আয়ুর্বেদাচার্য ডাঃ দেবব্রত সেন
আমাদের চারপাশে অবহেলায় যে ভৈষজ্য রত্নাবলীর ভাণ্ডার রয়েছে, আমরা তাকে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক ভাবে চিনতে না পারার জন্য তার মূল্যায়ণ করতে পারি না। অথচ সেই ভৈষজ্য রত্নাবলী ব্যবহার করেই সুন্দরভাবে জীবনযাপন করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। জীবনের ব্যপ্তি ছিল শতবর্ষ। অথচ এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে কোথায় যেন সেই শতায়ুরা হারিয়ে যাচ্ছেন। যার জন্য অনেকাংশেই দায়ী বর্তমান অপরিমিত জীবনযাপন। তাই সেই পুরনো প্রজন্ম থেকে আমরা কিছুটাও যদি আমরা রপ্ত করতে পারি, তা হলে লাভ বৈ ক্ষতি নেই। বিজ্ঞানের আতসকাচ চোখে রেখে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক উপায়ে আমরা রোগ প্রতিরোধের কঠিন অঙ্ক সহজেই সমাধান করতে পারি। বিগত কয়েক দশক ধরে ঠিক এই কাজটই করে যাচ্ছেন আয়ুর্বেদাচার্য চিকিৎসক দেবব্রত সেন। রাঢ়বঙ্গে এই আয়ুর্বেদকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য পরম্পরা আয়ুর্বেদ পরিবারের সুযোগ্য উত্তরসূরী ডাঃ দেবব্রত সেন ও তাঁর পূর্বপুরুষদের অবদান এক কথায় অনস্বীকার্য।
‘আয়ু’ শব্দের অর্থ ‘জীবন’ এবং ‘বেদ’ শব্দের অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। প্রাচীন অর্থে ‘আয়ুর্বেদ’ শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে জীবনের আসল বিজ্ঞান; আয়ুর্বেদের মুল উদ্দেশ্য হল সুস্থ মানুষের সুস্থতা ধরে রাখা এবং রোগীর রোগ প্রশমন করা। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই আয়ুর্বেদ আসলে ভেষজ উদ্ভিদ, প্রাণীজ ও খনিজ দ্রব্যের মাধ্যমযুক্ত বিশেষ ধরনের চিকিত্সা পদ্ধতি। যে পদ্ধতিকে সিলমোহর দিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান। চিকিৎসক দেবব্রত সেন জানাচ্ছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা বিশেষভাবে বেড়েছে। বহু মানুষ ভরসা রাখছেন আয়ুর্বেদ চিকিৎসার উপর।
কিন্তু কেন মানুষ ক্রমশ আয়ুর্বেদ চিকিৎসার দিকে ঝুঁকছেন? চিকিৎসক দেবব্রত সেন জানালেন যে তিনি বিশ্বাস করেন এই আধুনিক ও প্রতিনিয়ত বদলে চলা প্রজন্মের কাছে আয়ুর্বেদ ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবে তা তথাকথিত বা প্রথাগত উপায়ে নয়। প্রত্যেক চিকিৎসার নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞান ও রসায়ন তত্ত্ব। ধরা যাক, প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় বলা আছে, সর্দি-কাশির মতো সমস্যায় তুলসি পাতা দারুণ কাজ করে। অথবা বাতের ব্যথার অব্যর্থ ওষুধ অশ্বগন্ধা। অথচ ডাঃ দেবব্রত সেন তা মানতে নারাজ। তিনি মনে করেন, সব তুলসি পাতা বা অশ্বগন্ধায় সেই গুণ নেই। এর ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি। কোনও রাসায়নিক বা লেদ কারখানার পাশে গজিয়ে ওঠা তুলসি গাছের পাতা কোনও ব্যক্তির শারীরিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে দিতে পারে। অথচ অযোধ্যা পাহাড়ের কোনও এক প্রান্তে নির্লিপ্তভাবে গজিয়ে ওঠা কোনও তুলসি গাছ সর্দি-কাশির সমস্যায় ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে। ঠিক তেমনই অশ্বগন্ধার মূলের মতো দেখতে অন্য কোনও মূল যদি কেউ প্রয়োগ করেন, তবে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই ঔষধ বা ভেষজ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সব ভেষজের ঔষধিগুণ থাকে না। সেই কারণেই পরম্পরা আয়ুর্বেদের ল্যাবরেটরিতে যখন ওষুধ তৈরি হয়, তখন প্রতিটি ভেষজের ঔষধিগুণ সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়। এবং তার পরেই সংশ্লিষ্ট ওষুধটিকে সিলমোহর দেওয়া হয়।
আসলে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞান খুবই জনপ্রিয় অথচ সংবেদনশীল একটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের অঙ্গ। যা আসলে কঠিন সাধানার পরেই রপ্ত করা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে আয়ুর্বেদাচার্য ডাঃ দেবব্রত সেনের নাম অনেকেই জানেন। তিনি পরিচিত তাঁর কাজের জন্য। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে তাঁর পরিবারের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস। বলা যায়, ভারতের প্রাচীন আয়ুর্বেদ চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ তাঁর পরিবার। যার উল্লেখ রয়েছে বেদ এবং পুরাণেও। পরিবারের সেই পরম্পরা বজায় রেখেই মানুষের কল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন চিকিৎসক দেবব্রত সেন। তৈরি করেছেন পরম্পরা আয়ুর্বেদের।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে অনেকে এখনও মনে করেন, আয়ুর্বেদ মানে ভেষজ উদ্ভিদ। অথচ ডাঃ দেবব্রত সেনের কাছে সেই যুক্তি খাটে না। তিনি অনায়াসে বলে দিতে পারেন কোন গবেষণার কত নম্বর পাতায় সংশ্লিষ্ট ভেষজের গুণাগুণ ব্যখ্যা করা রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন যুক্তিতে, বিজ্ঞানে, গবেষণায়। আর সেই কারণেই প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন আধুনিক প্রযুক্তিকে। জৈব রসায়ন তত্ত্বের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এমন মহাষৌধি তৈরি করেছেন যার ছোঁয়ায় নির্মূল হয়েছে বিভিন্ন ধরনের জটিল-কঠিন রোগ। ত্বক বা চুলের চিকিৎসা ছাড়াও বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যধির উপশমে পথ দেখিয়েছে তাঁর তৈরি করা আয়ুর্বেদিক মহৌষধি। নতুন প্রজন্মের ত্বকের সমস্যার কথা মাথায় রেখে তিনি তৈরি করেছেন এমন প্রসাধনী যা ত্বকের বয়সকে বাড়তে দেবে না। বলা বাহুল্য, এই আয়ুর্বেদিক প্রসাধনী খুব কম সময়েই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও এই জনপ্রিয়তার নেপথ্যে রয়েছে অন্য রহস্য। ডাঃ সেনের তৈরি করা প্রতিটি জিনিস সম্পূর্ণ রাসায়নিক মুক্ত এবং আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে তৈরি। এর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। ফলত আয়ুর্বেদিক ওষুধ ব্যবহার করে সুস্থ ভাবে দিনযাপন করছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
ডাঃ দেবব্রত সেনের জনপ্রিয়তা ঠিক কতটা, তা এক নিমেষে বুঝিয়ে দেবে তার ক্লিনিকের ভিড়। এখানে ত্বকের বার্ধক্য রোধ, পঞ্চকর্মা থেরাপি, ধ্যান ও যোগ থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। শহর পেরিয়ে দেশ-বিদেশের বহু মানুষ প্রতিনিয়ত এখানে চিকিৎসা করাতে আসেন। একটি পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে, প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ এখান থেকে চিকিৎসা করানোর পরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
সম্প্রতি এত আলোর মধ্যেও হঠাৎই যেন অনেকটা বিষাদ জড়িয়ে গিয়েছে চিকিৎসক দেবব্রত সেনের জীবনে। গত ৪ জুন না ফেরার দেশের পাড়ি দিয়েছেন ডাঃ দেবব্রত সেনের মা শ্রীমতি সবিতা দেবী। ডাঃ সেনের জীবনের প্রতিটি মূহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর পড়াশুনা থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদ চর্চা, সবটাই শুরু হয়েছিল তাঁর মায়ের হাত ধরে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সবিতা দেবীর দখল ছিল চোখে পড়ার মতো। এমনকি পরম্পরা আয়ুর্বেদ তৈরির সময়ে ডাঃ সেন ভীষণভাবে পাশে পেয়েছিলেন তাঁর মাকে। হঠাৎ করে শ্রীমতি সবিতা দেবীর চলে যাওয়ায় একপ্রকার মুষড়ে পড়েছেন ডাঃ সেন।
তবে সময় থেমে থাকে না। বিষাদ কাটিয়ে চিকিৎসক দেবব্রত সেন ফের নিজেকে ব্রতী করে তুলেছেন মানবকল্যাণের কাজে। বর্তমানে তিনি এবং তাঁর দল একটি অনন্য আয়ুর্বেদিক ডায়েটের ধারণা ও ঋতুচর্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। আয়ুর্বেদাচার্য ডাঃ দেবব্রত সেন জানাচ্ছেন, বৈজ্ঞানিক আঙ্গিকে দৈনন্দিন, রাত্রিকালীন ও ঋতুকালীন জীবনধারার প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা আছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। নির্দিষ্ট রুটিন মেনে এই ডায়েট করলে শুধুই যে ফিট বা সুস্থ থাকা যাবে তা নয়, সেই সঙ্গে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। ওজনও ঝরবে দ্রুত।
একই সঙ্গে করোনা পরবর্তী পর্যায়ে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা কী ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা নিয়েও গবেষণা চালাচ্ছেন ডাঃ সেন ও তাঁর সহকর্মীরা। আমরা প্রত্যেকেই জানি, কোভিডের পরে মানুষ শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। হাঁপানির সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, দুশ্চিন্তার সমস্যা এবং আরও কত কী! যা আসলে পরবর্তী সময়ে বড় আকার নিতে পারে। ডাঃ দেবব্রত সেন জানাচ্ছেন, এই সমস্ত সমস্যার হাল রয়েছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। এবং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, করোনা পরবর্তী পর্যায়ে এই সমস্যাগুলির দ্রুত কোনও সমাধান তিনি নিয়ে আসবেন।
আসলে ভাল-র কোনও শেষ নেই। তাই এত কিছুর পরে চিকিৎসক দেবব্রত সেনের স্বাভাবিক স্বগতোক্তি, আমাদের দেশে আয়ুর্বেদ নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবেই উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোয় আয়ুর্বেদের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ আরও ব্যাপক হারে সম্ভব হবে। আর সেই চেষ্টাই প্রতিনিয়ত করে চলেছেন তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy