কবে যে জীবন থেকে হারিয়ে গেল সেই হালখাতার অদ্ভুত দিনটা—ফাইল চিত্র
উত্তাল সত্তর। বরাহনগর। কলকাতার শেষ, ২৪ পরগণার শুরু। এ পাড়া কংগ্রেসের আর ও পাড়া সিপিএমের। মাঝে জয়শ্রী সিনেমা। রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের বোর্ডিং সিআরপিএফের দখলে। কিন্তু তবুও এ পাড়ার লোক ও পাড়ায় সিনেমা দেখতে যায়। শুধু ওই বোমাবাজির সময়টুকুই সব শুনশান।
এরই মাঝে গৌরকিশোর ঘোষ, বিমল কর, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তুষার রায়,সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়— বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রেরা আড্ডায় মগ্ন। ওই বরাহনগরেই। ব্যারলনের শার্ট বা বেলবটমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রীষ্মের দুপুরে গামছা কোমরে আদুল গায়ে ‘রোয়াকে’ বসে কলকাতার ঘনাদারা। সে এক বিচিত্র সময়।
আর সেই উত্তাল সত্তরে বৈশাখ আসত হালখাতায়, আর ‘এসো হে বৈশাখ’-এর প্রায়-সুরে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুসঙ্গে। প্রতি মাসের প্রথম তারিখ ছিল ছোটদের কাছে বহুকাঙ্খিত। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে থলে ঝুলিয়ে মুদির দোকান। স্থানীয় উচ্চারণে বরানগর বাজারে। তখন লোকে বলত মাসকাবারি। আজ মল আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসের যুগেও লোকে মাসকাবারি করে। কিন্তু মাসকাবারি শব্দটা বোধহয় এখনকার ভাষাসংশয়ী বাঙালির জিভে ব্রাত্য। আর ছিল ফর্দ। ফুলস ক্যাপ কাগজ লম্বা করে ছিঁড়ে রান্নাঘরের গোটা মাসের চাহিদাকে সুন্দর করে লিখতেন গৃহস্বামী।
মল কৃষ্টির অনেক বাঙালি ব্যবসায়ীর হালখাতার পুজো এখন বাড়িতেই সাড়া হয়।
মুদির দোকানে থাকত ডেস্ক, মালিকের সামনে। ছাদ থেকে ঝুলত কাপড়ে মোড়া দড়ি। আর ডেস্ক থেকে ওঠার সময় ওই দড়িই ছিল শরীর টেনে তোলার ভরসা। গায়ে গেঞ্জি অথবা ফতুয়া। প্রতিটি খদ্দেরের সঙ্গে নাড়ির টান। ফর্দ না-পেলেও বলে দিতে পারতেন কোন খদ্দেরের কী চাহিদা। “দাদা, সরষের তেল কম নিচ্ছেন কেন? ডাক্তারের বারণ হল নাকি?” খদ্দের অনেক সময়ই ভুল করতেন। কিন্তু দোকানির ভুল হত না।
আর ওই দোকানেরই হালখাতার দিন বদলে যেত ভোল। পাটভাঙা পাঞ্জাবিতে চেনাই যেত না মালিককে। খদ্দেরদের আমন্ত্রণ থাকত সপরিবার। কিন্তু যেতেন গৃহস্বামী, ছেলেমেয়ে-সহ। চারিদিকে পাটভাঙা কাপড়ের গন্ধ, দোকানে থাক থাক মিষ্টির প্যাকেট, আর বাঙলা ক্যালেন্ডার— কালীঠাকুর বা রামকৃষ্ণের ছবি। বছর শেষে ওই ক্যালেন্ডারই ঠাকুরঘরে ঝুলত। সময়ের প্রলেপে প্রায় পাপড় হয়ে। দোকানে পা রাখা যেত না। বাইরে ফুটপাতেই তাই বেঞ্চের উপর সাজানো থাকত আপ্যায়নের এই সব সামগ্রী। “খোকাকে দুটো প্যাকেট দে। আর কোল্ডড্রিঙ্ক দাদাকে বলে দিস।’’ কি খারাপ যে লাগত! কিন্তু ছোট হলেও স্নেহের স্বরটা ওই বয়সেও মন ছুঁয়ে যেত। আর সারা বছরের কালচে হয়ে যাওয়া কাপড়ে মোড়া খাতাটার আসল রংটা যে লাল তা জেনেছিলাম ওই রকমই এক দিন।
হালখাতা। ব্যবসার সারা বছরে হাল তো ধরা থাকবে ওই খাতাতেই। লাল রঙে মুড়ে। কবে যে জীবন থেকে হারিয়ে গেল সেই হালখাতার অদ্ভুত দিনটা। আমার সন্তান কোনওদিন মুদির দোকানে যায়নি আমার সঙ্গে। আমারও স্মৃতিতে আজ হালখাতার গন্ধ ধূসর। আগে সব খাতা-বইয়ের দোকানেই বছরভর মিলত লাল কাপড়ে মোড়া খাতা। এখন দেখি হালখাতার মলাটে বড় সংস্থার নাম। লাল শালুর খাতা আছে বটে, কিন্তু
সহজলভ্য নয়। আর ওই স্নেহ এখন হারিয়ে গিয়েছে কম্পিউটারের জটিল জালে।
মুদির দোকানে অবাক হয়ে দেখতাম মালিক কাকুর পেন্সিল নামছে ফর্দের উপর দামের গা-বেয়ে—সরীসৃপের মতো পিছলে, এক বারও না-থেমে। আর মুহূর্তের মধ্যে গোটা অঙ্কটা ফর্দের শেষে। এবং পেন্সিল কানে। এখন বড় দোকানে বার কোড স্ক্যান করে কম্পিউটারই করে দিচ্ছে বিল। তবুও ক্যালেন্ডার আসে। একেবারেই হারিয়ে যায়নি হালখাতা। শুধু বদলে গিয়েছে তার চরিত্র।
আগে সব দোকানেই আলাদা করে হালখাতা হত। পুজো হত পয়লা বৈশাখে বা অক্ষয় তৃতীয়ায়। হালখাতার দিনটাকে যে যে ভাবে মানতেন। কিন্তু মল কৃষ্টির অনেক বাঙালি ব্যবসায়ীর হালখাতার পুজো এখন বাড়িতেই সাড়া হয়। এক ব্যবসায়ীর কথায়: “মলে ঠিক হালখাতার পুজো করা যায় না। আর তা ছাড়া ক’জায়গায় বা দৌড়ই বলুন। তার থেকে দোকানপিছু এক সেট লক্ষ্মী আর গণেশ রেখে বাড়িতেই পুজো করিয়ে নিই।’’ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে হালখাতার রংও। শালুর জায়গায় মোটা মলাটের খাতা— ব্র্যান্ডেড।
কিন্তু তা-ও তো পুজো হয়। কিন্তু করোনা-কালে? দোকান বন্ধ। পাড়ার মুদির দোকানে আবার ভিড় ফিরেছে। আছে মিষ্টির দোকানও। তা হলে হালখাতা? হবে। যদি পুরোহিত জোটে। পাড়ার দোকানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিন ফুট দুরে দাঁড়িয়ে এক খদ্দের বললেন, “দাদা নতুন লিস্টে পুরোহিতের ছাড় নেই। এ ভাইরাস ঠাকুর মানে না!” হয়তো। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক যে সামাজিক সম্পর্কেরও অংশ তার সোচ্চার ঘোষণা হত হালখাতার দিনই। আর হয়তো তা ফিরবে না। কিন্তু বাংলা ক্যালেন্ডারটা পাওয়া যাবে বলে আশ্বাস পেয়েছি পাড়ার দোকান থেকে। আগের মতোই। পঞ্জিকা কিন্তু এখনও পাইনি লকডাউনের কারণে। এ বার হয়তো এটাও প্রথা ভেঙে খুঁজতে হবে নেটেই, লকডাউনে শেখানো অন্য অনেক কিছুর মতো। দিন তো যাবেই। লকডাউন ভেঙেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy