Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

দুই যতীন

নরখাদক বাঘের অত্যাচার থেকে গ্রামবাসীদের বাঁচাতে ভোজালি দিয়ে বাঘ হত্যা করেছিলেন তিনি। সেই থেকেই তাঁর নামের আগে জুড়ে যায় ‘বাঘা’। এই তেজের সূত্রপাত কৈশোর থেকে।

তেজীয়ান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে বাঘা যতীনের মূর্তি। বাঁ দিকে তাঁরই ছবি।

তেজীয়ান: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে বাঘা যতীনের মূর্তি। বাঁ দিকে তাঁরই ছবি।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৯ ০০:২৫
Share: Save:

বাঘা যতীন যদি ইংরেজ হতেন, তা হলে ইংরেজরা ট্রাফালগার স্কোয়্যারে নেলসনের পাশে তাঁর স্ট্যাচু বানিয়ে দিতেন।’— বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছিলেন ব্রিটিশ পুলিশ চার্লস টেগার্ট। বালেশ্বরের যুদ্ধে যাঁর পরিকল্পনা মতো এগিয়ে ব্রিটিশ সেনা শেষ করেছিল যতীন্দ্রনাথকে। বাঘা যতীনকে তিনি বলেছিলেন ‘ডিভাইন পার্সোনালিটি’, তুলনা করেছিলেন ইংল্যান্ডের বীর যোদ্ধা হোরাসিও নেলসনের সঙ্গে। একই ধরনের কথা শ্রীঅরবিন্দের লেখাতেও পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন, ‘তিনি (বাঘা যতীন) ছিলেন অভিনব ব্যক্তি। মানবতার পুরোভাগে ছিল তাঁর ঠাঁই। এমন সৌন্দর্য ও শক্তির সমন্বয় আমি দেখিনি, আর তাঁর চেহারাই ছিল যোদ্ধার অনুরূপ।’ বিপ্লবী অতুলকৃষ্ণ ঘোষ লিখেছেন, ‘শিবাজীর মতো রণকুশলী ও চৈতন্যের মতো হৃদয়বান একাধারে পেলে আমরা পাই যতীন্দ্রনাথকে।’ তাঁকে ‘ভারতীয় বিপ্লবের গ্যারিবল্ডি’ বলেছিলেন যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়।

নরখাদক বাঘের অত্যাচার থেকে গ্রামবাসীদের বাঁচাতে ভোজালি দিয়ে বাঘ হত্যা করেছিলেন তিনি। সেই থেকেই তাঁর নামের আগে জুড়ে যায় ‘বাঘা’। এই তেজের সূত্রপাত কৈশোর থেকে। একটা পাগলা ঘোড়াকে কাবু করে এক শিশুকে বাঁচিয়েছিল কিশোর যতীন। কলকাতার রাস্তাতেও ইংরেজ সেনাদের উদ্ধত ব্যবহার সহ্য না করতে পেরে তাঁদের বেদম পিটিয়েছিলেন তিনি। এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন দার্জিলিং যাওয়ার পথে শিলিগুড়ি স্টেশনেও। সেখানেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করে কয়েক জন ব্রিটিশ সামরিক কর্মচারীকে উত্তমমধ্যম দিয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীন অকুতোভয়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিদিন গীতা পাঠ করতেন। সে অভ্যেস তাঁর রয়ে গিয়েছিল আজীবন। মহুলডিহার শালবনে অজ্ঞাতবাসে থাকার সময়ও শিলাসনে বসে উদাত্ত গলায় গীতা পাঠ করতেন। সাক্ষী ছিলেন তাঁর সঙ্গী নলিনীকান্ত কর। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সেই অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। মনে হত যেন গৌতম মুনি স্বয়ং বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছেন।’

বাঘা যতীনের জীবনের নানা ঘটনা জানা যায় যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বই ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’ থেকে। যেমন, এক বৃদ্ধার ঘাসের বোঝা তাঁর কাছ থেকে নিজে মাথায় করে নিয়ে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর একবার ওলাওঠা রোগীর মলমূত্র নিজের হাতে সাফ করে তার সেবা করেছিলেন। আর এক বার তো পুরো বেতন অন্য এক জনকে দিয়ে তারই কাছ থেকে পাঁচ পয়সা ধার করে ট্রামে করে বাড়ি ফিরেছেন। শ্রান্ত, যন্ত্রণাকাতর সহযোদ্ধাদের নিজে হাতে শুশ্রূষা করতেন যতীন। গরমের দিনে পাখার বাতাস করে ঘুম পাড়াতেন তাঁদের। যাদুগোপাল তাঁর বইয়ে লিখছেন, ‘শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে তিনি এত বলীয়ান ও উচ্চস্তরে বিচরণ করতেন যে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন দ্বিতীয় ব্যক্তি চোখে ঠেকেনি। মানুষ হয়তো পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। কিন্তু পূর্ণতার কাছাকাছি যারা পৌঁছেছেন, তাঁদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথের স্থান সুনিশ্চিত।’

হাজরা পার্কে মর্মর মূর্তিতে যতীন্দ্রনাথ দাস

১৯১৩ সালে বর্ধমান ও কাঁথির ভয়াবহ বন্যায় ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সময়ের কথা জানা যায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে, ‘যতীনদা বসেছেন উদার আকাশের নীচে দৌলতপুর কলেজ হোস্টেলের দোতলার খোলা বারান্দায়। গভীর রাত। আমি একলা ওঁর দিকে চেয়ে বসে। যতীনদার ওই মুখখানা, ওই চোখ দুটো, ওই বুকখানার সঙ্গে ওই আকাশখানার কোথায় যেন যোগ আছে, কোথায় যেন মিল আছে।’ এই মানুষটাই কিন্তু বিদেশি শক্তির সাহায্যে প্রথম দেশ স্বাধীন করার কথা ভেবেছিলেন। জার্মান জাহাজ ধরা পড়ার খবরে শান্ত ভাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বিদেশের সাহায্যে ভারতকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। দেশ কিন্তু নিজের জোরে দাঁড়াবে। অপরের সাহায্যে নয়।’ বালেশ্বরের অজ্ঞাতবাস থেকে দিদি বিনোদবালাকে চিঠিতে যতীন লিখেছিলেন, ‘সংসারে সমস্তই যে কত অস্থায়ী তাহা আপনি অনেক প্রকারে দেখিয়াছেন এবং বুঝিয়াছেন। এই অস্থায়ী সংসারে অস্থায়ী জীবন যে ধর্মার্থে বিসর্জন করিতে অবকাশ পায়, সে তো ভাগ্যবান।’

১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বুড়িবালামের তীরে, কোপতিপোদার যুদ্ধে মারা গেলেন বাঘা যতীন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিপ্লবী যিনি ট্রেঞ্চ খুঁড়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেছিলেন, ‘‘আমরা মশলা পিষতে শালগ্রাম শিলা ব্যবহার করেছি।’’ মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমার জীবনে একটি মাত্র মানুষকে একপ্রকার অন্ধের মতো অনুসরণ করতাম, সেই মানুষটির আদেশ আমি ভুলতে পারতাম না। তিনি আমাদের দাদা ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি আমাদের সর্বাধিনায়কও ছিলেন।’

আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ, ২৩ ভাদ্র) তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়, ‘বাঘা যতীনের জীবন বাহিরের কোলাহলের মধ্যে নহে, সংবাদপত্রের ঢক্কানিনাদের মধ্যে নহে, প্রচলিত পলিটিক্যাল হাটের মধ্যে নহে, একান্ত নিভৃত, নীরব সাধনায় নিজেকে বিকশিত করিয়াছিল, সমুদ্রের গভীর তলদেশ-সঞ্চারী বিশালাকায় তিমির মত সমাজের গভীরতম অন্তর আলোড়িত করিয়াছিল, আয়েসী, বিলাসী, অপদার্থ বলিয়া জগতে পরিচিত বাঙালি যুবককে শ্রদ্ধা, ভীতি ও সম্ভ্রমের বস্তু করিয়া তুলিয়াছিল। বিধাতার একই কর্মশালা থেকে বাহির হইয়াছেন বিবেকানন্দ ও যতীন্দ্রনাথ।’

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আর এক যতীন— যতীন্দ্রনাথ দাসের জীবনও চিরস্মরণীয়। বাঘা যতীনের চেয়ে পঁচিশ বছরের ছোট তিনি। কিন্তু দুই যতীনের উদ্দেশ্যই ছিল এক। ভারতের স্বাধীনতা। স্কুলে পড়তে পড়তেই অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়ে বিপ্লবী জীবন শুরু। পরে তিনি মহাত্মা গাঁধীর ডাকে যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে। এই আন্দোলন করতে গিয়েই গ্রেফতার হন প্রথম বার। সময়টা ১৯২১। সেই তাঁর প্রথম জেলে যাওয়া। সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘আমার মনে আছে, ১৯২১ সালে পূজার ঠিক আগে আমরা যখন রসা রোডে কাপড়ের দোকানের সামনে পিকেটিং করি, তখন তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অনেকের মতো তাঁকেও জেলে পাঠানো হয়, কিন্তু মুক্তিলাভের পর তিনি নিজেকে সক্রিয়ভাবে দেশের কাজে নিয়োজিত রাখেন, অনেকেই যা করেননি।’ পরে সুভাষচন্দ্রের হাতে গড়া ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ দলে তিনি মেজরের পদ পান। বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। রাখা হয় ময়মনসিংহের জেলে। রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে পুলিশের খারাপ আচরণের প্রতিবাদে সেখানে তিনি অনশন শুরু করেন। কুড়ি দিন অনশনের পরে জেল সুপার ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। একদা অসহযোগ আন্দোলনের এই বিপ্লবী দীক্ষিত হন সশস্ত্র আন্দোলনের ভাবধারায়। বোমা তৈরি করতে শেখেন উত্তরপ্রদেশে, বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। যোগাযোগ হয় ভগৎ সিংহের সঙ্গে। ১৯২৯ সালের ১৪ জুন যতীন দাসকে লাহৌর যড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে কলকাতার ডোভার রোডের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়, পাঠানো হয় লাহৌরের বোরস্টাল জেলে। ইউরোপীয় বন্দিদের মতো ভারতীয় রাজনৈতিক বন্দিদেরও সমান মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা দিতে হবে— এই দাবিতে সেখানে অনশন শুরু করেন যতীন দাস। তাঁর অনশন ভেঙে দেওয়ার বারবার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু পারে না। শেষের দিকে যতীন দাসের শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে এক সময় তাঁকে আদালতে আনাও সম্ভব হত না। ২২ অগস্ট, লাহৌর জেল প্রশাসনের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভগৎ সিংহ এবং বটুকেশ্বর দত্ত যতীনকে দেখতে বোরস্টাল জেলে আসেন। ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর লাহৌর জেলে দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশনের পরে মারা যান যতীন দাস।

লাহৌর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম বন্দি অজয় ঘোষ লিখেছেন, ‘হাসপাতালে এসে দেখলাম যতীন দাস একটা ছোট্ট খাটিয়ায় শুয়ে আছে। তখনও তার জ্ঞান হয়নি। ডাক্তাররা আশঙ্কা করছেন, হয়তো রাত কাটবে না।’ যতীনের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দুঃখের মন্থন বেগে উঠিবে অমৃত/ শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।’

কলকাতার তৎকালীন মহানাগরিক যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘অন্য কোনও দেশ হলে তিনি দেবতার সম্মান পেতেন। ভারতবাসীর কাছে তিনি এখন পূজ্য।’ মৃত্যুর পরে তাঁকে নিয়ে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় লেখা হয়, ‘অনশনে জলমাত্র পান না করিয়া তেষট্টি দিন ধরিয়া মৃত্যুর আবাহন! তিনি অমৃতস্য পুত্রাঃ।’ ‘প্রবাসী’-তে লেখা হয়েছিল, ‘তেষট্টি দিন ধরিয়া তিনি মৃত্যুকে ধীর পদক্ষেপে ক্রমশ নিকটবর্তী হইতে দেখিয়াছেন। কিন্তু ভীত, বিচলিত হন নাই। ধন্য তাঁহার দৃঢ়তা।’ তাঁকে ‘অতিমানবিক’ বলেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেও হাঁপ ছাড়তে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। নিষিদ্ধ করেছিল কাজী নজরুলের ‘প্রলয়শিখা’ কাব্যগ্রন্থটি। যার অন্যতম কবিতাটির নাম ‘যতীন দাস’।

অন্য বিষয়গুলি:

Jatindra Nath Das Bagha Jatin Independence Day Special Independence Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy