২২ নভেম্বর ২০২৪
একুশের সেরা ২১

অনন্যা

 অদিতি ঘোষ দস্তিদার
অদিতি ঘোষ দস্তিদার
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০৪
Share: Save:

‘‘শেষ বারের মতো প্রশ্ন করতাছি, মুচলেকা তুমি লিখবা কি না?’’

জেল গরাদের ও পাশে দাঁড়ানো উত্তরদাতার জানা আছে আত্মসমর্পণ না করার গুরুদণ্ডটি কী। ম্লান হাসি ফোটে মুখে। পর ক্ষণেই চোখে ঝলসে উঠল আগুন, তীব্র স্বরে এল সুস্পষ্ট উত্তর।

একটি মাত্র শব্দ, ‘‘না!’’

‘‘কী ভাবতেছেন! আপনি হইলেন আজ থেইক্যে মুক্ত!’’

জেলারের কথায় চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে যায় বন্দিনীর। মুক্তি! সে তো শুধু নিজের! আসল মুক্তি আসবে কবে? বেরিয়ে এলেন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্তা। হাতের ছোট পুঁটলিটা গিঁটবাঁধাই থাক! কী যেন গানটা মা গাইতেন, "অতীত দিনের স্মৃতি, কেউ ভোলে না কেউ ভোলে…।” কানে যেন স্পষ্ট মায়ের গলা, ‘‘গা না কল্যাণী, গলা মেলা আমার সঙ্গে!’’ কেন যে স্মৃতিমেদুরতা গ্রাস করে নিচ্ছে আজ খালি খালি! না! না! শক্ত হতে হবে! যে আদর্শের জন্যে নিজের সব কিছু বাজি রেখেছেন, আবার নতুন করে সেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কী ভাবে! চারদিক তো শুধু শূন্যতায় ভরা! পায়ে পায়ে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালেন মমতাজ বেগম। অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে ওই জেলখানা, কিন্তু আদর্শ নয়! বাইরে বিরাট পৃথিবী। কোথায় যাবেন মমতাজ? চেনা সব কিছুই তো নারায়ণগঞ্জে! না নেই, ছিল! স্বামী, সন্তান, স্কুলের চাকরি, প্রাণপ্রিয় ছাত্রীরা!

‘‘বড়দি!’’

কে ডাকে এ ভাবে এ জায়গায়?

‘‘ইলা!’’

রোগা মেয়েটি এসে পা ছোঁয়। বড় প্রিয় এই বড়দি, নারায়ণগঞ্জের মর্গ্যান স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা। একটা ঝড় এসে যেন সব ওলটপালট করে দিয়ে গিয়েছে!

‘‘কেমন আছ, কল্যাণী?’’

চমকের ওপর চমক! এগিয়ে আসছেন জাহানারা আপা, বড় স্নেহ করেন মমতাজকে। বাইরে কঠোর, কিন্তু কুসুমকোমল হৃদয় এই মহিলার!

‘‘আপনারা আসবেন আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি, আপা!’’

‘‘কী বলো কল্যাণী! যে নিজের জীবনের সবকিছু যে ত্যাগ করছে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেবার জইন্যে, তারে এটুক সম্মান আমরা দিব না?’’

‘‘কল্যাণী নামে কেন ডাকেন আপা! ও সব এখন অনেক জন্মের আগের কথা মনে হয়!’’

‘‘তুমি যে কল্যাণময়ী, তাই এই নামই তোমারে মানায়! আচ্ছা আর এতকথা বলার প্রয়োজন নেই, ওঠো গাড়িতে ওঠো!’’

রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ভাড়ার ট্যাক্সিটি চোখে পড়ে মমতাজের। উদাস ভাবে প্রশ্ন করেন, “কিন্তু আমার গন্তব্য যে নেই আপা!”

‘‘কে বলেছে! আমার বাসায় চলো, বাকি থাকা কাজ কইরতে হবে তো!’’

পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা শহর। দেশভাগের দগদগে ঘা বুকে নিয়েই ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি শুনেছে আর এক মর্মান্তিক ঘোষণা, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু। সহ্যের বাঁধ গিয়েছে ভেঙে। যারা ‘‘মুখের ভাষা যারা কাইড়্যা নিতে চায়’’ তাদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে মরণপণ আন্দোলন। মমতাজেরও মনে দগদগে দেড় বছর আগের সেই স্মৃতি। ১৯৫২ সাল। মাতৃভাষার জন্য লড়াই। মর্গ্যান স্কুলের তিনশো ছাত্রীকে নিয়ে চলছে মিছিল। একেবারে সামনে মমতাজ, ছাত্রীদের হাতে হাতে আর্টিস্ট মুস্তাফা মনোয়ারের কার্টুন আঁকা প্ল্যাকার্ড। মুখে স্লোগান। ইলাও শামিল সেই মিছিলে!

‘‘আমি তো কোনও বাইরের খবর পাইনি এই দেড় বছরে, তোকেও নিশ্চয়ই অনেক ঝড়ঝাপটা সইতে হয়েছে, না রে ইলা?’’

ইলা জবাব দেবার আগেই মুখ খুললেন জাহানারা, ‘‘পুলিশ তো আছেই অত্যাচারের জইন্যে! ইলার ওপরও আঘাত হানছে! কিন্তু তোমার ব্যথার কাছে সে যে নগণ্য বোন!’’

‘‘থাক না ওসব কথা আপা! এখন ভাবতে হবে কাজের কথা! আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, বাংলা ভাষার জন্য শেষ রক্তবিন্দুটি পর্যন্ত দিতে আমি প্রস্তুত!’’

কথা বলতে বলতেই চোখ পড়ল বাইরে। ঝকঝকে দিন. রাস্তার ধারের একটা বাড়ির গাছে দোলনায় দোল খাচ্ছে একটা বাচ্চা মেয়ে। চাপা অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এল বুকের পাঁজর ভেঙে বোধহয়! ‘‘খুকু!’’

জাহানারার চোখ ছলছল করে উঠল। কত কষ্ট যে বুকে চেপে আছে এই মেয়েটা! অথচ কী সুখের সংসার যে ছিল! একই ভাবনার ঢেউ উঠছিল মমতাজের বুকেও। সব ছেড়ে যার হাত ধরে অজানার পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন সে-ই এমনটা করল? তাহলে কি তাঁর নির্বাচনে ভুল ছিল?

‘‘এত নীচে যে মান্নান সাহেব নাইমতে পারবেন, আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি রে বোন!’’

‘‘ছাড়ুন না আপা, ওসব কথা। চেষ্টা করি ভুলতে, শুধু খুকুর মুখটা মনে পড়ে…’’, গলা ভেঙে আসে মমতাজের। ‘‘মান্নান সাহেবের কাছে নিজের চাকরিটাই বড় হইল? ওই নরপিশাচগুলোর দালালি করতে এতটুক বাইধল না ওনার! খুকুকে তো শুনছি করাচিতে পাইঠ্যে দিয়েছেন। তুমি জেলে যাবার পর দু’এক দিন দেখছিলাম ওনাকে। মুখ ফিরাইয়া চইল্যা গ্যালেন।’’

‘‘হ্যাঁ আপা, আমাকে শাসিয়েছিলেন জেলের মধ্যে, ‘মুচলেকা লিখে দাও যে তুমি আর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না, নয়তো তোমায় আমি তালাক দেব!’ জেলের মধ্যেই ভেঙে গেল সব, এত ঠুনকো ছিল আপা, এত ঠুনকো?’’

‘‘অথচ এনার জন্যে তুমি দেশ, পরিবার, ধর্ম সব ত্যাগ করেছিলে এক কথায়! সারা জীবনই তোমার লড়াই কল্যাণী!’’

ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের ভিতর থেকে। সত্যিই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই লড়াই। হাওড়ায় বাড়ি। বাবা মহিমচন্দ্র রায় হাইকোর্টের বিচারপতি, রায় বাহাদুর। অত্যন্ত রক্ষণশীল, স্ত্রী শিক্ষার পরিপন্থী। প্রাইভেটে পড়াশোনা করে কল্যাণী ম্যাট্রিক পাশটা করলেন যদিও মোটামুটি নির্বিঘ্নে, কিন্তু বিবাদ তুঙ্গে উঠল বিএ পড়ার সময়। ‘‘মেয়েদের কলেজে যাবার কী দরকার? জজ-ম্যাজিস্ট্রেট তো হবি না!’’

‘‘ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে, বাবা?’’

উদ্ধত আচরণের পুরস্কারের পাঁচ আঙুলের দাগ মেলাতে সময় লেগেছিল ক’দিন। তবে মামা এগিয়ে এসেছিলেন। প্রমথনাথ বিশী। স্বনামধন্য মানুষ। বেথুন কলেজে ভর্তি করে দিলেন, তাঁর বাড়িতেই থেকে লেখাপড়া, তার পর ব্যাঙ্কে চাকরি। তার পর প্রেম। মামাকে কি আর কোনওদিন দেখতে পাবেন? গাড়ির মধ্যে এখন সবাই চুপচাপ। নৈঃশব্দ্য ভাঙে ইলা, “আমরা অনেক চেষ্টা করছিলাম বড়দি, গোটা নারায়ণগঞ্জের মানুষ রুইখ্যা দাঁড়াইছিল!”

“কী জানো বোন, ওরা খুব ভয় পেয়েছিল তোমায়, তাই বন্দি করতে চেয়েছিল!”

মমতাজ এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন চাষাঢ়া মাঠের উত্তাল জনসভা। ভাষা নিয়ে আন্দোলন তো চলছিলই, কিন্তু সে প্রতিবাদ চরমে উঠল যখন এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছ’টি তাজা তরুণ প্রাণ পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়ার খবর। মরিয়া হয়ে জনসংযোগের জন্য ছুটে বেরিয়েছিলেন কলকারখানার, খনির শ্রমিকদের কাছে। কাজ হয়েছিল। ঘরের মা- বোনেরা বেরিয়েছিলেন শ’য়ে শ’য়ে, মুখে তাঁদের প্রতিবাদের গান, হাতে প্ল্যাকার্ড। “লক্ষ লক্ষ লোকের জমায়েত হয়েছিল তোমার একার চ্যাষ্টায় কল্যাণী, তাই ওরা তোমাকে তহবিল চুরির মিথ্যা অপবাদ দিইয়া জেলে ভরল!”

“কত লোক জামিনের টাকা নিয়ে তৈয়ার ছিলেন, কিন্তু জামিন তো হইলই না, ভয়ে ওরা আপনাকে ঢাকায় পাঠায়ে দিল! হাজার হাজার লোক রাস্তায়, গাছ কাইট্যা কাইট্যা ব্যারিকেড করছিলাম আমরা, তাও রুখতে পারলাম কই বড়দি!”

এত ভালবাসা আছে পৃথিবীতে? আর মমতাজ কিনা সেই একটি মানুষের দুর্ব্যবহারে নুয়ে পড়বেন! না কক্ষনও নয়! চোয়াল দৃঢ় হল। “শহিদদের রক্তের ঋণ কিন্তু আমাদের মাথার ওপর! জেলে একটি মুহূর্ত আমি শান্তি পাইনি! কিন্তু আবার শুরু করব কোথা থেকে আপা, না আছে অর্থবল, না লোকবল!”

“সব পাবা। আগে শরীরের যত্ন নাও, বিশ্রাম করো কিছু দিন। আমি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে তোমার কাজের ব্যবস্থা করছি। তোমাকে দেশের জইন্যে, ভাষার জইন্যে নতুন করে বাঁচতে হবে!”

ভেতরে ভেতরে যে বিরাট ক্ষয় হয়েছে তা বুঝছেন মমতাজ, তাই সময় বেশি নেই। মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় করার জন্য একটি মুহূর্ত নষ্ট করা চলবে না! মমতাজের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন জাহানারা আপা। জানেন সামনে তাঁদের দুর্গম পথ। লড়াই যে কত দীর্ঘ সেটা বোধহয় আন্দাজও করেননি সে দিন ভবিষ্যতের ‘শহিদ জননী!’

ইলার হাতটা চেপে ধরলেন মমতাজ। এরাই ভরসা, ভবিষ্যৎ! আলো ফুটবেই একদিন! গাড়ি এগিয়ে চলল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy