ছবি: সুব্রত চৌধুরী
ফুটল দুপইরা ফুল, আলোয় আলোময় গো—’ দুপইরা, দুপহরিয়া। দ্বিপ্রহর বেলায় ফোটে যে ফুল। হরগৌরী। অর্থাৎ দোপাটি ফুল। তখন দোপাটি ফুলের কাল।
দুপুর হতে না হতেই হরগৌরী ফুল ফুটে আলোয় আলোময় হয়ে যেত চারধার।
আমরা টু-থ্রি। ফ্রি প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ি। বর্ষার মরশুম। শুধু কি দুপইরা ফুলের চারা! গাঁদা, গন্ধরাজ, বেলিফুল, নানাবিধ পাতাবাহারের ঝাড়!
এ ইস্কুল, সে ইস্কুল, খান্দারপাড়া, বাছুরখোঁয়াড়— ঘুরে ঘুরে দেখা। কোন ইস্কুলের বাগানে কী কী ফুলের চারা আছে, ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে দেখা। থাকলে চেয়ে-চিন্তে আনা।
বর্ষার মরশুমে ছাত্রছাত্রীদের উপর মাস্টারমশাইদের দেওয়া এই ছিল অবসরের কাজ। হোমটাস্ক।
অন্যের ইস্কুল থেকে আনো। নিজের ইস্কুল থেকে দাও। যে যত পারো। আনো রে, দাও রে! লাগাও রে, সাজাও রে! যে যার ইস্কুলের শোভা বাড়াও রে!
রীতিমতো দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ি। তার কাছে অঙ্ক দৌড়, বিস্কুট দৌড় কি গুলি-চামচ দৌড়ও ফেল মেরে যায়।
তো যা বলছিলাম, ‘ফুটল দুপইরা ফুল, আলোয় আলোময় গো।’ আমাদের মতো অজ পাড়াগাঁয়ে ‘দুপইরা’ ফুল ছাড়া আর কোন ফুলই বা ফুটবে!
বাছুরখোঁয়াড় ফ্রি প্রাইমারির হেডস্যর পিঠ থাবড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘যা, যা, তাই যা! দুপইরা পাস তো দুপইরা, পাতাবাহার আর কতক বেলিফুলের ঝাড়। মাটিসুদ্ধ শিকড়সুদ্ধ তুলে আনবি। দেখিস, তার আগে হাতজোড় করে অনুমতি নিতে ভুলিস না!’’
সে তো একশো বার। আমরা জনাকয়েক অমনি হইহই করে দৌড়লাম খান্দারপাড়া ফ্রি প্রাইমারির দিকে।
ভিজতে ভিজতে একদৌড়ে আমরা খান্দারপাড়া ইস্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে একদম অন্দরে ঢুকে এলাম। চুলের ডগা থেকে জল ঝরছে টুপটুপ, টুপটুপ! পায়ের নীচে ঘরের মেঝেটুকু জল পড়ে ভিজেই গেল।
‘‘এঃ হেঃ করেছ কী?’’ খান্দারপাড়া ফ্রি প্রাইমারির হেডস্যর গিরীন ষড়ঙ্গীর গলা।
আমরা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। ‘‘আজ্ঞে দুপইরা ফুলচারা—’’
‘‘বেচারা! তোমাদের হেডস্যরের আক্কেলখানা বলিহারি! এই বিষ্টিতে ভিজে অসুখবিসুখ হয় যদি? আর ক’দিন বাদেই না স্বাধীনতা দিবস, প্রভাতফেরি—’’
আমরাও ফিসফিস করে বলি, ‘‘আর ক্ষীরিভোগ!’’
****
রসেবশে শিকড় জড়িয়ে ফুলচারা ‘হালি’ অর্থাৎ সবুজ হতে না হতেই স্বাধীনতা দিবস এসে গেল। ঘরপ্রতি এক পালি আতপ চাল। সামান্য গুড়। আর গুড় যদি না থাকে তো চিনিই সই। আর দুধ? যার যেমন ক্ষমতা—
ধার্য করা চাঁদার রেট হল এই। চাল গুড় চিনি আর দুধ একুনে জোগাড় হলে চলে যাবে রামেশ্বর জিউয়ের মন্দিরে। সেখানে রান্না হবে ক্ষীরিভোগ।
শুরু হল প্রভাতফেরি। প্রত্যেকের হাতে ধরা ভারতের জাতীয় পতাকা। হাওয়া কেটে উড়ছে পতপত। ফতফত।
আর কী মধুর সমাগম! প্রভাতফেরির এই দলটি এখন বড়োডাঙা হয়ে প্রহ্লাদের ‘পাটাঘাটি’ পেরিয়ে যাবে খান্দারপাড়া। খান্দারপাড়া ফ্রি প্রাইমারির ছাত্ররাও মিলিত হবে একসঙ্গে। তার পর দুয়ে মিলে— ‘ভারতমাতা কি জয়!’
‘স্বাধীনতা দিবস কি জয়!’ ‘ভারতের জাতীয় পতাকা কি জয়!’’
আরও কত হুল্লোড় হবে। মজা হবে। তার কি অন্ত আছে? ভোর ভোর উঠে আমাদের গ্রামের বিপিনের ছোট ছেলেটি পেন্টুল ছেড়ে রেখে, গাছে চড়ে, পাতা ছিঁড়ছিল। ছাগলকে খাওয়াবে।
আর খাওয়ানো! বেভুলে ন্যাংটো হয়েই দলে ভিড়ল। হেডস্যর হাসলেন। আসুক, আজ তো স্বাধীন ভারত!
বাঁশের পাতিয়া চেঁছে পচা ডোবায় পচতে দিয়েছিল ডোমেদের খগেনের মা। চাঁচ বুনবে। চাঁচ অর্থাৎ দরমা। সকাল সকাল সেই পাতিয়া টেনে তুলছে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে।
তোলা শক্ত। যা মতিগতি খগেনের! ফাঁক পেয়ে এক সময়ে দৌড়ে এল পাঁইপাঁই করে দলে ভিড়তে— ‘‘আয় খগেন, আয়!’’
এই করে লাইন লম্বা হল। লম্বা হতে হতে এক সময়ে বাঁকা হল। আটানব্বইটি সিঁড়ি ভেঙে মন্দির-চাতালে উঠতে গেলে আর লাইন কি সোজা থাকে?
মন্দির-চত্বর জুড়ে ক্ষীরিভোগের গন্ধ তখন ম-ম করছে। ভকভক করছে। সেই গন্ধে কেউ কেউ ঢলে পড়ছে। পা ছড়িয়ে বসে পড়ছে সিঁড়িতে। দশ হাত বাই চার হাত সোপানে শোওয়া-বসার অসুবিধে নেই। শোও রে, বসো রে, নাচো রে, গাও রে! আজ তো স্বাধীন ভারত!
জামার বোতাম খুলে ছেঁড়া গেঞ্জির ফুটোয় ডান হাতের তর্জনী গলিয়ে, আরও বড় করছি। আর চোখ তুলে দেখছি, কত বেলা হল। এত উঁচু থেকে চার ধারের গা-গঞ্জ বড় ছোট দেখায়। রোদের দাপট নেই। ঘন কৃষ্ণ মেঘ উঠেছে আকাশে।
গিরীন স্যর কোত্থেকে দৌড়ে এসে আমার জামার বোতামগুলো গলা অবধি পটাপট আটকে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘বসো! বসে পড়ো, জলদি!’’
আমরা একে একে বসে পড়লাম। লাইন করে। পলেস্তারা করা প্রশস্ত চত্বর। মন্দিরের গর্ভগৃহের পরিসর এত ছোট যে, একসঙ্গে অত জনের জায়গা হওয়া কঠিন।
তার চাইতে এই বেশ। খুব স্বাধীন আবহাওয়া। মাথার উপরে মুখভার করে বসে থাকা আকাশ। ফুরফুরে বাতাস। আমাদের গ্রামের ঢ্যাঙা পরমথো পরিবেশন শুরু করলেন।
কলাপাতায় হাতা ভরে ঢেলে দিচ্ছেন ধোঁয়া ওঠা জাউ জাউ ক্ষীরিভোগ। মহা পায়সান্ন! পাতে পড়ামাত্রই দু’-এক জন শুরু করে দিয়েছিল হাপুস-হুপুস! কে যেন মানা করল। ‘‘উঁহু, একলা একলা কি! এক সঙ্গে, এক সঙ্গে। আগে সব পাতে দেওয়া হোক। তার পরে তো! পঙ্ক্তিভোজের আইন তো মানতে হবে।’’
আইন মোতাবেক শেষ পাতে মহা অন্ন পড়েছে, আর মহা বৃষ্টিটাও শুরু হল। কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি! অঝোরঝর! জলে জলময় কাণ্ড! খাড়া, তেরছা, আড়াআড়ি। যত রকম বর্ষণের ভাব আছে, ঝেড়ে গেল একে একে। জলে ধুয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে ক্ষীরিভোগ! কলাপাতা ছিঁড়ে আধ টুকরো। ওই ভেসে যায় কলার মান্দাস!
বৃষ্টির ছাট তেড়েফুঁড়ে এসে ঠেলা মেরে উঠিয়ে দিতে চায় পাত থেকে। উঁহু, অতই সহজ! আর আর ছাত্রছাত্রী বৃষ্টি পড়া মাত্রই দুদ্দাড় উঠে গেলেও, নাছোড় আমি। একা কেবল চালাক বনে গেলাম। দু’হাতে ছেঁড়া ফাটা কলাপাতা আগলে ধরছি, আর ততই বৃষ্টির তোড় এসে ফেঁড়ে দিচ্ছে।
‘‘উঠে আয় নলিন, উঠে আয়! অযথা ভিজিস না, ভিজিস না রে!’’ দু’তরফের হেডস্যর হাত নেড়ে ডাকছেন মুহুর্মুহু। উঠবার ইচ্ছে নেই একটুও। ঘাড় শক্ত করে, কাঁকড়ার দাঁড়া বিছিয়ে, ধুয়ে যাওয়া ক্ষীরিভোগ জড়ো করছি। উঠব কী, আমার একফোঁটাও খাওয়া হয়নি যে!
এর পরেও কম করে ছাপ্পান্নটি স্বাধীনতা দিবস পার করে এলাম। কত যে দুপইরা ফুটল আর ঝরে গেল! যেতে আসতে রাস্তায় ফুটপাতে স্বাধীনতার দিনে কোনও ভিখিরি মাকে, তাঁর বাচ্চাকে, পূর্ণ থালার সামনে হুমড়ি খেয়ে বসে থাকতে দেখলে ধক্ করে ওঠে বুকটা! মহা অন্ন ছুঁতে পারবে কি আদৌ? আচমকা উত্তুরে বান, দখনে খরা, উপর-নীচের হল্লাগাড়ি, এসে ঠেলা মেরে উঠিয়ে দেবে না?
বড় ভাবনা হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy