেকেও কি ক্যানসার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে? শহরের এক সরকারি হাসপাতালের রেডিয়োথেরাপি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, চিকিৎসক চৈতিপর্ণা দাস বলেন, “এ নিয়ে বিশেষ তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে লিপস্টিকে তো নানা ধরনের রাসায়নিক থাকে। তার মধ্যে কোনওটি যদি ক্যানসারের কারণ (কার্সিনোজেনিক) হয়, সেখান থেকে এই রোগ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে, ঠোঁট বা মুখগহ্বরের ক্যানসার হয় মূলত তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে। ধোঁয়াযুক্ত তো বটেই, এমনকি খৈনি বা গুটখার মতো ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকেও ঠোঁটে ক্যানসার হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত রোদ যে ভাবে ত্বকের অন্যান্য অংশের ক্ষতি করে, একই ভাবে ঠোঁটও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
এ বিষয়ে অধ্যাপক এবং বেসরকারি হাসপাতালের চর্মরোগ চিকিৎসক সুরজিৎ গরাইয়ের মত অবশ্য ভিন্ন। তাঁর বক্তব্য, “লিপস্টিক ঠোঁটে রক্ষাকবচের মতো কাজ করে। লিপস্টিকের পরত থাকায়, রোদ সরাসরি ঠোঁটের ক্ষতি করতে পারে না। তা ছাড়া এখন বহু লিপস্টিক, লিপ বামে তো ‘এসপিএফ’ বা ‘সান প্রোটেকশন ফ্যাক্টর’ থাকে। এই বস্তুটির কাজই তো অতিবেগনি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করা। তবে কম দামি বহু লিপস্টিক রয়েছে, যেগুলির মধ্যে ক্যাডমিয়াম, সীসার মতো ধাতু থাকে। সেগুলি ঠোঁটের জন্য ক্ষতিকর।”

ঠোঁটের ঘা থেকেও ক্যানসার হতে পারে। ছবি: সংগৃহীত।
কী দেখলে সতর্ক হবেন?
ঠোঁটে অস্বাভাবিক কোনও মাংসপিণ্ড থাকলে যেমন সতর্ক হবেন, তেমনই ফাটা ঠোঁট হাজার ক্রিম বা বামেও যদি পেলব না হয়, সে ক্ষেত্রেও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া হঠাৎ যদি ঠোঁটের রং বদলাতে শুরু করে, তখন অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত। আবার কেউ যদি দেখেন, শীতের সময়ে ঠোঁটের কোণে যে ফাটল ধরেছিল তা গরমকালেও শুকোয়নি, তখন অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন চৈতিপর্ণা।
কোনও থেরাপি না অস্ত্রোপচার, এ ক্ষেত্রে চিকিৎসাপদ্ধতি কী?
যে কোনও রোগের ক্ষেত্রেই রোগ নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ। ক্যানসারের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। কারণ, এই মারণরোগ কোন পর্যায়ে রয়েছে, শাখা-প্রশাখা কতটা ছড়িয়েছে, আগে তা দেখে-বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। সাধারণত শরীরের ভিতরে অবাঞ্ছিত কোনও অংশ বা টিউমারে ক্যানসারের বীজ লুকিয়ে রয়েছে কি না, তা বোঝার জন্য ‘ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি’ বা ‘এফএনএসি’ পরীক্ষা করাতে হয়। তবে সুরজিতের কথায়, “ঠোঁটের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন পড়ে না। যে হেতু ঠোঁট ত্বকের উপরিভাগের অংশ, তাই সরাসরি সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অংশ পরীক্ষার জন্য তুলে নেওয়া যায়। সাময়িক ভাবে ঠোঁটের নির্দিষ্ট একটি অংশ অসাড় করে ‘পাঞ্চ বায়োপসি’র মাধ্যমে কয়েক টুকরো চামড়া এবং টিস্যু তুলে নিয়ে দেখা যেতে পারে সেখানে ক্যানসারের কোষ রয়েছে কি না। সেই অনুযায়ী প্রথমে বিভিন্ন থেরাপি করা যেতে পারে। তাতে কাজ না হলে অস্ত্রোপচার করে ঠোঁটের ওই অংশটুকু বাদ দিয়ে দেওয়া যায়। ঠোঁট পুর্নগঠন বা ‘রিকনস্ট্রাক্ট’ করতে হলে পরে আরও এক বার অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন পড়ে।”
সতর্কতা:
· ঠোঁটের ক্যানসার রুখতে কোনও ভাবেই তামাক ব্যবহার করা চলবে না। এমনকি, নিয়মিত মদ্যপান করলেও বিপদ বেড়ে যেতে পারে।
· মুখগহ্বরের ভিতর অবাঞ্ছিত কোনও অংশ গজিয়ে উঠছে কি না, সে দিকেও বিশেষ ভাবে নজর রাখা প্রয়োজন। সম্ভব হলে বছরে দু’বার দন্ত্যচিকিৎসকের কাছে গিয়ে মুখের পরিস্থিতি পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
· ঠোঁটের ক্যানসার থেকে সাধারণত প্রাণ সংশয় হয় না। খুব দ্রুত ছড়ায়ও না। তাই বলে অবহেলা করাও কাজের কথা নয়। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই সত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।