সুজি ভৌমিক।
প্রতি বছর নারী দিবস মনে করায়, আমি ‘হয়ে ওঠা নারী’। ‘সুজয়’ থেকে ‘সুজি’ হব বলে কত কী সহ্য করেছি! সেই আমিই নাকি 'প্রকৃত নারী' নই!
বুঝিবে তখন.. নারীর বেদন...
বহরমপুরে আমার জন্ম। বাবা বটানির অধ্যাপক। আমার এক ভাইও আছে। যন্ত্রণার শুরু ছোট্ট বেলা থেকে। যে দিন থেকে বুঝতে শিখেছি, পুরুষের খোলসে আমার মধ্যে এক নারী বাস করে। সবাই বলত, "তুই একদম মেয়েদের মতো। মেয়েলি পুরুষ।" শুনে লজ্জা পেতাম। আর অবাক হয়ে ভাবতাম, আমি তো এ রকমই! আমার মধ্যে আলাদা করে মেয়েই বা কী আর ছেলেই বা কী!
কোনও দিন মনে হয়নি, দাড়ি কাটব। পুরুষের অন্তর্বাস পরব। মা যখন মেয়েদের অন্তর্বাস কিনতেন, জুলজুল করে তাকিয়ে দেখতাম। শখ হত ওগুলো পরার। মনে আছে, স্কুলের শেষ পিরিয়ডে দিদিমণিরা বলতেন, তোমাদের ইচ্ছেমতো কিছু কর। আমি ‘বেদের মেয়ে জোৎস্না’ নাচতাম! ক্লাসের বাকি ছেলেরা কিন্তু তাদের যা মানায়, সেটাই করছে।
ক্লাস সেভেনে স্কুলেরই এক শিক্ষকের প্রেমে পড়লাম। পাশাপাশি, এক সহপাঠীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হল। মনে আবারও দ্বন্দ্ব। এ বার ভয় গিয়ে ভাবনা এল, আমার বোধ হয় অসুখ করেছে! শিক্ষকের নজর কাড়তে আঙুলে নেলপলিশ পরছি। স্কুলে কী করে মেয়েদের পোশাকে নিজেকে সাজাব? আশা, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তা আর হয় কই? দিন যায়। আমিও মেয়ে হয়ে উঠতে আরও বেশি ছটফট করি। পাড়ার দিদিরা আই ব্রো করতে পার্লারে যেত। আমার প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু নিজেকে বোঝাতে পারি না কিছুতেই। শেষে বাড়িতে ব্লেড দিয়ে নিজেই নিজের ভ্রূ শেপ করতে শুরু করলাম। এত সবের মধ্যেও প্রতি বছর ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায় আমি প্রথম পাঁচের মধ্যে। বন্ধুরা বলতে শুরু করল, "ও তো অর্ধেক ছেলে অর্ধেক মেয়ে! তাই ওর বুদ্ধি বেশি।"
আর প্রকৃত ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠা হবে না...
এক সময় মাধ্যমিক পাশ করলাম। ফল ভাল হল না। বিজ্ঞান শাখায় পড়ার সুযোগও পেলাম না। যদিও মা-বাবার ইচ্ছে, ডাক্তারি পড়ব। সহপাঠী প্রেমিক কলকাতায় চলে গিয়েছে। আমিও বহরমপুরের চেনা গণ্ডি ছেড়ে বাইরে বেরলাম। তখনই প্রথম জানলাম, আমার মতো আরও অনেক ‘হয়ে ওঠা নারী’ আছেন। পুরুষ লিঙ্গ নিয়ে জন্মালেও আমার আর প্রকৃত ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠা হবে না। তত দিনে আমি নাইটি পরি। রান্না করি। ঘর গোছাই। বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ি। আলপনা দিই। ইতুপুজো, শিবরাত্রি করি।
ছোট থেকে আরও একটি শখ আমার। অভিনয় করার। মাত্র ৭-৮ বছরে ‘যেমন খুশি সাজো’-তে ‘ভিখারি’ সেজে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিলাম। আমাদের মুর্শিদাবাদ বিখ্যাত ‘আলকাপ’ আর ‘মনসামঙ্গল’-এর জন্য। ‘মনসামঙ্গল’ দেখতে বসে বেহুলার জন্য কাঁদতাম। সুচিত্রা সেনকে দেখে ভাবতাম, আহা! ও রকম যদি আমিও পারতাম। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের ‘মনের মানুষ’ দেখে সরস্বতী পুজোর দিন বুকে গামছা বেঁধে নেচেছিলাম, ‘পড়িলে প্রেমের জালে মনটা করে টনটনাটন’! ক্লাস ইলেভেনে এক বন্ধুর দৌলতে ‘ঋত্বিক নাট্য সংস্থা’য় হাতেখড়ি। তখনও আমি ছেলেদের চরিত্রেই অভিনয় করি। সেখানে ‘ডাকঘর’-এর ‘অমল’ হয়ে রাতারাতি বিখ্যাত। দুই বাংলার মানুষ অভিনয় দেখে অভিভূত। ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তীর মতো ব্যক্তিত্ব দলে যোগ দিতে ডাকলেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্ট্রুমেন্টাল মিউজিক বিভাগের প্রধান গৌতম ঘোষ বললেন, "সুজয় (তখনও সুজি হইনি), অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক নিয়ে পড়াশোনা কর।" আমার কপাল! ২০১১-য় ভর্তির সময় নাটকের স্পেশাল অনার্স ক্লাসটাই বন্ধ হয়ে গেল।
বুকে লইয়া দুঃখের চিতা....
তখন আমার একটাই লক্ষ্য। যেন তেন প্রকারেণ বহরমপুর থেকে বেরিয়ে কলকাতায় আসতে হবে। কারণ, অভিনয় করে পেট ভরাতে গেলে বহরমপুরে থাকলে চলবে না। ‘ঋত্বিক গ্রুপ থিয়েটার’ ছেড়ে যোগ দিলাম নান্দীকারে। সেখানেও বেশিদিন কাজ করতে পারিনি। কারণ, সবাই আমায় নিয়ে হাসাহাসি করত। এ দিকে মায়ের কৌতূহল, "কবে হিরো হবি?" কখনও শাসাতেন, "প্রতিবেশী, আত্মীয়েরা বলে, তুই নাকি মেয়েদের মতো শাড়ি পরে ঘুরিস! এ রকম করলে গলায় দড়ি দেব।" বাড়িতে কী করে জানাই আমার প্রকৃত অবস্থান? সারাক্ষণ পাগলের মতো কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। পাঁচ বার বাড়ি বদলেছি ‘মেয়েলি পুরুষ’ হওয়ার দোষে। অবশেষে কাজ শুরু করলাম বিভাসদার ‘অন্য থিয়েটার’-এ। প্রথম নাটক শেক্সপিয়রের ‘আ মিডসামার নাইট'স ড্রিম’ অবলম্বনে ‘চৈতালি রাতের স্বপ্ন’। সেখানে আমি অর্ধ্বনারীশ্বর। আবারও অভিনয় দেখে মুগ্ধ সবাই। আবারও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম।
এ বার সমস্যা অন্য জায়গায়। আমি মেয়েলি পুরুষ। তাই পুরুষ চরিত্রে অচল। নতুন, তাই বলতেও পারি না মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করব। ফলে, ডাক পেয়েও কাজ পাচ্ছি না। শেষে ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ নাটকে ‘নসুবালা’র চরিত্রে মনোনীত হয়েও বাতিল। কেন? আমি থাকতেও তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্র পেল এক পুরুষ!
অভিনয়ের দুনিয়ায় সেই প্রথম জোর ধাক্কা। এত দিন সবাই বলতেন, "তোমার মতো চরিত্র পেলেই ডাকব।" সেই রকম চরিত্রের যখন হদিশ মিলল, তখন আমি ব্রাত্য! কষ্টে, ঘেন্নায় কলকাতা ছেড়ে সোজা গোয়া। বন্ধুদের কাছে উঠলাম। ঠিক করলাম, আর অভিনয় নয়। আমি ওদের মতো নিজেকে তৈরি করব। পতিতাবৃত্তিতে যোগ দেব। দরকারে হরমোন থেরাপি, ব্রেস্ট সার্জারি, ভ্যাজাইনাপ্লাস্টি করাব। তখন থেকেই চুল বড় করতে শুরু করলাম। ৩ মাস থাকার পরে মনে হল, দম আটকে আসছে। কলকাতা, নাটক, অভিনয়... টানছে। এদিকে কমিউনিটির বন্ধুরা বলছে, "কেউ তোকে কাজ দেবে না। হিজড়ে বৃ্ত্তিতে আয়।"
আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও...
কী করি? একবগ্গা মন বোঝাচ্ছে, অভিনয়ের দুনিয়াতেই করে খেতে হবে। কিন্তু থিয়েটার কাজ দেয় না। সিরিয়ালে ডাক পাই না। ছবিতে তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেলাম। মায়ের সেই এক কথা, "তুই নায়ক হবি না?" বাবা সব ছেড়ে বহরমপুরে ফিরে যেতে বলছেন। এমন সময় অফার পেলাম এসভিএফ থেকে। ওদের সঙ্গে করা পর পর দুটো কাজ পায়ের তলার জমি শক্ত করল। তার পর জি বাংলার ‘ফিরকি’তে। আগামী দিনে আমায় দেখা যাবে ‘সল্ট’ ওয়েব সিরিজে। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের বোন হিসেবে। ঋতুদি প্রথম আমায় ডেকে মেয়ের চরিত্র দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘তুই মেয়েই সুজি! আমারই মতো। শুধু তোকে একটু বেশি লড়াই করতে হবে।’’
জ্বালাপোড়ার কি শেষ আছে? একের পর এক প্রেম ভেঙেছে। জ্বলতে জ্বলতে আবার নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়েছি। যত পুরুষ এসেছে সবাই বলছে, তোমার মতো সুন্দরী মেয়েরাও হয় না। তুমি শরীর, মন সব দিক থেকেই সম্পূর্ণা। তবু কেউ আজ পর্যন্ত বিয়ের সাহস দেখায়নি।
নারী দিবস এলেই অতৃপ্তি কুরে কুরে খায়, আমি অন্তরে রাধা, বাইরে বনমালী। পুরোপুরি রাধা হতে পারব না? তখনই প্রতিজ্ঞা করি, মৃত্যুর আগে প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করে নারীর সব অঙ্গ শরীরে ধারণ করব। যাতে দাহের আগে গঙ্গাজলে শরীর ধোয়ানোর সময় সবাই দেখতে পায়, আমি পুরুষ নই, পরিপূর্ণ নারী।
আমি এই জনমেই হব রাধা...!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy