তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে মৃত্তিকা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে সে দেখে যে তার ইউনিফর্মে লাল দাগ। ভয় পেয়ে যায় সে। দিনকতক মা-বাবা পাশে-পাশে থাকলেও গুটিয়ে যায় মৃত্তিকা। হঠাৎ অল্প বয়সে মেয়ের ঋতুস্রাব শুরু হয়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ তার মা-বাবার কপালেও। মৃত্তিকার আসলে কোনও রকম মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। ঋতুস্রাব যে স্বাভাবিক একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, সে সম্পর্কে তার কোনও ধারণা না থাকায় ছোট্ট মনে বাসা বাঁধে ভয়, আশঙ্কা।
কিন্তু এটা কি এখন স্বাভাবিক? মেয়েদের মধ্যে বয়ঃসন্ধি, ঋতুচক্র শুরু হওয়ার বয়স কি খানিকটা এগিয়ে এসেছে? তার কারণই বা কি? আলোচনা করলেন বিশেষজ্ঞরা—
ঋতুস্রাব শুরু হয় কোন বয়সে?
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলছেন, “আগে সাধারণত ১৪-১৫ বছর বয়সেই মেনস্ট্রুয়াল সাইকল শুরু হতে দেখা যেত। এখন সেটা ১১-১২ বছর বয়সে এগিয়ে এসেছে। দশের নীচেও ঋতুচক্র শুরু হওয়ার উদাহরণ রয়েছে।” অন্য দিকে গাইনিকোলজিস্ট ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি শুরুর বয়স এখন ৮ থেকে ১৩, আপাত ভাবে ৯-১০ বছর বয়সে বয়ঃসন্ধি শুরু হচ্ছে ধরা যায়।” তবে মেয়েদের শরীরের এই পরিবর্তনকে মোটামুটি পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় হল শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ঠিক আগের পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্রেস্ট ডেভলপমেন্টের লক্ষণ দেখা দেবে। আর তার প্রায় দু’-আড়াই বছর পরে শুরু হয় পিরিয়ডস, যা এই পাঁচটি পর্যায়ের চতুর্থ পর্যায়ে পড়ে।
মেয়েদের শরীরে এই ধরনের পরিবর্তন দেখা দেওয়ার সময় থেকে ঋতুচক্র শুরু হওয়ার মাঝে কিছুটা সময় পাওয়া যায়। তখনই ধীরে ধীরে আলোচনার পরিসর তৈরি করতে হবে। এতে ঋতুচক্র শুরু হলে বাচ্চাটি ঘাবড়ে যাবে না।
ঋতুচক্র এগিয়ে আসার কারণ
অত্যধিক প্লাস্টিক প্রডাক্টের ব্যবহার এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “বয়ঃসন্ধিতে ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। প্লাস্টিক প্রডাক্টসে থ্যালেট নামে সিউডো-ইস্ট্রোজেনের মতো একটি কেমিক্যাল থাকে। প্লাস্টিকের জলের বোতল, টিফিন বক্স, এমনকি কিছু ক্রিমেও তা থাকে। ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুডের প্রিজ়ারভেটিভেও থাকে এই সিউডো-ইস্ট্রোজেন। এই ধরনের খাবার ও প্রডাক্টের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলেই পিউবার্টি এগিয়ে আসছে। তাই অনেক কোম্পানিই বাচ্চাদের জন্য এখন প্লাস্টিকের বদলে কাচের ফিডিং বটল তৈরি করছে।”
ডা. চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেকাংশেই একমত ডা. চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত। তবে তার সঙ্গে অন্য কিছু দিকও উল্লেখ করলেন ডা. দাশগুপ্ত, “সেডেন্টারি লাইফস্টাইল, ওজন বৃদ্ধি, মানসিক চাপের সঙ্গে এই শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলোর সম্পর্ক আছে। বাচ্চারা এখন যা খায়, তার মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক, পেস্টিসাইডসের মতো বিষাক্ত জিনিসের সংস্পর্শে আসছে তারা। তা ছাড়া মিষ্টি পানীয় (এনার্জি ড্রিঙ্ক, ফ্লেভারড জুস ড্রিঙ্ক), প্রসেসড ফুডের মাধ্যমে পরিবেশগত টক্সিনের এক্সপোজ়ার বেশি হচ্ছে, যা ‘এন্ডোক্রিন ডিসরাপ্টর’ হিসেবে কাজ করে। ফলে বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসছে। অন্য দিকে টিভি, ফোনে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট এখনকার বাচ্চাদের হাতের মুঠোয়। এ সব কিছুর কারণেই বয়ঃসন্ধি ত্বরান্বিত হচ্ছে।” জিনগত দিকও বিবেচ্য। সাধারণত মায়ের যদি তাড়াতাড়ি ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার ইতিহাস থাকে, তা হলে মেয়েরও ঋতুচক্র আগে শুরু হয়।
ওবেসিটি অন্যতম কারণ
বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) বেশি হলে, তাদের শরীরে বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। বডি ফ্যাট পার্সেন্টেজ বেশি হলে পিটুইটারি গ্রন্থি বেশি সক্রিয় হয়ে যায়। এই গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হরমোন বয়ঃসন্ধিকে ত্বরান্বিত করে। ডা. চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “আসলে আগের চেয়ে এখন মানুষের খাওয়াদাওয়া অনেক বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রসেসড ফুড খাওয়া, খেলাধুলোর অভাব বাচ্চাদের ওবেসিটির প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর ওবিস কন্যাসন্তানদের মধ্যে যেমন ইস্ট্রোজেন উৎপাদন বেশি হয়, তেমনই ওবিস কিশোরদের মধ্যেও লেপটিন ও সেক্স হরমোন লেভেল বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে আর্লি পিউবার্টি দেখা যাচ্ছে।” তবে একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১৯৭০ সাল থেকেই সারা বিশ্বে বয়ঃসন্ধি প্রতি বছর গড়ে তিন মাস করে এগিয়ে আসছে।
আর এক গবেষণা বলছে, কোভিডের পরে বাচ্চাদের স্ক্রিন টাইম বেড়ে গিয়ে, স্লিপ সাইকলে বিঘ্ন ঘটায় স্ট্রেস যেমন বাড়ছে, বয়ঃসন্ধিকেও তা ত্বরান্বিত করছে। যে সব বাচ্চা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের মধ্যেও আর্লি পিউবার্টির মতো ঘটনা দেখা যাচ্ছে।
সাবধান থাকবেন কোন বিষয়ে?
আটের নীচে মেনস্ট্রুয়াল সাইকল শুরু হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। “কারণ অন্যান্য অসুস্থতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে, যদিও সে সম্ভাবনা বিরল। তবে কিছু ক্ষেত্রে পিটুইটারি, অ্যাড্রিনালিন, থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অসুখ, ওভারির টিউমর থাকতে পারে,” বলে জানালেন ডা. দাশগুপ্ত। আবার পিরিয়ডস খুব তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে গেলে তাদের মধ্যে টাইপ টু ডায়াবিটিস, হাইপারটেনশন, ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায় বলে জানালেন ডা. চট্টোপাধ্যায়। তাই কন্যাসন্তানের ঋতুচক্র শুরু হলে অবশ্যই কোনও চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করুন।
মানসিক দিক অবহেলার নয়
বাচ্চারাও কিন্তু স্ট্রেস ও অ্যাংজ়াইটির শিকার। বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি, পারিবারিক কলহ, মা-বাবার বিচ্ছেদ ইত্যাদির প্রভাব সন্তানের উপরেও পড়ে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, স্ট্রেস ও অ্যাংজ়াইটির কারণে বাচ্চাদের পিউবার্টি এগিয়ে আসছে। ফলে ওদের মনের উপরে যাতে কোনও চাপ না পড়ে, সে দিকে নজর দিতে হবে।
অন্য দিকে, সন্তানের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার আগে তার সঙ্গে এ বিষয়ে অল্প অল্প করে আলোচনা শুরু করতে হবে। সন্তানের ব্রেস্ট ডেভলপমেন্ট বা আন্ডারআর্মসে হেয়ার গ্রোথ নজরে পড়লে তাকে বোঝাতে হবে যে, এগুলো স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তার পরের পর্যায়ে ঋতুস্রাব শুরুর প্রক্রিয়া সম্পর্কেও তাকে সচেতন করতে হবে। এই বিষয়ে ধারণা না থাকলে বরং তারা ভয় পেয়ে যেতে পারে। মাসখানেক আগেই খবরে উঠে এসেছিল মুম্বইয়ে এক চোদ্দো বছরের কিশোরীর আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা। মেনস্ট্রুয়াল সাইকল শুরু হওয়ার অবসাদ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল সে, এমনটাই জানিয়েছিল তার আত্মীয়রা। তবে তা বিক্ষিপ্ত ঘটনা হলেও চিন্তার।
মনোবিদ দেবারতি আচার্য বলছেন, “ঋতুচক্র যে একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া এবং এটা হওয়াই যে সুস্থতার লক্ষণ, সে বিষয়ে সন্তানের সঙ্গে পরিষ্কার করে কথা বলতে হবে। মা বা মাতৃস্থানীয়া কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন। তাঁরাও যে এই পর্বের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তা বললে, মেয়েটি নিজেকে একা মনে করবে না। অনেক সময়ে বন্ধুবৃত্তে কোনও মেয়ের আগে ঋতুচক্র শুরু হয়ে যায়। এ দিকে বন্ধুদের তখনও তা শুরু হয়নি। তখন সে নিজেকে আলাদা মনে করে, গুটিয়ে নেয়। সে সময়ে মেয়েটির পাশে থাকতে হবে তার বাবা-মাকে। নিয়মিত কথা বলতে হবে, সময় কাটাতে হবে সন্তানের সঙ্গে। প্রথম ক’টা দিন সে হতাশ থাকতে পারে। কিন্তু দু’সপ্তাহ পরেও যদি সেই হতাশা না কাটে, সন্তানের আচরণে লক্ষণীয় পরিবর্তন নজরে পড়ে, তখন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।”
সন্তানের প্রথম হাঁটা, প্রথম ভাত খাওয়া, প্রথম স্কুলে যাওয়া... সব ক্ষেত্রে যেমন মা-বাবা পাশে থেকেছেন, এ ক্ষেত্রেও তার পাশে থাকতে হবে। বয়ঃসন্ধিও জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। সেটা সুন্দর ও সুস্থ ভাবে হওয়াই তো কাম্য।
মডেল: সুস্মেলি দত্ত, পূজিতা বন্দ্যোপাধ্যায়; ছবি: অমিত দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy