জামাইষষ্ঠী। দু’টি পরিবারের মধ্যে দিয়ে গোটা সমাজের মধ্যে ভালবাসার সেতু রচনার এটি এক আশ্চর্য লোকাচার।
দুর্গাপুজোর যেমন বিশেষ একটা গন্ধ থাকে, পৌষ সংক্রান্তির থাকে আলাদা একটা গন্ধ— ঠিক সেই রকম জামাই ষষ্ঠী দিনটারও একটা অন্য রকম নিজস্ব গন্ধ আছে। আমার কথাগুলো হেঁয়ালির মতো শোনালেও আসলে কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি। দুর্গাপুজোর গন্ধ— শিউলিফুল, ধূপ, ধুনো, ভোগের খিচুড়ি আর সন্ধেবেলায় গ্যাসবেলুনের অদ্ভুত গন্ধ মেশানো। পৌষ সংক্রান্তির গন্ধ— গোবিন্দভোগ চাল আর নতুনগুড় দিয়ে তৈরি করা পায়েস আর পিঠেপুলির মিষ্টি সুগন্ধে ভরা। তেমনই জামাই ষষ্ঠী দিনটার গায়েও কয়েকটি বিশেষ জিনিসের গন্ধ লেগে থাকে।
প্রতি বছর জামাই ষষ্ঠীর দিন সকালবেলায় নতুন পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি আর শাড়ির খসখসে একটা গন্ধ একটি বাড়ি থেকে আর একটি বাড়িতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তার একটু পর থেকেই হাওয়ায় হাওয়ায় চন্দননগরের এক নম্বর হিমসাগরের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। জামাইকে নিজের পেটের ছেলে মনে করলেও, খাবার জন্য তার হাতে তো আর গোটা আমখানা ধরিয়ে দেওয়া যায় না। তাই শাশুড়িঠাকরুনরা সেগুলোর খোলা ছাড়িয়ে, খাদি খাদি করে কেটে, সাদা কাচের থালা ভরে সাজিয়ে দিতেই বেশি তৃপ্তি অনুভব করেন। আর ডান, বাঁ, সামনে, পিছন— সব বাড়িতেই ওই ভাবে একই সময়ে আম কাটা হতে থাকলে, গোটা পাড়াটাই যে হিমসাগরের গন্ধে ম’ ম’ করতে থাকবে, এ তো জানা কথা!
এর কিছু ক্ষণ পর থেকেই পর পর কয়েকটি লোভনীয় গন্ধ লাইন দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে কলকাতার পুরনো মধ্যবিত্ত পাড়াগুলোর আকাশে বাতাসে। যার প্রথমটি হল লম্বা দানার বাসমতী চাল দিয়ে তৈরি করা উৎকৃষ্ট ঘি-ভাতের। সে সুবাস নাকে গেলে জামাই বাবাজীবনের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির পড়শিরাও চোখের সামনে গ্রামবাংলার সোনালি ধানখেতের থ্রি-ডি ছবি দেখতে শুরু করেন। এর পর একে একে আসতে থাকে ইলিশমাছ এবং চিংড়িমাছ ভাজার তীব্র মোহিনী গন্ধ। ইলিশ হল এমনই একটি মাছ যার সাইজ এবং গড়ন যদি ঠিকঠাক হয়, তবে তার ভাজার খবর আধ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সে নিজেই জানান দেবে। আর শিশুরাও জানে যে, সেই গন্ধে মানুষ তো বটেই, মানুষের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো হাসিখুশি ভূতেরাও তাদের কথাবার্তার খেই হারিয়ে ফ্যালে। ইলিশের মাখোমাখো ভাপা বা ঝালের সুগন্ধের কথা এখন না হয় ছেড়েই দিলাম।
আরও খবর: বাঙালির স্মৃতিতে জামাই ষষ্ঠীর স্মৃতি অমলিন রেখেছে পঞ্জিকা
আবার একই ভাবে চিংড়িমাছ ভাজার গন্ধে পাড়ার গন্ধ-পেটুক বাসিন্দাদের সঙ্গে আধপাগল হয়ে যায় এলাকার বিচক্ষণ হুলোরা। তারা খানিক লাফালাফির শেষে উদাস হয়ে, পাঁচিল বা ভাঙা কার্নিসে বসে, আকাশের দিকে মুখ তুলে মেঘেদের মধ্যে চিংড়িমাছের আদল খুঁজে বেড়ায়। যতই হোক, জামাইয়ের পাতে তো আর কুঁচো চিংড়ি দেওয়া চলে না। দিতে হলে, দিতে হয় জায়েন্ট সাইজের একজোড়া গলদা কিংবা নিদেনপক্ষে বিঘতখানেকের একগোছা টগবগে বাগদাকে। আর এদের মালাইকারি করাটাই তো চিরকালের রীতি। আর সেই গন্ধও কিন্তু নেহাত কমতি যায় না।
জামাই ষষ্ঠীর দিন সকাল থেকে চিংড়ি-ইলিশ রান্নার তরিবত ফিকে হয়ে আসার পর, যে গন্ধটি একটু বেলার দিকের হাওয়াবাতাস ভরিয়ে তোলে, তা হল ঘানির খাঁটি সরষের তেলে পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে কষা রেওয়াজি খাসির মাদকতাময় সুগন্ধ। বলতে দ্বিধা নেই, এই গন্ধটি একেবারে রূপকথার মতো। এটি যার নাকে যায়, সে ওই রান্নার পাত্রটিকে, মহাভারতের সঞ্জয়ের মতো মানসচক্ষে দেখবার অধিকারী হয়। লালচে খয়েরিটে তুলতুলে ডুমোডুমো মাংসের পিস, গলা পর্যন্ত কাইয়ে ডুবে থাকা ফিকে হলদেটে চন্দ্রমুখী আলু, তিনকোনা কালচে মেটের টুকরো— সব যেন মনের পর্দায় জ্যান্ত হয়ে নড়াচড়া করতে শুরু করে। জিভের ডগা নিজের অজান্তে কখন যে অবাধ্য হয়ে ওঠে, খেয়ালই থাকে না!
আরও খবর: জামাই ষষ্ঠী পালন করার প্রধান উদ্দেশ্য কী
জামাই ষষ্ঠীর দিন সন্ধেবেলায় কিছুটা টাটকা রজনীগন্ধা বা জুঁইফুলের সুবাস ছড়িয়ে যায় পাড়ার বনেদি বাড়িগুলোর খোলা জানলার ধারে ধারে। আর সেই ফুলের গন্ধের পিছনে হইহই করে ছুটে আসে দামি দার্জিলিং চায়ের ভুরভুরে সুরভি। আবার চায়ের গন্ধের পিছু পিছু দুলকি চালে এগিয়ে আসে দিশি ভেটকির ফ্রাইয়ের অবাক করা সুগন্ধ। কারণ জামাইয়ের বিকেলের জলখাবার বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে, না কি! এর পর একটুখানি গ্যাপ। বাবাজীবন ছাদে উঠে ছোট শালির সঙ্গে গল্প করতে করতে ধূমপান করলে হয়তো দু’ঝলক দামি তামাকের গন্ধ। তার পরেই পাওয়া যায় তপ্ত গাওয়া ঘিয়ে লুচি বা কচুরি ছাড়ার মিষ্টি সুবাস। আরে বাবা, এই সব গন্ধ নিয়ে তবেই তো জামাই ষষ্ঠী! জামাইকে ঘিরে একটি বাড়ির আনন্দ, হাসি, গান, উচ্ছ্বলতা— সব কিছু।
কিন্তু সে সব তো হয়েই থাকে ফি বারে। এ বারে কী হবে?
করোনার ছোঁয়াচে দাপটে এ বার তো সব কিছু বন্ধ! বন্ধ দেখাশোনা, মেলামেশা, আত্মীয়তা, কুটুম্বিতা— সব কিছুই। প্রায় দু’মাসের উপর রুজি-রুটি শিকেয় তুলে নিজের ঘরেই আটকা পড়ে আছেন সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষ। যাঁরা গাছ থেকে হিমসাগর পেড়ে আনেন, যাঁরা সেগুলো ট্রেনে বা লরিতে চাপিয়ে কলকাতার সমস্ত বাজারে পৌঁছে দেন, বাজারে বসে যে সব বিক্রেতা আমগুলোকে বাজারু গেরস্তর রংচঙে নাইলনের ব্যাগে যত্ন করে ভরে দ্যান, তাঁরা সবাই আজ এক অচেনা আতঙ্কের ভয়ে ঘরবন্দি। বাংলাদেশ থেকে ইলিশমাছের কোনও সাপ্লাই নেই। এখানকার হিমঘরও লোকের অভাবে কার্যত বন্ধ। আটকে গেছে দামি দামি চিংড়ি আর দেশি ভেটকির আনাগোনা। লম্বা লাইন-পড়া খাসির মাংসের দোকানগুলো শেষ যে কবে খুলেছে, তা আমরা ভুলেই গিয়েছি। গড়িয়াহাট বা শ্যামবাজারের পোশাকের নামকরা দোকানগুলো একধার থেকে বন্ধ। ফুলের হাট আর বসছেই না হাওড়ায়। লোকাল বাজারে আসছে কেবল কুচো ফুল, দুব্বো আর ছোট ছোট গাঁদার মালা। রজনী বা জুঁই পুরোপুরি উধাও। যাঁরা এ সব ফুলের চাষ করতেন, সাপ্লাই দিতেন হাওড়ার হাটে কিংবা মালা গেঁথে নিয়ে বসতেন লোকাল বাজারগুলোর মুখে বা ছোটখাটো গেরস্ত পাড়ার মিষ্টির দোকানের আশপাশে— তাঁরা সব গেলেন কোথায়? পাড়ার মিষ্টির দোকানের যে পাকাচুল শিঙাড়াদাদু, তিনি তো সে-ই কবে নিজের দেশে চলে গিয়েছেন। দোকানই যদি না খোলা যায়, তবে আর তাঁর শহরে ফিরে লাভ কী? আর ফিরবেনই বা কিসে? দেশগাঁয়ে কী ভাবে চলছে আজ ওঁদের সংসার?
দুধেভাতে থাকা গেরস্তর যেমন তেলচুকচুকে জামাই আছে, তেমনই জামাই ষষ্ঠী পার্বণটি সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয় যাঁদের জন্যে, সেই আমবিক্রেতা, মিষ্টিবিক্রেতা, মাছ-মাংস বা ফুল বিক্রেতার সংসারেও তেমনই খেটেখাওয়া-জামাই আছে অথবা তাঁরা নিজেরাই হয়তো কারও না কারও টাটকা জামাই। তাঁদেরও নিশ্চয়ই স্নেহময়ী শাশুড়িমা আছেন। দুষ্টু-মিষ্টি শ্যালক-শ্যালিকারা আছে। আছেন সাদা ধুতির সঙ্গে ধবধবে বাংলা শার্ট পরা শ্বশুর, কাকাশ্বশুর বা দাদাশ্বশুর। যাঁরা জামাইয়ের পিঠে আলতো করে হাত রেখে, গলাটা একটু বেস-এ নামিয়ে বলে থাকেন, এ কী কথা বাবাজীবন! তুমি তো দেখছি কিছুই নিচ্ছ না!! বছরের এই একটি সময় এঁদের স্ত্রীরাও নিশ্চয়ই আশা করেন, স্বামী-সন্তানের হাত ধরে, মিষ্টির হাঁড়ি ও নতুন ধুতি-শাড়ির প্রণামী নিয়ে, হাসিমুখে নিজেদের বাপেরবাড়িতে যাবেন। মূল জামাই ষষ্ঠীর দিনে যদি না-ও হয়, তবে হয়তো এক হপ্তা পরে। না হলে দশ দিন পরে। কিন্তু যাবেন তো বটেই। অথচ হতচ্ছাড়া অনামুখো ‘করোনা’ তাঁদের সব্বার মনের সেই আশার আনন্দে এ বারে যেন একঘটি জল ঢেলে দিয়েছে।
আপডেটেড শ্বশুর-শাশুড়িরা অবশ্য তাঁদের জামাইকে বলতেই পারেন, বাবা তুমি নিজের পছন্দ মতো একটা জামা অনলাইনে কিনে, ওই দিন কোনও নামী রেস্তরাঁ থেকে পছন্দমতো খাবার হোম ডেলিভারিতে আনিয়ে নিও, টাকাটা আমি আগেই তোমার গিন্নির অ্যাকাউন্টে নেট ব্যাঙ্কিং-এ পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তাতে কি সত্যিই এই দু’জনের কোনও আনন্দ হবে? শুধু দামি জামা দেওয়া আর সুখাদ্য খাওয়ানোটাই তো জামাই ষষ্ঠীর মূল কথা নয়। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে আত্মীয়তা ও ভালবাসার এক নিবিড় বন্ধন। দু’টি পরিবারের মধ্যে দিয়ে গোটা সমাজের মধ্যে ভালবাসার সেতু রচনার এটি এক আশ্চর্য লোকাচার। কিন্তু এ বার, সমাজের সেই সব মানুষ, যাঁরা অন্যের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলার জন্য প্রতি দিন চেষ্টা করেন, তাঁরাই তো বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছেন, বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছেন। তাঁরা তো এ বার আমাদের সঙ্গে জামাই ষষ্ঠীর পার্বণে একাত্ম হতে পারছেন না। তাই এ বারের জন্যে আমরা জামাই ষষ্ঠীটাকে না-হয় একটু পিছিয়েই দিলাম।
আশা করি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের চারপাশের পরিবেশটা অনেকটাই সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। প্রাণের ছন্দ ফিরে পাবে জগৎ-সংসার। তখন না হয় আমরা এই পার্বণটিকে বিশেষ ভাবে পালন করব। হতে পারে সেটা দুর্গাপুজোর পর, হতে পারে সেটা শীতকালে, হতে পারে সেটা আগামী বসন্তকালে পলাশ উৎসবের সময়। এ-ও হতে পারে, তখন হিমসাগর আমের বদলে লেকমার্কেটে কাশ্মীরি আপেল উঠবে, ইলিশের বদলে কাঁসার পদ্মকাটা বাটিতে সাজানো থাকবে নবীন ফুলকপি দিয়ে দিশি কই, রসগোল্লার বদলে জেল্লা দেখাবে পেস্তা ছড়ানো জয়নগরের মোয়া আর পাড়ার বাতাস ভুরভুর করবে নতুনগুড় দিয়ে বানানো আতপচালের পায়েসের সুগন্ধে। জামাই ষষ্ঠীতে সেটা বরং একটু নতুনত্বও হবে, মুখবদলও হবে। জামাইবাবাজি পাঞ্জাবির সঙ্গে হয়তো পাবে কাঁথাস্টিচের সুন্দর জহরকোট। কিছু কিছু ডেঁপো শালা-শালী আড়াল থেকে, ‘শীতকালে এটা জামাই ষষ্ঠী না শীতল ষষ্ঠী রে ভাই!’ বলে যতই হাসাহাসি করুক না কেন, সবার কথা ভুলে গিয়ে স্বার্থপরের মতো এ বারে কিছুতেই নিজেদের বাড়ির জামাই ষষ্ঠীটা আমরা যথাসময়ে পালন করে ফেলতে পারব না। তখনই পালন করব, যখন আমাদের চারপাশের নানান স্তরের মানুষগুলো আর্থিক ও সামাজিক ভাবে কিছুটা অন্তত সামলে উঠবেন। তবেই তো আমরা মন থেকে এর আনন্দটা ঠিকঠাক উপভোগ করতে পারব।
(কার্টুন: দেবাশীষ দেব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy