আমারে তুমি জামাই করেছো, এমনই লীলা তব। অলঙ্করণ- তিয়াসা দাস।
কখন তোমার বাজবে টেলিফোন!
নাওয়া-খাওয়া ভুলে নির্ঘুম অপেক্ষা করে আছি ওই ফোনটার জন্য। ভাবছেন বুঝি, প্রেমিকার ফোন। লাভ ইন দ্য টাইম অব করোনা! মোটেও না। সে গুড়ে স্যানিটাইজার! এই পরবাসে, জামাইগিরির বশে, আমি এক পাতানো শাশুড়ির সেলফোনের প্রতীক্ষায় উৎকণ্ঠার প্রহর গুনছি।
এখন প্রশ্ন হল, ‘পাতানো’ কেন? আমার কি আসল শাশুড়ি নেই! বিলক্ষণ আছে। সে ফি বছরের মতো এ বারও ভাগীরথী নদীতীরে কুলোয় মিছিমিছি তত্ত্ব সাজিয়ে প্রবাসী জামাইয়ের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে আছে। ভুল বুঝবেন না। এই কাতর অপেক্ষা জামাই আদরের জন্য নয়। নিজের মেয়ে আর নাতনিকে দেখার জন্য। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনই জামাই টানলে মেয়ে আর নাতনি আসে। বাই ওয়ান গেট টু ফ্রি। কিন্তু আমি ধর্মীয় ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মে-জুন মাসে দরকার হলে থর মরুভূমিতে গিয়ে বসে থাকব, কিন্তু কলকাতা যাব না। হপ্তা দুই ছুটি নিয়ে, উড়োজাহাজে গচ্চা দিয়ে, ঘেমো গায়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যে জামাই ষষ্ঠী পাব, তাতে পরতায় পোষাবে না। যম জামাই আর ভাগনা তো কখনও আপন হয় না। তাই ‘পরের বাড়ি’তে যেতে হলে আমাকে তার আর্থ-সামাজিক দিকটা ভাবতেই হবে! আমার এই সিদ্ধান্তটা কিন্তু প্রাকল্পিক নয়, রীতিমতো এক্সপেরিমেন্টাল!
একটু ফ্ল্যাশব্যাক গুঁজে দিই। কলকাতায় থাকা অবস্থায় ‘হর সাল’ নিয়ম করে জামাই ষষ্ঠীর দিন শ্বশুরবাড়ি যেতাম, সেজেগুজে, আতর মেখে, খোকা ইলিশ আর ভীমনাগের সন্দেশ নিয়ে। এক্কেবারে ‘চালার প্রতিমা’-র মতো কনভেনশনাল জামাই। একটু ভেজাল থাকলে পয়সা ফেরত। কিন্তু বিনিময়ে কী পেয়েছি? সোনামুগের ডাল, ঝুরিঝুরি আলুভাজা, হাঁসের ডিমের ঝোল, কচ্ছপের ডিমের সাইজের দু’টো রসগোল্লা, জলকাটা দই, আর ভাগ্য খুব ভাল থাকলে একটা মিঠাপাতার মিষ্টিপান। উপহারের কথা আর বললাম না। শত হোক, আমার বউ ওই বাড়ির মেয়ে। সে বাড়ির নিন্দা করলে আমার বিরুদ্ধে অবশ্যই অন্তর্ঘাতের অভিযোগ উঠবে।
আমি কি পাতানো জামাই, নাকি শিবঠাকুর! মাথায় আবার জল বা দুধ ঢেলে দেবে না তো! অলঙ্করণ- তিয়াসা দাস।
তা এত কিছুর পরও, আমেরিকা আসার পর এক বার জামাই ষষ্ঠীতে কলকাতার শ্বশুবাড়িতে গিয়েছিলাম সপরিবার। মার্কিন মুলুকের দুঁদে বাঙালি জামাইরা আমাকে বুঝিয়েছিল, ‘এখন তুমি এনআরআই জামাই। এ বার জামাই ষষ্ঠীতে যে তত্ত্ব পাবে, সেটার সম্মানমূল্য ‘নোবেলতুল্য’। তা গেলাম। ওমা, কোথায় কী! আশ্চর্য, আমার ক্ষেত্রে বঞ্চনাটা কি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’! সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সেম মেনু। উপহার? স্যান্ডো গেঞ্জি আর রুমাল। ভাগ্যিস পুরোহিত ভেবে গামছা দেয়নি! আমার বাস্তববাদী শ্বশুরবাড়ি ভেবেছে, জামাই আমেরিকা থেকে এই গরমে এসেছে, একটু খোলামেলা অন্তর্বাস আর ঘাম মোছার রুমাল পেয়ে বাবাজীবন খিলখিল করে হাসবে। বলছি কি মশাই, আমেরিকা থেকে ফোন গেল, ‘কি, এ বার নিশ্চয়ই পাঁঠার মাংস, সেই হাঁসের ডিম আর নেই?’ আমি কান্না কোনওমতে চেপে রেখে জবাব দিলাম, ‘না, এ বার হংসডিম্ব নয়, এ বার অশ্বডিম্ব’! ঠিক সেই সময় শ্বশুর-শাশুড়ি ডুয়েট গাইলেন, ‘স্বচ্ছ ভারতে আজ আচ্ছে রাত আয়েগা!’ শ্বশুরের ফ্ল্যাটের উপরতলায় থাকেন আমার এক মাসিশাশুড়ি। তাঁরও মেয়েজামাই আছে। তো, রাতে সেখানে গণজামাই ষষ্ঠী! এমন একটা পবিত্র সামাজিক অনুষ্ঠানেও সিন্ডিকেটের ছোবল। এ তো সান্ধ্য টিভি’র বেকিং নিউজ! কেন বাপু, আমি কি বারোয়ারি জামাই!
আরও পড়ুন: বাঙালির স্মৃতিতে জামাই ষষ্ঠীর স্মৃতি অমলিন রেখেছে পঞ্জিকা
তা সে যাত্রা আমেরিকা ফেরত এসে আমি মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিলাম, এর পরের বার জামাই ষষ্ঠীতে আউটসোর্সিং করব! প্রয়োজনে শাশুড়ি হায়ার করব। নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেব, প্রবাসী বাঙালিরা সব পারে। মার্কিন মুলুকেই হবে জামাই ষষ্ঠী। বউকে বললাম, ‘‘নাও, এ বার সরেস বাঙালিনী দেখে একটা মা পাতাও তো দেখি!’’ বউ অবাক হয়ে বলল, ‘‘সেকি, এখানে তো সবাই দাদা দিদি! দিদিকে মা বানাবো কী করে!’’ আমি বললাম, ‘‘ইচ্ছে থাকলে সব হয়। তুমি দিদি-মা পাতাও। বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বরী’! বউ এ বার হবু দিদি-মা’র এলিজিবিলিটি জানতে চাইল। আমি জানিয়ে দিলাম, ‘গৃহকর্মে নিপুণা, রন্ধন পটীয়সী, সুন্দরী কন্যা প্রসবিনী’ শাশুড়ি আবশ্যক। একটা গোপন কথা জানাই, পাঁচকান না করাই ভাল। শালী ছাড়া শ্বশুরবাড়ি আমি ভাবতেই পারি না। অনেক সনাতনী জামাইকে দেখি শীতকালে শ্বশুরবাড়িতে গায়ে শাল জড়িয়ে বসে থাকে। আমি অমন নই, আমি সামাজিক জামাই। আমি শ্বশুরবাড়ি গেলেই ঋতু নির্বিশেষে গায়ে শালী জড়িয়ে বসে থাকি, তাতে যতই দুর্নাম বা ঘাম হোক না কেন। ভাবছেন, শালীর সঙ্গে ঘামের কি সম্পর্ক! সুন্দরী শালী মানেই কন্টিনেন্টাল রেস্, মাল্টিপ্লেক্সে মুভি, বহুজাতিক মল-খানা। অবশেষে মলত্যাগ করবেন যখন, আপনি ঘেমে নেয়ে একশা’!
একে একে ঝাঁকে ঝাঁকে দেশি বিদেশি চেনা অচেনা নামের রং বেরংয়ের খাবার আসতে শুরু করল। আসছে তো আসছেই। অলঙ্করণ- তিয়াসা দাস।
তা যাকগে, পাওয়া গেল একটা দিদি-মা। ‘প্যাকেজ’ জামাই ষষ্ঠী। কম্বো অফার পেলাম, থ্রি ইন ওয়ান। বউ মেয়ে নিয়ে হাজির হলাম পাতানো শ্বশুরালয়ে। ও বাবা, যা পাইলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। এ কি ষষ্ঠীপুজো না জামাই ধামাকা রে ভাই। কুটিরশিল্পজাত পাটের আসনে পদ্মাসনে বসে দেখলাম, দীপ জ্বলছে, ধূপ পুড়ছে, শঙ্খ বাজছে, পাতানো শ্বশুর হাততালি দিচ্ছে, সুন্দরী শ্যালিকা উলু দিচ্ছে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশগান ঝলসে উঠেছে। আমি কি পাতানো জামাই, নাকি শিবঠাকুর! মাথায় আবার জল বা দুধ ঢেলে দেবে না তো! আমারে তুমি জামাই করেছো, এমনই লীলা তব।
অবশেষে চন্দনের বাটি আর ধানদূর্বা হাতে নিয়ে শাশুড়ির নামভূমিকার অভিনয় করা ‘দিদি’ এল। সবাই ‘দাদা’ ধরে, আমি ‘দিদি’ ধরেছি। এবং মেগা হিট! ইয়া দিদি সর্বভূতেষু শাশুড়ি রূপেন সংস্থিতা। আবেগে দিদির রাতুল চরণ যুগলে একটা জোড়া হাতের পেন্নাম ঠুকে দিলাম। এর পরে ‘ভূতের রাজা দিল বর’! একে একে ঝাঁকে ঝাঁকে দেশি বিদেশি চেনা অচেনা নামের রং বেরংয়ের খাবার আসতে শুরু করল। আসছে তো আসছেই। এটা কি মধ্যাহ্নভোজ, নাকি টিভি সিরিয়াল, শেষ আর হয় না! অনেক কষ্ট করে এ বার তত্ত্বের দিকে ক্ষণিকের দেখার সুযোগ পেলাম। আহা কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। জীবনে এই প্রথম নিজেকে তথাকথিত শ্রেণিশত্রু এবং বুর্জোয়া জামাই বলে মনে হল।
আরও পড়ুন: হিমসাগরের বদলে কাশ্মীরি আপেল, রসগোল্লার বদলে জয়নগরের মোয়া
সত্যি বলছি, এরপর থেকে জামাই ষষ্ঠী ঘনিয়ে এলে এই ভিনদেশেও মনের ভিতর সানাই বাজে। আমি ‘মনের গোপনে নিভৃত কোণে দ্বার ছিল যতগুলি’ সব খুলে দিয়ে, পাতানো শাশুড়ির ফোনের অপেক্ষায় থাকি। এ বারও থাকতাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করেছি। এখন তো জীবন যখন শুকায়ে যায় করোনা ধারায় এসো অবস্থা। বাজারহাটে নিষ্ঠুর লকডাউন। উৎকণ্ঠায় আছি, এত কাঠখড় পুড়িয়ে জামাই ষষ্ঠী করতে যাব, কিন্তু গিয়ে হয়তো দেখব, পাতানো শাশুড়ি আমার এক হাতে স্যান্ডউইচ আর অন্য হাতে স্যানিটাইজারের শিশি ধরিয়ে দিল। তত্ত্ব বলতে হয়তো এক বাক্স ওয়াইপ আর খান কয়েক নাকোশ (মাস্ক)!
তাই ভাবলাম, এ বার বরং থাক।
‘চিরকাল কাহারো সমান নাহি যায়’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy