Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Cyst

সিস্ট মানেই ভয় নয়

সিস্ট কোথায় হয়েছে, তার আকার, তা সংক্রমণ সৃষ্টি করছে কি না... এই প্রত্যেকটি বিষয় পরীক্ষা করেই শুরু হবে চিকিৎসা

ঐশী চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪ ০৯:৫০
Share: Save:

সিস্ট, শব্দটা শুনলেই অনেকে গুরুতর রোগের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অনেকে আবার মনে করেন, সিস্ট শুধু মেয়েদের ওভারি অর্থাৎ ডিম্বাশয়ে হয়। তবে চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সিস্টের নানা ধরন রয়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শরীরের যে কোনও জায়গায় হতে পারে সিস্ট। বেশির ভাগ সিস্টই হয় ‘বিনাইন’। অর্থাৎ, কোনও গুরুতর রোগ হয় না সিস্টের জন্য। তবে, যে কোনও ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ, অস্ত্রোপচারের সাহায্যও নিতে হতে পারে।

সিস্ট কী?

চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “সিস্ট হল এক ধরনের জলভরা থলির মতো গ্রোথ। এই ‘ফ্লুয়িড’ বা ‘পাস’ ভরা থলি শরীরের এমন জায়গায় হয় যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও অতিরিক্ত, অবাঞ্ছিত কিছু হওয়ার কথা নয়। দেহের যে কোনও অঙ্গেই একাধিক সিস্ট হতে পারে।”

সিস্ট কোথায়, কেন হয়?

  • চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, নানা কারণে দেহে সিস্ট হতে পারে। কিছু সিস্ট যেমন হয় জন্মগত কারণে। ‘গার্ডনার সিনড্রোম’ যাঁদের জন্মগত কারণে থাকে, কিছু বিরল ক্ষেত্রে তাঁদের এক ধরনের ‘এপিডার্ময়েড সিস্ট’ হতে পারে। মূলত মুখে, কাঁধে হলদে বাম্পের মতো দেখায় এই সিস্ট।
  • শরীরে ‘ফ্লুয়িড’ ঠিক মতো চলাচল করতে না পারলে কিছু ধরনের সিস্ট হতে পারে। কোনও ব্যক্তির অত্যধিক ঘেমে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে তাঁর গা-মাথার রোমকূপে জমে যাওয়া ধুলো, ময়লা, ঘাম থেকে বেরনো ‘সেবামের’ কারণে সিস্ট হতে পারে। আবার যাঁদের ব্রণর সমস্যা রয়েছে, তাঁদের মুখে হঠাৎ একটা বড় ধরনের উপবৃদ্ধি দেখা যায়। এই কারণে চামড়ার উপরে বা নীচে ‘সেবাসিয়াস’ বা এপিডার্ময়েড সিস্ট হতে পারে।
  • কখনও আবার যদি শরীরের কোনও অঙ্গে বারবার আঘাত লাগতে থাকে, তা হলে ওই জায়গাতেও সিস্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। গ্যাংলিয়ন সিস্ট এর মধ্যে অন্যতম। সাধারণত এই সিস্ট হয় হাত-পায়ের জয়েন্টগুলিতে বা কনুই কিংবা আঙুলের গাঁটে। যদিও চোট পাওয়া মানেই যে ক্ষতস্থানে সিস্ট হবে, তা নয়।
  • হাঁটুর পিছন দিকে হওয়া ‘বেকার’ সিস্টের কারণে পায়ে ব্যথা বা হাঁটা-চলা করতে অসুবিধে হয়। মেরুদণ্ডে হওয়া ‘পেরিনিউরাল’ সিস্টের কারণে পিঠে, কোমরে, পায়ে ব্যথাও হতে পারে। তবে এই জায়গায় সিস্ট খুব একটা দেখা যায় না।
  • এ ছাড়াও, মিউকাস সিস্টের কারণে মুখের ভিতরে দেখা দিতে পারে ফ্লুইডভরা থলিগুলি। অত্যধিক ঠোঁট কামড়ানো, ঠোঁটে পিয়ার্সিং করানো বা দাঁতের যত্ন না নিলে এমন সমস্যা দেখা দেয়।
  • অনেক সময়ে পুরুষ-নারীর যৌনাঙ্গতেও সিস্ট হতে পারে। এগুলি মূলত হরমোনের বদল বা খুব আঁটসাঁট জামাকাপড় পরার কারণে হতে পারে।
  • এ ছাড়াও অন্যতম চিন্তার বিষয় ওভারিয়ান সিস্ট। অনেকেই মনে করেন, ওভারিয়ান সিস্ট মানেই গর্ভধারণে সমস্যা বা ক্যানসারের ইঙ্গিত। তবে চিকিৎসকদের মতে, এমন আতঙ্ক অর্থহীন।

ওভারিয়ান সিস্ট: কিছু কথা

এমন কিছু সিস্ট রয়েছে, যা দৃশ্যত প্রকট নয়। এর মধ্যে অন্যতম হল মেয়েদের ক্ষেত্রে ওভারিয়ান বা ডিম্বাশয়ে সিস্ট। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “ওভারিয়ান সিস্ট দু’ধরনের হয়— ফিজ়িয়োলজিক্যাল (স্বাভাবিক) এবং প্যাথোলজিক্যাল (ক্ষতিকারক)। স্বাভাবিক সিস্টের তালিকায় পড়ে ‘ফলিকিউলার’ এবং ‘কর্পাস লিউটিয়াম’ সিস্ট। ঋতুস্রাবের শুরুর দিকে ফলিকিউলার সিস্ট হয়। এগুলি ঋতুস্রাবের প্রথম দু’-তিন দিনের মধ্যে নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়। কর্পাস লিউটিয়াম সিস্টগুলি ওষুধের ব্যবহারে বা কোনও ভাবে ওভিউলেশন বা ডিম ফোটা বন্ধ রাখলে নিজে থেকেই শুকিয়ে যায়। এই সিস্টগুলি মূলত কমবয়সিদের (২০-৪০ বছর) মধ্যে দেখা দেয়।”

কমবয়সিদের (২০-৪০ বছর) মধ্যে দেখা দেয় ডার্ময়েড সিস্টও। জেনেটিক মিউটেশনের কারণে সিস্টগুলিতে ওগুলির ভিতরেই গজিয়ে উঠতে পারে চামড়া, চুল, দাঁত বা অন্য ধরনের কোষ।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বললেন, “ওভারির উপরে ছোট ছোট ফোস্কার মতো দেখতে সিস্টগুলি হয় ‘পলিসিসটিক ওভারিয়ান সিনড্রোম’ (পিসিওএস) বা ‘পলিসিসটিক ওভারিয়ান ডিজ়িজ়’-ও (পিসিওডি)। সিস্ট বলা হলেও আসলে এগুলি হল ডিম্বাশয়ে অপরিণত ডিম্বাণু। ইউনিসেফ-এর দেওয়া একটি পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বে যত জন মহিলার ঋতুস্রাব হয়, তাঁদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ মহিলাই পিসিওডি-তে আক্রান্ত। হরমোনের সমস্যার কারণে হওয়া এই রোগে শরীরে অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে ডিম্বাশয়ের কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তখন ঋতুস্রাবে যেমন সমস্যা দেখা দেয়, তেমনই ওজন অত্যধিক বেড়ে যাওয়া বা আরও নানা ধরনের সমস্যাও শুরু হয়।”

বহু ক্ষেত্রে অবশ্য দেখা যায়, এন্ডোমেট্রিয়োমা নামে এক ধরনের রোগের কারণে ওভারিতে সিস্ট হয়। নাম, এন্ডোমেট্রিয়োটিক সিস্ট। এগুলিকে চকলেট সিস্টও বলা হয়, কারণ, এতে ঋতুস্রাবের পচা রক্ত জমাট বেঁধে চকলেটের রঙের মতো দেখায়। এই সিস্ট হলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয় পেটে।

সিস্ট মানেই ক্ষতিকর?

চন্দ্রিমা জানাচ্ছেন, সিস্ট মানেই যে তা ‘ম্যালিগন্যান্ট’, অর্থাৎ গুরুতর রোগের ইঙ্গিত, এ কথা ভাবা একেবারেই ভুল। ছোট ব্রণ থেকে বড় মার্বেলের মতো দেখতে হলেও বেশির ভাগ সিস্টই হয় ‘বিনাইন’ । চিকিৎসক অরুণাংশুর কথায়, “যদি কোনও অঙ্গে সিস্ট হওয়ার কারণে সেটির কার্যক্ষমতায় বাধা পায় বা সংক্রমণ ছড়াতে থাকে, তা হলে সেই সিস্টকে ক্ষতিকর বলা যায়।”

চিকিৎসা সম্ভব

কোনও কারণে সিস্টের জায়গায় অস্বস্তি বা ব্যথা হলে অবশ্যই তা ডাক্তারকে দেখিয়ে নেওয়া উচিত। সাধারণত নিজে থেকেই সিস্টের মিলিয়ে যাওয়ার কথা। কিছু ক্ষেত্রে ওষুধও কার্যকর। কিন্তু ওভারিয়ান সিস্টের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। অভিনিবেশ বলছেন, “সিস্টের জন্য ঋতুস্রাবের সময়ে পেটে যন্ত্রণা হলে, পিরিয়ডস অনিয়মিত হলে আগেই কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে জেনে নেওয়া উচিত ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না। ‘সিএ ১২৫’, ‘রোমা’— এই ধরনের পরীক্ষা করে সহজেই তা জানা সম্ভব।” এ ছাড়াও, ইউএসজি-ও বুঝতে সাহায্য করে সিস্টটি ‘বিনাইন’ বা ‘নন ক্যানসারাস’ কি না। যদি ক্যানসারাস হয়, তা হলে সিস্টেকটমির মতো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা বাদদেওয়া সম্ভব।

সেবাসিয়াস সিস্ট, ভ্যাজাইনাল সিস্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়। অনেক সময়ে সিস্টগুলি দেহে থাকাকালীন ফেটে যেতে পারে। রক্তক্ষরণও হতে পারে। তখন দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া জরুরি।

পিসিওডির ক্ষেত্রে অবশ্য চন্দ্রিমা ও অভিনিবেশের পরামর্শ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত শারীরচর্চা, যোগাসনের মাধ্যমে জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ খুবই সাহায্য করে।

কিছু বিষয় যেমন সিস্টটি কোথায় হয়েছে, কতটা বড় হয়েছে, ব্যথা-অস্বস্তি বা সংক্রমণ সৃষ্টি করছে কি না— এগুলি জানিয়ে এক বার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। তা হলেই সম্ভব রোগনির্ণয় এবং রোগমুক্তি।

অন্য বিষয়গুলি:

Ovarian Cysts
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy