Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
AKSHAYA TRITAYA

অক্ষয় তৃতীয়ায় কোনও শুভকাজ করলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে

কোন কাহিনি যুধিষ্ঠিরকে শুনিয়েছিলেন শতানিক?

অক্ষয় তৃতীয়ায় গণেশ পুজোর চল রয়েছে গোটা বাংলায়। —ফাইল চিত্র।

অক্ষয় তৃতীয়ায় গণেশ পুজোর চল রয়েছে গোটা বাংলায়। —ফাইল চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২০ ১৭:০৫
Share: Save:

মহারাজ যুধিষ্ঠিরের মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে মহামুনি শতানিক তাঁকে শুনিয়েছিলেন সে কাহিনি।

তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু সিংহাসনে বসেও মনে শান্তি নেই মহারাজ যুধিষ্ঠিরের। যুদ্ধে এত প্রাণ গিয়েছে, বিপুল অপচয় হয়েছে সহায় সম্পদের। স্বামী, পুত্র, স্বজনহারা মানুষের কান্নায় ধর্মরাজ কাতর হয়ে পড়েছেন। এই পাপের বোঝা কে বহন করবে?

কোন কাহিনি যুধিষ্ঠিরকে শুনিয়েছিলেন শতানিক?

অনেক কাল আগে রাগী ও নিষ্ঠুর এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ব্রাহ্মণ হলে কি হবে? ধর্ম বিষয়ে তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। এক বার এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ক্ষুধার জ্বালায় তাঁর কাছে কিছু খেতে চাইলেন। কিছু দেওয়া দূরে থাক, সেই নাস্তিক ব্রাহ্মণ ভিখারি বলে গালমন্দ করে গরিব ব্রাহ্মণকে দরজা থেকেই তাড়িয়ে দিলেন। খিদে-তেষ্টায় কাতর সেই ব্রাহ্মণ অপমানিত হয়ে চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সে সময় তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়ালেন ব্রাহ্মণী সুশীলা। অতিথির কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বললেন, ‘ভরদুপুরে অতিথি রুষ্ট ও অপমানিত হয়ে ফিরে গেলে সংসারের অমঙ্গল হবে। গৃহের শান্তি-সমৃদ্ধি আর থাকবে না।’ দরিদ্র ব্রাহ্মণকে তিনি বললেন, ‘আপনি এখানেই অন্ন জল গ্রহণ করবেন। আপনার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ ব্রাহ্মণপত্নী অতিথি ভিক্ষুকের সামনে ঠাণ্ডা জল এবং অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করলেন। মধ্যাহ্ন ভোজন শেষে যাওয়ার আগে সন্তুষ্ট ব্রাহ্মণ সুশীলাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘তোমার এই অন্নজল দান হোক অক্ষয় দান।”

বহু বছর কেটেছে। সেই ক্রোধী ব্রাহ্মণ বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর মৃত্যু আসন্ন। তাঁকে নিয়ে যেতে হাজির একই সঙ্গে যমদূত ও বিষ্ণুদূতের দল। মৃত্যুর পর তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে এই নিয়ে বিবাদ শুরু হল দুই দল দূতের মধ্যে। এক দল তাঁকে বিষ্ণুলোকে নিয়ে যেতে চায়। অন্য দলের দাবি, ওই পাপী ব্রাহ্মণের একমাত্র স্থান নরক। এরই মাঝে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর ব্রাহ্মণ একটু জল খেতে চাইলেন। যমদূতেরা তখন ব্রাহ্মণকে অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে বললেন, ‘একদা তুমি তোমার গৃহ থেকে অতিথি ভিখারিকে জল না দিয়ে বিতাড়িত করেছিলে। সুতরাং তুমি জল পাবে না।’ তাঁরা ব্রাহ্মণকে নিয়ে যমরাজের কাছে নিয়ে গেলেন।

কিন্তু যম তাঁর দূতদের বললেন, ‘ওঁর মতো পুণ্যবান ব্রাহ্মণকে আমার কাছে আনলে কেন? বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে এই ব্রাহ্মণপত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্নজল দান করেছেন। এ দান অক্ষয়। স্ত্রীর পুণ্যে ইনিও পুণ্যাত্মা। সেই পুণ্যফলে ব্রাহ্মণের স্থান হবে স্বর্গে।’

কাহিনি শেষে শতানিক মুনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘মহারাজ, বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে ব্রাহ্মণকে অন্ন বস্ত্র জল দান করলে যাবতীয় পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। এবং সেই দানের পুন্য অক্ষয় হয়ে থাকে।’

সোজা কথায় অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি তিথি হল অক্ষয় তৃতীয়া। অক্ষয় শব্দের অর্থ হল, যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোনও শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। যদি ভাল কাজ করা হয় তার জন্য লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য। যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে অক্ষয় পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। তাই শাস্ত্রের নির্দেশ, এ দিনের প্রতিটি কাজ খুব সাবধানে করা উচিত। কোনও খারাপ কাজ, কোনও কটু কথা যেন মুখ থেকে না বের হয়। কোনও কারণে যেন কারও ক্ষতি না হয়। তাই এ দিন যথাসম্ভব মৌন থাকা জরুরি। পূজা, ধ্যান, দান বা অন্যকে আনন্দ দেওয়া উচিত। যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ করতে হয় সতর্ক ভাবে।

অক্ষয় তৃতীয়ায় বাড়ি বাড়ি মঙ্গলকামনার পুজোপাঠ চলে।

তবে শতানিক মুনির গল্পের শেষে আরও একটু আছে। বিষ্ণুলোকে পৌঁছনোর পরে ভগবান বিষ্ণু সেই ব্রাহ্মণকে বলেন, তাঁর স্ত্রী মাত্র এক বার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ব্রাহ্মণকে অন্নজল দান করেছেন। কিন্তু সেই দান বা ‘অক্ষয়ব্রত’ পর পর আট বার করতে হবে। তবেই অক্ষয় পুণ্যলাভ হবে। এই বলে বিষ্ণু ব্রাহ্মণকে কী ভাবে অক্ষয় ব্রত পালন করতে হবে তা বিশদে বলে ফের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে আরও সাত বার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে বিষ্ণু কথিত পদ্ধতিতে অক্ষয়ব্রত পালন করেন। এই ব্রতের প্রধান উপকরণ হল যব। শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে যব দিয়ে লক্ষী-নারায়ণের পুজো করে ব্রাহ্মণকে অন্ন, বস্ত্র, ভোজ্য, ফল ইত্যাদি দিয়ে বরণ করতে হয়। ব্রতীরা এ দিন যব দিয়ে তৈরি খাবার খান। এ পার-ও পার দুই বাংলাতেই এখনও এই দিনে সেই রীতি মেনে পালন করা হয় অক্ষয়ব্রত।

সধবা মহিলারা (এয়ো) সূর্য ওঠার আগেই নদীঘাটে ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, সিঁদুর, সরষের তেল প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে জড়ো হন। সূর্য এবং গঙ্গাদেবীকে আবাহন এবং পরিবারের মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে স্নান সম্পূর্ণ করেন। গোত্রভেদে কোনও কোনও পরিবারে ‘সরিষা ধোওয়া’ রেওয়াজের প্রচলন রয়েছে। এই সরষে দিয়ে কাসুন্দি তৈরি করা শুরু হয়। ক্রমশ কমে এলেও গ্রামবাংলায় এখনও এই ব্রত পালনের রেওয়াজ রয়েছে।

স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর ‘স্মৃতি তত্ত্বে’ অক্ষয়ব্রতের চারটি ভাগ করেছেন। অক্ষয়ঘট ব্রত, অক্ষয়সিঁদুর ব্রত, অক্ষয়কুমারী ব্রত এবং অক্ষয়ফল ব্রত। এই ব্রতগুলি চার বছর একটানা পালন করতে হয়। ব্রাহ্মণ থেকে কুমারী, সধবা, সর্বস্তরের মানুষকে জড়িয়ে অক্ষয়তৃতীয়া লৌকিক ধর্মাচরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

সেই পৌরাণিক যুগ থেকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যাচ্ছে। বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে ঘটা কিছু তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা একনজরে—১) এ দিনই বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম জন্ম নেন পৃথিবীতে। ২) রাজা ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন। ৩) সিদ্ধিদাতা গণেশ মহর্ষি বেদব্যাসের মুখে শুনে শুনে মহাভারত রচনা শুরু করেন। ৪) দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে। ৫) সত্যযুগ শেষ হয়ে ত্রেতাযুগের সূচনা হয়। ৬) কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। এ দিনই কুবেরের লক্ষ্মীলাভ হয়েছিল বলে এ দিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। ৭) এ দিনই ভক্তরাজ সুদামা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দ্বারকায় গিয়ে দেখা করেন এবং সখার আনা সামান্য চালভাজা খেয়ে শ্রীকৃষ্ণ দুঃখমোচন করেন। ৮) দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে যান এবং সখী কৃষ্ণাকে রক্ষা করেন শ্রীকৃষ্ণ। শরণাগতের পরিত্রাতা রূপে শ্রীকৃষ্ণ রক্ষা করেন দ্রৌপদীকে। ৯) এ দিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়। ১০) কেদার-বদ্রী মন্দির ছ’মাস বন্ধ থাকার পর এই দিনেই ফের খোলা হয় মন্দিরের দরজা। দেখা যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছ’মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল। ১১) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চন্দনযাত্রা শুরু হয় এই তিথিতে।

অক্ষয় তৃতীয়াকে ঘিরে সর্বশেষ সংযোজন, ব্যবসায়ীদের গণেশ পুজো বা নতুন খাতা। বাঙালি ব্যবসায়ীদের একটি অংশ অক্ষয় তৃতীয়াকে বেছে নিলেন পয়লা বৈশাখের বিকল্প হিসাবে। ক্রমশ সেই বিকল্প তিথি পেয়ে গেল আরও এক বাণিজ্যিক উৎসব মরসুমের তকমা। দোকানে হালখাতার উৎসবের পাশাপাশি ক্রেতাদের নানা রকম উপহার, অলঙ্কার ব্যবসায় নানা ‘অফার’, ছাড়, সব মিলিয়ে অক্ষয় তৃতীয়া যেন আবার নতুন করে ফিরে পাচ্ছে তার হারানো গৌরব।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy