এক একটা ঘটনা ঘটে আর মনে হয় এই, এইখানেই বোধহয় শেষ হয়ে গেল সভ্যতা। এরপর আর প্রত্যাশা করার কিছু রইল না। কিন্তু তারপর কায়ক্লেশে মনকে আবার দাঁড় করাই আমরা। আমরা অনেকেই। ব্যক্তিগত ভাবে অনেক মেয়েকে চিনি যাদের কিছু কিছু ঘটনায় এই প্রতিক্রিয়াই হয়েছে, যদি একটুও বাড়িয়ে না বলি। হ্যাঁ, যদি একটুও বাড়িয়ে না বলি, যেদিন নিভর্য়ার রেপিস্টকে নাবালক বলে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছিল, ধাবায় চাকরি দেওয়া হয়েছিল, এই মহা-কোটির ভিড়ে মিশে যেতে সাহায্য করা হয়েছিল, সেদিন আমরা মেয়েরা অনেকে বিলাপ করেছিলাম। যদি একটুও বাড়িয়ে না বলি, সেদিন আমাদের মেয়েদের অনেকের গলা তুলে, বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছিল। আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি, একটা যুগান্তকারী রায় না দিয়ে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার রাস্তায় না হেঁটে দেশ আর তার আইন কেন ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম হিসেবে কাজ করছে একের পর এক ঘটনায়? কেন তাই করে সব সময়? বার বার এটাই ঘটে। কত কত উদাহরণ দেব? আজ মনে হয়, দেশ অপরাধীর বিচার করে না, বরং অপরাধীর দিকে আঙুল তোলে যারা, দেশ তাদের দিকেই একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। রাষ্ট্র আসলে ভিকটিমের বিচার করে, সেই বিচার চলতে চলতে, চলতেচলতে যখন পর্যুদস্ত হয়েও অপরাধীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন, হায়, তখন গিয়ে তাকে শাস্তি দেওয়া হয় কোনও মতে। নইলে গত পাঁচ-সাত বছরে এতগুলো ভয়াবহ ধর্ষণ ও নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে, অথচ একটাও ফাঁসি হয়নি? না, একটাও হয়নি। কতগুলো বিচার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তার সম্পর্কে কোনও তথ্য এই মুহূর্তে আমার হাতে নেই। আসিফার ঘটনার পর আরও এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল। কোনও বিচার আজও শেষ হল না। একটাও ফাঁসি হল না।
স্বাধীনতা। দেশের স্বাধীনতা। বাহাত্তর বছর হয়ে গেল, তাই না? কেমন একটা ঘোর লাগে যেন। আমাদের ছোটবেলাটার অনেকটা দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার গল্প মশগুল হয়ে শুনতে শুনতে কেটেছে। তখনও, চল্লিশ বছর আগে দেশ যে অনেক মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, এই বাক্যটা প্রতিদিন কোনও না কোনও ভাবে মানুষের মুখে উঠে আসত। ফলে স্বাধীনতা শব্দটাকে আমরা একদম জন্ম ইস্তক শুনে এসেছি বললে ভুল বলা হয় না। এবং স্বাধীনতা জিনিসটা যে একটা অর্জন, হেলাফেলার বিষয় নয়, রক্ত আর কান্নায় বিহ্বল, এটা আমাদের প্রজন্ম প্রতিদিন জানতে জানতে উঠে এসেছি। আন্দামানের সেই পাথুরে, ঠান্ডা, নিঃসঙ্গ, মৃত্যু-মন্থর কারাগারের ছবি আমাদের চোখের সামনে ঝুলেছে প্রায় গোটা বাল্যকাল। আমার তো নিজের এরকম কোনও বয়সের কথা মনে পড়ে না যখন স্বাধীনতা শব্দটাকে আমি চিনতাম না, বা স্বাধীনতা কী তাই নিয়ে বসে বসে ভাবতাম না! তারপর আস্তে আস্তে জেলের কুঠুরি সরে গেল, চাবুকের সপাং সরে গেল, বুট দিয়ে মাড়িয়ে দেওয়া, বিপ্লবীদের অনশনে মৃত্যু কিংবা ফাঁসি কেমন দূরে সরে যেতে যেতে আবছা হয়ে গেল। ব্লাডি ইন্ডিয়ান টিন্ডিয়ান বলে আমাদের যারা ডাকত, ভাল ভাল ছাত্রছাত্রী, ইন্টেলিজেন্ট লোকজন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সব তাদের দেশে পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে চলে যেতে লাগল। যারা যেতে পারল না দেশ তাদের জন্য পাহাড়ি মেষপালকের মতো খাদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকল কপাল কুঁচকে।
এই রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে যতগুলো পরিচয় বহন করি, আজ সেই প্রতিটা পরিচয়ের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এখন ভাবতেই হচ্ছে, আমি কি স্বাধীন? আমার রাষ্ট্র কি সত্যি আমার সমস্ত সত্তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে পারছে? আমি ভারতীয়। আমি নারী। আমি আমার হিন্দু জন্মবৃত্তান্তের মধ্যে দাঁড়িয়েও নাস্তিক। এছাড়াও আমি একজন বাঙালি এবং বাঙালি বলে আমি গর্বিত। সমস্ত পরিচয় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে তৈরি হয় আমার নাগরিক সত্তা।
ছবি দেখে চিনতে পারবেন স্বাধীনতার এই কারিগরদের?
এবং আরও আছে। যেমন আমি একজন লেখক। দেশ কি এই প্রতিটা পরিচয়কে যথেষ্ট স্পেস দিতে পারছে? কারণ রাষ্ট্র নিজে এই নানা রকম সহাবস্থানের জন্য নিরপক্ষ নীতি নির্ধারণ করতে পারছে না। স্বাধীনতার এত বছর পর রাষ্ট্র নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না আধুনিক সময়ের উপযুক্ত করে। ধর্ম নিয়ে হুজুগ বাড়ছে। বাড়ছে বিদ্বেষ। বাড়ছে হিংসা। আজ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বিরাট একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে। যে কোনও মুহূর্তে আগুন জ্বলতে পারে। আমার দেশের মেয়েরা বৈষম্যের শিকার হতে হতে এখন সর্বত্র টার্গেট। খুব কি ভুল বলা হবে যদি বলি যে নারীমেধ-যজ্ঞ চলছে দেশের কোণে কোণে। যে স্বাধীনতা আমি দশ বছর আগে উপভোগ করেছি একজন নারী হিসেবে, এখন কিন্তু সেই মুক্ত পরিবেশ আর নেই। এখন তা অতীত। ক্রমশ ভয় আমাদের গ্রাস করছে। কন্যা ভ্রুণ হত্যা বেড়েছে চরম।। ধর্ষণ বেড়েছে। শিশু ধর্ষণ একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যাচ্ছে। তিন বছরের বাচ্চাটাকে ধর্ষণ করে মাথা কেটে ফেলল! এই দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরবে প্রতিনিয়ত। আমার ভাষা বাংলা, কিন্তু আমার ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। অঞ্চলে যদি অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তাহলে আঞ্চলিক ভাষা টিকে থাকতে পারে না। বাংলা ভাষায় পঠনপাঠন, শিক্ষাদীক্ষা যদিদারিদ্রের কমপালশনে পরিণত হয়তার থেকে দুঃখের আর কী হতে পারে! লেখক হিসেবেও আমাকে আগামী সময়ে ভাবতে হবে কী বলব, কী লিখব, কতটা প্রতিবাদী হব, কতটা সমালোচনা করব, কারণ কোনটা দেশদ্রোহিতা, কোনটা নয়, সেটাও এখন ভাবনার বিষয়।
আরও পড়ুন: ‘ভারত যেন আমাদের সংযমকে দুর্বলতা না ভাবে’, নিরাপত্তা পরিষদে চিঠি দিয়ে জানাল পাকিস্তান
এ বছর জলকষ্টে ভুগছে কতগুলো রাজ্য। জলস্তর নেমে যাচ্ছে। সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গবাসীকে আগামী বছর এই জলকষ্টে পড়তে হবে। গাছ কাটা হচ্ছে, প্লাস্টিক ব্যবহার করা নিয়ে কোনও আইনের শাসন নেই। এদেশে মেনস্ট্রিমে কেউ কাজ করে না। অদ্ভুত ভাবে একটা সমান্তরাল শাসন ব্যবস্থা চলে শুধু বেআইনি কাজকারবারের। যেমন, ঘুষ দিলেই সব কাজ হয়ে যায়। ঘুষ নিলে কিন্তু লোকে কমিটেড হয়ে পড়ে। তখন সে ভাবতেই পারে না ঘুষ নিয়ে কাজ করব না। কারণ ঘুষের একটা অন্ধকার জগৎ আছে। তার একটা প্রশাসন আছে। সেখানে কেউ বেইমানি করার সাহস পায় না। বড়বাজার থেকে মুখে বলে টাকা ধার নেওয়া যায়। এবং সেই টাকা একদম কড়ায়-গণ্ডায় ফেরত না দিলে জীবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যেতে হতে পারে চিরকালের মতো। এদিকে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে কিন্তু দিব্যি লন্ডনের রাস্তায় উটপাখির জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়ায় ডিফল্টার। ভারত সরকারের ইন্টেলিজেন্স কিছু জানতেই পারে না। আমাদের দেশে এই সমান্তরাল সিস্টেমটা, এই সমান্তরাল অর্থনীতিটাই বেশি ভরসাযোগ্য। অর্থাৎ, বেআইনি জগতের মানুষরা বেআইনের নীতিটা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে চলে। আর এদিকে বৈধ সভ্যতাটা কোনও মতে টিকে আছে আর কী!
এসবের মধ্যে স্বাধীনতা দিবস আসে, চলে যায়। মানুষের তেমন কোনও প্রত্যাশা নেই। ওই ফেসবুকে একটু স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মাতামাতি না করলে ভাল দেখায় না তাই করতে হয়। আর স্বাধীনতা নিজে আসলে অনেক দূরের সার্চলাইট। ঘুরে ঘুরে সবার মুখের ওপর এসে পড়ে চকিতে সরে যায়। কারণ, সে আমাদের কাউকে খুঁজছে না। এখানে তার কোনও সতীর্থ নেই। কোনও সহযোদ্ধা নেই!
যাঁদের হাত ধরে পাওয়া এই স্বাধীনতা, তাঁদের সম্পর্কে এগুলো জানেন?
গ্রাফিক্স: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy