Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

মাস্টারনি

দেবের উচ্চারণ-সতর্কতা। অপর্ণার ম্যাজিক। কঙ্কনার বুদ্ধিমত্তা। খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের অভিনয় শেখানোর দিদিমণি সোহাগ সেন। মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়আমি আসলে টেকনিশিয়ানদের দলের লোক। যাঁদের নাম কেবল ইন্ডাস্ট্রি জানে, ভাল কাজের জন্যে তাঁদের সম্মানও করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁদের জানেন না। আমার কাজ দিয়ে তাঁরা কোনও দিনই চিনবেন না আমায়। জনসাধারণ জানবে অভিনেতারা ভাল অভিনয় করেন। খুব জোর ভাববে, এটা পরিচালকদের মুন্সিয়ানা।

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:১১
Share: Save:

ইন্ডাস্ট্রির দিদিমণি হয়ে সম্মান পেলেও সে ভাবে খ্যাতি পেলেন না কেন?

আমি আসলে টেকনিশিয়ানদের দলের লোক। যাঁদের নাম কেবল ইন্ডাস্ট্রি জানে, ভাল কাজের জন্যে তাঁদের সম্মানও করে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁদের জানেন না। আমার কাজ দিয়ে তাঁরা কোনও দিনই চিনবেন না আমায়। জনসাধারণ জানবে অভিনেতারা ভাল অভিনয় করেন। খুব জোর ভাববে, এটা পরিচালকদের মুন্সিয়ানা।

একটা কড়া মাস্টারমশাইয়ের ইমেজ। চাইলে যে কাউকে দিয়েই তো অভিনয় করিয়ে নিতে পারেন?

আমি জানি না কেন সবাই আমায় ভয় পায়। আমি মানুষটা কিন্তু খারাপ না। তবে সবাইকে দিয়ে অভিনয় করানো যায় না। কিছু অন্তত ‘এলিমেন্ট’ থাকতে হয়। সেটাই বের করে আনার চেষ্টা করি। কিছু মানুষের অভিনয় করার সামর্থ্যই নেই। তারা দেখতে ভাল, বুদ্ধিও আছে। কিন্তু অভিনয়টা জানে না, আর কোনও ভাবে বোঝানোও যায় না। তার মানে যে তারা বোকা, এমনটাও বলছি না।

সে রকম কোনও অভিজ্ঞতা?

সে রকম অভিজ্ঞতা তো আছেই। কিন্তু যাঁদের সঙ্গে হয়েছে, তাঁদের নাম তো কখনওই করব না। আসলে অভিনয় শেখানোর মধ্যে একটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক আছে। অভিনেতাদের ‘সাইকি’ বুঝে কাজ করতে হয়। আমি একতরফা দিয়ে গেলাম, তা হলে কিন্তু হবে না।

এই দেওয়া-নেওয়ার ধারায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন?

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অসম্ভব ডেডিকেটেড। সব কিছুই নখদর্পণে। এখন অনেকে বলেন ছবি বিশ্বাস অতি-অভিনয় করতেন। আমি এটা কখনওই মানি না। তখন ও ভাবেই সংলাপ বলা হত। ওটাই সে যুগের চাহিদা ছিল। প্রসেনজিতের ক্ষেত্রেও তাই। দর্শক যা চেয়েছে, প্রসেনজিৎও সেখানেই নিজেকে একশো ভাগ দিয়েছে। অভিনয়ের ধারা এখন পাল্টেছে, সেটা প্রসেনজিৎ বুঝেছিল। তখন ও চেঞ্জটা চাইল। প্রথম দিকে একটু আঁটোসাঁটো ছিল। প্রায় জেনেটিক মেমরি তো!

কিন্তু স্টার ব্যাগেজটাকে বাদ দিতে কি উনি পেরেছিলেন?

অবশ্যই। ওর সঙ্গে বোঝাপড়া, বিশ্বাসটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে পরিচালক শট ‘ওকে’ করলেও আমি যতক্ষণ না ‘হ্যাঁ’ বলতাম, ও শট রিটেক করত। এতটাই বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে ভাঙতে পেরেছিল।

শুনেছি ‘বুনো হাঁস’-এ দেব-এর অভিনয়ের আপনি প্রশংসা করেছেন? কিন্তু এখনও তো সংলাপ বলা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে দেবের সমালোচনা হয়?

দেবকে কোনও দিন হাতে ধরে কেউ শেখায়নি। ওর কোথাও ভুল আছে কি না সেটাও জানায়নি। একমাত্র আমিই বলি: ‘কী বললি, বুঝলাম না’। আসলে বলার দরকারও পড়েনি। ও যা বলে তাই তো লোকে নেয়, চায়। তবে উচ্চারণ নিয়ে ও খুব সতর্ক। ওকে সময় দিতে হবে।

কোন অভিনেতা চরিত্রটা বুঝে নিতে অনেক সময় নেন?

একই অভিনেতা একেক সময় একেক ভাবে রিঅ্যাক্ট করেন। এটা এতটাই প্র্যাক্টিক্যাল ব্যাপার, বলে বোঝানো যায় না। তবে অরিজিৎ দত্তকে দিয়ে অভিনয় করাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাই আমি। এত ছটফটে, দুষ্টু ও। ওকে খুব ভালবাসি। কিন্তু বলেও দিয়েছি ওকে দিয়ে অভিনয় করাতে হলে আমি এক কোটি টাকা নেব।

শুধুই কি চরিত্রনির্ভর ছবি? মূলধারার ছবির জন্যও তো কখনও আপনাকে কাজ করতে দেখা যায়নি। এটা কেন? সেখানে কি অভিনয় শেখাতে হয় না?

দ্যাট’স নট মাই কাপ অফ টি। আমি ও রকম ছবি বসে দেখবও না কখনও। এমনকী ‘হরর’ ফিল্ম নিয়েও কাজ করার কথা ভাবতে পারি না আমি।

কিন্তু এই ধারার ছবির বাজার তো তুঙ্গে...

একদম। কোটি কোটি মানুষ দেখছে তো সেটা। সেখানে অভিনয়ের একটা বড় জায়গা তো আছেই। কিন্তু ওই ধারার ছবিগুলো ঠিক আমার টাইপ নয়।

কিন্তু মূলধারার ছবির অভিনেত্রী যখন আপনার টাইপের ছবি করতে আসছেন, যেমন ধরুন ‘গয়নার বাক্স’-র শ্রাবন্তী, ওঁকে নিয়ে কাজ করতে অসুবিধে হয়নি?

আসলে অপর্ণা সেন-এর একটা ম্যাজিক আছে। ওর ধৈর্য কম, কিন্তু লুকটা এমন একটা করে দেয় যে চরিত্রটা হুবহু ও রকম দেখতে হয়ে যায়। আর অপর্ণার সংলাপ অসম্ভব চরিত্র-উপযোগী। সেখানে ভিতর থেকেই অভিনয়টা বেরিয়ে আসে। ওখানেই তো একজন অভিনেতা পঞ্চাশ নম্বর পেয়ে গেলেন।

তা হলে আপনি বলতে চাইছেন শ্রাবন্তী নয়, অপর্ণা সেনই শ্রাবন্তীর অভিনয়কে এগিয়ে দিয়েছেন?

নাহ্, ফাইনালি যা হয় সেটা অভিনেতারই সাফল্য। আমরা কাজের প্রেক্ষিতটা তৈরি করে দিই। শ্রাবন্তী প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিল। অপর্ণা সেন, আমি, তার ওপর কঙ্কনা, যাকে ও হিউজ স্টার ভাবে, যদিও কঙ্কনা খুব ডাউন টু আর্থ, এবং মৌসুমী।

এত কিছুর মাঝেও কিন্তু শ্রাবন্তী ভাল কাজ করেছিল। আসলে অভিনয় করার ইচ্ছেটা ওর মধ্যে প্রবল। তবে লুকটাও ম্যাটার করে। ঋতুপর্ণার চেহারাটা মনে আছে ‘পারমিতার একদিন’-য়ে? ওই লুকটা তো অপর্ণার করা।

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

প্রচুর খাটতে পারে। ‘পারমিতার একদিন’-য়ে রজতাভ আর ওর মধ্যে যে টেনশন, সেটা আমরা ওয়ার্কশপের মধ্যে করিয়েছিলাম। যে দৃশ্যগুলো ছবিতে ছিল না, সেগুলো করাতাম। যাতে ওই অভিনয়ের হিস্ট্রিটা কাজে লাগিয়ে অভিনয়টা জোরদার হয়। যখন দেখতাম ঋতুপর্ণা কোথাও একটু অফ হয়ে যাচ্ছে, তখন আমি শুধু শটের আগে বলতাম “ঋতু, বাচ্চাটা তোর” ব্যস! পরে শুনেছি ‘পারমিতার একদিন’ করতে করতে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’য়েরও শু্যটিং করত রাতে। আর দুটো ছবিই হিট হয়েছিল। খুব মজা করে বলা হত একটা শট দিয়ে তো ঋতুপর্ণা বাংলাদেশ গিয়ে সেখানে কাজ করে আবার ফিরে আসে।

ইন্ডাস্ট্রিতে এও তো শোনা যাচ্ছে যে আপনি খুব প্রাইসি হয়ে যাচ্ছেন?

এটা তো আমার নাম ও কাজের বদনাম।

আগে কি অভিনয়ের ওয়ার্কশপ হত না?

হ্যাঁ হত। তবে ওয়ার্কশপ নাম ছিল না। ছবি তৈরি করার ক্ষেত্রে এখন কাজ ভাগ হয়ে গিয়েছে। আসলে আমাদের দেশে আজও একটা অদ্ভুত ধারণা আছে যে অভিনয়টা একজন পরিচালক শেখান। সেটা কিন্তু ভুল। পরিচালক গল্পের ছবিটা আঁকবেন।

যাঁরা অভিনেতা, তাঁরা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করবেন। পরিচালক হাতে ধরে অভিনয় শেখাবেন কেন? অবশ্য আজও বেশির ভাগ পরিচালক এই জায়গাটা ছাড়তে চান না!

এখন টিভি সিরিয়ালের অভিনয়ের জায়গাটা কেমন?

সিরিয়াল অত্যন্ত ‘ইন্টিমেট মিডিয়াম’ হলেও সেখানে অভিনয়টা ‘ইন্টিমেট’ হচ্ছে না। টিআরপি নির্ভর গল্পের টার্গেটই হচ্ছে গ্রাম-মফস্সলের দর্শক। সেখানে যে ধরনের ইমোশন ব্যবহার করে অভিনয় করতে বলা হয়, যে রকম সংলাপ থাকে তাতে একজন অভিনেতাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। প্রচুর লোক এই মিডিয়ামে কাজ করছে, এটার চাহিদাও প্রবল। কিন্তু সিরিয়ালের অভিনয় ‘ভাল’ অভিনয় বলে মানতে পারছি না।

রেনোয়াঁ থেকে রসোলিনি, ঋত্বিক থেকে সত্যজিৎ— আপনাদের বাড়িতে আসতেন। তখনকার সেই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আজকের ইন্ডাস্ট্রিকে মেলাতে পারেন?

মেলাতে তো আসিনি আমি। তবে আই অ্যাম নট স্টার-স্ট্রাক। আমি দেখেছি আমার বাড়িতে হরিসাধন দাশগুপ্ত খাটের তলায় লুকিয়ে। আর ঋত্বিক ঘটক তাঁর ক্যামেরা নিয়ে পালাচ্ছেন! এখন কি আমি ভাবতে পারি অনিরুদ্ধ (রায় চৌধুরী) আর সৃজিত (মুখোপাধ্যায়) প্রকাশ্যে এ রকম করবে? এখন ইন্ডাস্ট্রির কেউই ইমোশনকে বাইরে আনতে পারবে না। তখন পারত কারণ, নিজেকে আলাদা করে প্লেস করার দায় তো ছিল না এখনকার মতো।

সোহাগ-প্রিয়

পরিচালক

• অপর্ণা সেন • বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত • গৌতম ঘোষ

ছাত্রী

• কঙ্কনা সেন শর্মা

• রাইমা সেন

• কোয়েল মল্লিক

ছাত্র

• প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়

• আবির চট্টোপাধ্যায়

• ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

আপনার নিজেকে প্লেস করার দায় নেই? আপনার সাক্ষাৎকারও কোথাও পড়িনি।

আমি তো সাক্ষাৎকার দিতে চাই না। নিজের সম্পর্কে কথা বলতে একদম পছন্দ করি না আমি। সেই কারণেই কেউই জানে না যে টানা একত্রিশ বছর ধরে আমি নাটক করছি। ঢাক পিটিয়ে বলতে পারিনি এ সব।

আপনার নতুন নাটকের কথা বলুন না...

এটার নাম ‘হায় হায়া’। দ্রৌপদীর সভাপর্বর কিছু অংশ, মহাশ্বেতা দেবীর ‘দোপদী’-র আধারে, আজকের দিনের ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে এই নাটক। আর নাটকের একটা চমৎকার ইউটোপিয়ান এন্ড আছে। আমি কোনও স্পনসরশিপও পাই না, বলতেও পারি না। জানি এটা বললে আজকের দিনে, ন্যাকামো ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। নাটকে আমার মতো মানুষের বেঁচে থাকাটাই সমস্যার। কোনও মতে এখনও টিকে আছি!

নতুনদের জন্যে টিপস্

মনটাকে শিক্ষিত এবং সজাগ রাখা। শুধু মেথড থাকলেই হবে না। সব কিছুকে পর্যবেক্ষণ করা। উচ্চারণ এবং কণ্ঠস্বরের ওঠানামার দিকে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এটা বেশির ভাগ অভিনেতারই থাকে না। নিয়মিত ভাল ছবি দেখা, ভাল বই পড়া। রক্ষণশীলতা বাদ দিয়ে অভিনয় করতে আসা। আড়ষ্টতা একজন অভিনেতার সব চেয়ে খারাপ দিক।

এত অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ছবির জন্য তৈরি করেন। কিন্তু নিজে ছবি করবেন না?

করব তো। আমারই চিত্রনাট্যে ছবি। নাম ‘উমা’। কঙ্কনার সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে।

কঙ্কনাকে অভিনয় শেখানোর অভিজ্ঞতা কেমন?

ও খুব বুদ্ধিমতী। কী চাইছি সেটা চট করে বুঝে যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

sohag sen srabonti bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy