সেদিন বাড়িতে বসে খেলা দেখছিলাম। হঠাত্ দেখলাম একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে সেন্ট জন্স উডস্-এর বিখ্যাত সেই মাঠে।
রবীন্দ্র জাডেজা বল করছে এবং সব ক্রিকেটীয় লজিককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধোনি স্টাম্পসের ঠিক পিছনে নয়, দাঁড়িয়েছে আরও একটু পিছনে।
প্রায় সব কমেন্টেটর শুনলাম রইরই করে উঠছেন। কিরমানি, ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারের কী রই্যাকশন হয়েছিল, সেটা অন্য এক দিনের জন্য তোলা থাক।
একজন কমেন্টেটর তো বলেই ফেললেন, “জাডেজা কি স্পিনার না ইন-কাটার বোলার যে ধোনি পিছিয়ে গেল?”
পর দিন টেস্ট শেষ হওয়ার পর মাইকেল আথারটন যখন ধোনিকে জিজ্ঞেস করলেন এমন করার পিছনে ওর ভাবনা কী ছিল, ধোনির উত্তর শুনে আমি অত্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।
“মইন আলি অফ স্টাম্পের বাইরে ফ্ল্যাশ করছিল। আগের দিন ব্যাটের পিছনে লেগে একটা ক্যাচও উঠেছিল যেটা আমি ধরতে পারিনি। তাই ভাবলাম একটু পিছিয়ে দাঁড়ালে হয়তো সুবিধে হবে।”
আমার কাছে ধোনির এই স্টেটমেন্টটা যুগান্তকারী। কোনও দিন কিরমানি কী ইঞ্জিনিয়ার এ রকম করেননি। পৃথিবীর কোনও কোচ, কোনও উইকেট কিপারকে আজ অবধি এটা বলেননি।
কিন্তু অলিখিত এই নিয়ম, যে স্পিনার হলে উইকেট কিপারকে স্টাম্পসের পিছনে দাঁড়াতেই হবে সেই নিয়মটা ভাঙল কে?
ভাঙল এক ভারতীয় টেস্ট ক্যাপ্টেন। কোথায় ভাঙল? ব্রিটিশ রক্ষণশীলতার সেরা বিজ্ঞাপন, এমসিসির আঁতুড়ঘর লর্ডসের মাঠে।
এবং এখানেই ধোনি জিনিয়াস।
আমার মতে ভারতীয় ক্রিকেটে যদি ধোনির একটা প্রশংসা সোনার অক্ষরে করতেই হয়, তা হলে সেটা হবে ‘প্র্যাক্টিক্যাল জিনিয়াস’।
ধোনির সঙ্গে মিঁয়াদাদের অনেক মিল
অনেক সময়ই জানেন, ধোনির সঙ্গে পাকিস্তানের জাভেদ মিঁয়াদাদের মিল খুঁজে পাই। দু’জনেই স্ট্রিট ফাইটার। দু’জনেই স্ট্রিট স্মাটর্। দু’জনের খেলা দেখলেই মনে হয় খেলাটা পাড়ার কোনও মাঠে হচ্ছে। আর লর্ডস টেস্ট ম্যাচের শেষ দিনটাকে তো প্রায় পাড়ার মাঠের স্তরেই নামিয়ে আনল ধোনি।
কখনও শুনেছেন ভারতের কোনও ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ঘাসে ভরা পিচে বোলারকে বাউন্স করতে বলছে? ছোটবেলা থেকে আমাদের যে বোঝানো হয়েছে উইকেটে ঘাস থাকলে বাউন্স না, ‘পিচ ইট আপ’।
ধোনি কিন্তু এই সব বস্তাপচা ধ্যানধারণাকে টেমস নদীতে সেদিন ছুড়ে ফেলে দিল সারা জীবনের জন্য।
বাউন্স করেও যে ম্যাচ জিততে পারে ও ইশান্তকে দিয়ে, সেটা করে দেখাল।
কিন্তু এ রকম ‘প্র্যাক্টিক্যাল জিনিয়াস’ হওয়া সত্ত্বেও আমি ধোনিকে ‘গ্রেট ক্যাপ্টেন’ আখ্যা দিতে পারব না।
হ্যাঁ, টি টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে ক্রিকেটে ধোনি গ্রেট। অনেক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তাঁদেরও একই কথা। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে ও গুড ক্যাপ্টেন। অনেক সময়ই ধোনির ক্যাপ্টেন্সি দেখে আমার রাগ হয়েছে।
যখন অপোজিশন ১৫০/৬, সেই সময়ও দেখেছি ও ডিপ কভার কী ডিপ মিড উইকেটে ফিল্ডার রাখছে। কোনও গ্রেট টেস্ট ক্যাপ্টেন এটা করে না।
অথচ গ্রেট না হয়েও ধোনি পার পেয়ে যায় কী করে? পার পেয়ে যায় কারণ, ওই যে বললাম, ওর মতো প্র্যাক্টিক্যাল ক্রিকেটার এর আগে আসেনি ভারতীয় ক্রিকেটে।
ধোনি ‘ওভার কোচড’ হয়নি
আমার ছোটবেলা মুম্বইতে কেটেছে। আশেপাশে বাসু পরাঞ্জপে, পলি কাকা (উমরিগড়), মাধব মন্ত্রীর মতো কোচেদের দেখেছি। এবং সে জন্যই বোধহয় অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন ধোনির এই প্র্যাক্টিক্যাল অ্যাপ্রোচ দেখে ওই রকম কপিবুক কোচেরা কী বলতেন।
এটার উত্তর দিতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হয়। ভারতীয় ক্রিকেট সব সময়ই দু’টো স্কুলে বিভক্ত।
একটা মার্চেন্ট-হাজারে স্কুল অব ব্যাটিং। এই স্কুলের সবচেয়ে ভাল ছাত্রের নাম সুনীল গাওস্কর। এদের কাছে বাঁ-কনুই সোজা থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা টেকনিক। এদের কাছে কভার ড্রাইভ মাটি থেকে একটু না ওঠা চাঁদ-সূর্যের প্রতিদিন ওঠার মতোই স্বাভাবিক।
এদের পাশাপাশি আরও একটা স্কুলও কিন্তু ছিল ভারতীয় ক্রিকেটে।
আমি সেই স্কুলটার নাম দিয়েছি সিকে নায়ডু-মুস্তাক আলি স্কুল অব ব্যাটিং। এরা সেই সময় স্টেপ আউট করে খেলতেন। মাঝেমধ্যেই বাঁ-পা না বাড়িয়ে ড্রাইভ করতেন, ক্রস ব্যাটে বলে বলে ছয় মারতেন। এই স্কুলের সবচেয়ে বড় ক্রিকেটারের নাম বোধহয় কপিল দেব।
এবং এই দুই স্কুলের সবচেয়ে ভাল মিশ্রণ যাঁর মধ্যে ছিল, তিনি বোধহয় গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ।
এ বার যদি সেই প্রশ্নে ফিরতে হয়, তা হলে আমার ধারণা বাসু পরাঞ্জপেরা হয়তো ধোনিকে ওই অন্য স্কুলের ছাত্র হিসেবেই দেখতেন।
এবং মুম্বই ঘরানার লোক হয়েও আমি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, মুম্বইতে যে ক্রিকেটাররা তৈরি হয়েছে ৬০, ৭০ আর ৮০-র দশকে, তারা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ‘ওভার কোচড’ হয়েছে।
অতটা না হলেও কপিল দেবের কোচ দেশপ্রেম আজাদও যথেষ্ট কোচিং করাতেন তাঁর ছাত্রদের।
সে দিক থেকে ৯০-এ ক্রিকেট খেলা শুরু করা ধোনি কিন্তু ‘ওভার কোচড’ হয়নি। এটা ওর বিরাট অ্যাডভান্টেজ। ও টেকনিক নিয়ে ভাবে না। ও কপিবুক নিয়ে খুঁতখুঁতে নয়। কনুই সোজা থাকবে এটা ধোনিকে কোনও কোচ বললে ও পরের বলে হেলিকপ্টার শট খেলে সেই কোচকে চমকে দেবে। এটাই ওর অ্যাটিটিউড।
ওর টিম ওরই প্রোটোটাইপ বহু সময়ই ধোনিকে দেখে আমার মনে হয়েছে ও প্লেয়ার নির্বাচন করা নিয়ে পক্ষপাতিত্ব করে।
বহু বার মনে হয়েছে শুধু নিজের লোক বলে ও রবীন্দ্র জাডেজাকে টিমে খেলিয়ে যাচ্ছে। এটাও মনে হয়েছে, ওর আর সুরেশ রায়নার এজেন্ট এক বলে বারবার রায়না টিমে চান্স পেয়ে গিয়েছে।
হয়তো এগুলো সত্যিও। কিন্তু এর বাইরে যদি বিগার পিকচারটা দেখতে হয়, তা হলে আমি বলব এই ক্রিকেটারদের ধোনি পছন্দ করে কারণ ওরাও মানসিক ভাবে ধোনির মতো।
ওরা ধোনির প্রোটোটাইপ।
ওরাও নিজেদের টেকনিকের দাস করেনি। হেলিকপ্টার শট দেখলে বাকিদের যদি ভয় করে, ওরা হাই-ফাইভ মেরে সেটা এনজয় করে।
ওরা টেস্ট ম্যাচে অনায়াসে কভারের উপর দিয়ে চার-ছয় মারতে পারে। দরকার পড়লে দু’টো গালাগালিও দিয়ে দিতে পারে অপোজিশন ফাস্ট বোলারকে (পড়ুন জেমস অ্যান্ডারসনকে)।
আমার বদ্ধমূল ধারণা ধোনি এই পার্টিকুলার গোত্রের প্লেয়ারদেরই বেশি পছন্দ করে। এবং এদের এতটাই ব্যাক করে যে তারা ক্যাপ্টেনের জন্য নিজেদের জীবন দিতে প্রস্তুত।
এটাই তো ভাল লিডার, ভাল ক্যাপ্টেনের সবচেয়ে বড় লক্ষণ।
ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারকে চেনে না
তবে জানেন, আমার মতো অনেক ‘পিউরিটান’ আছে, যাদের ইতিহাসের প্রতি ওর অবহেলাটা ভাল লাগে না।
মানে আমি নিশ্চিত, লর্ডসের লং-রুম দিয়ে হাঁটার সময় ধোনি বা রবীন্দ্র জাডেজার বুকের ভিতর কোনও আবেগ কাজ করে না।
ওরা লর্ডসে এমসিসি মেম্বারদের সামনে অনায়াসে হিন্দিতে খিস্তিও মারতে পারে। লর্ডসের লাঞ্চ রুমে চামচ ছেড়ে হাত দিয়ে ফিশ অ্যান্ড চিপস্ খেতে পারে। কে কী ভাবল, তা নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।
শুধু কি তাই, ইতিহাসের প্রতি ওদের এতটাই অবজ্ঞা যে আমাদের এক সাংবাদিককে (তখন আমি সিএনএন-আইবিএন-য়ে গ্রুপ এডিটর ছিলাম) ধোনি বলেছিল ও ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারকে চেনেই না।
ইতিহাস সম্পর্কে এই উদাসীনতা যেমন দুঃখের, এটা বোধহয় ধোনির ক্ষেত্রে একটা বড় অ্যাডভান্টেজও।
এর জন্যই ধোনির ক্রিকেটে কোনও লাগেজ নেই।
বাবার সঙ্গে মিল পাই
অনেকেই জানেন আমার বাবা দিলীপ সরদেশাই ছিলেন গোয়ার মানুষ। গোয়ার ছেলে হিসেবে একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটও খেলেছেন আমার বাবা-ই।
সে দিক থেকে দেখতে গেলে বাবার সঙ্গে আমি ধোনির মিল পাই। ধোনিও ঝাড়খন্ডের প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার।
আমার বাবার আমলে মনসুর আলি খান পটৌডি অনায়াসে ইংরিজি বলতে পারতেন। আমার বাবা এক বর্ণও পারতেন না। বাবা কোনও ইংরেজি স্কুলে যাননি। কিন্তু নিজের খেলা, নিজের ব্যাটিংয়ের উপর একটা অদ্ভুত ভরসা ছিল।
ধোনি যখন টিম ইন্ডিয়াতে ঢুকল, তখন সৌরভ-দ্রাবিড়রা রয়েছে।
ওরা অনর্গল ইংরিজি বলতে পারে। মিডল ক্লাস হলেও সৌরভ-দ্রাবিড়ের এক্সপোজার রাঁচির ধোনির থেকে অনেক বেশি।
সেখান থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের মধ্যগগনে ধোনি পৌঁছেছে শুধুমাত্র নিজের ক্রিকেটীয় দক্ষতার উপর ভরসা করে।
এবং এই গুণটার জন্যই আমার কাছে নতুন ভারতের প্রতীক মনে হয় ধোনিকে। এই নতুন ভারত ইংরিজির তোয়াক্কা করে না, শহুরে আচার আচরণকে মানে কিন্তু তা নিয়ে আদিখ্যেতা করে না। তারা জানে তাদের মধ্যে এমন আগুন আছে, যা দিয়ে শহুরে ছেলেদের অনায়াসে তারা পিছনে ফেলে দিতে পারে।
ইস্, আর একটু খেলল না কেন ধোনি
কাজ করার সময় বহু বার বহু সাংবাদিককে আমি ধোনির উদাহরণ দিতাম। অনেকেই আমাকে এসে বলত আমরা ইংরিজি জানি না, আমরা পারব তো জার্নালিজমে নাম করতে? আমি ওদের বলতাম ধোনিকে দেখে শেখো।
এদের বলতাম শুধু খবর আনার প্যাশনটা যেন তোমাদের থাকে, যেমন প্যাশন ধোনির ক্রিকেটের প্রতি রয়েছে। ওটা থাকলেই যথেষ্ট। পাবলিক স্কুলের দরকার নেই। নাম তুমি করবেই। যেমন ধোনি করেছে।
সে দিক থেকে দেখতে গেলে সত্যি অনেক ভাবেই ধোনি আমাদের জীবন নানা ভাবে এই দশ বছরে ছুঁয়ে গিয়েছে।
আমার নিজের ধারণা, পরের বছর ওয়ার্ল্ড কাপ-এর পর ও বোধহয় ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেবে বিরাট কোহলির জন্য।
আর কবে রিটায়ার করবে? ওই যে আগেই বললাম, ধোনি হচ্ছে ‘প্র্যাক্টিক্যাল জিনিয়াস’। দেখবেন যখন ও রিটায়ার করবে, তখন আমরা সমস্বরে বলব, “ইস্, আর একটু খেলল না কেন ধোনি!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy