সচেতনতা একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা। যেখানে বার বার হানা দিয়ে যেতে পারে অবচেতন। আর তাই, যে কোনও দুর্বলতায় যে কোনও মানুষের আচরণ আঘাত দিয়ে ফেলতে পারে পাশের মানুষটিকে। এই মুহূর্তে টলিপাড়া ভুগছে তেমনই সমস্যায়।
গত কয়েক বছরে সমাজমাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত যে কোনও পর্দাকে করেছে ছিন্নভিন্ন। তাই হাস্যরস, কৌতুক, ব্যঙ্গ, রসিকতার মতো বিষয়গুলি শানিত হতে হতে কখন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। নির্মম ভাবে নষ্ট করছে সামাজিক সম্মান। শনিবার রাতের ঘটনা। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয় একটি ভিডিয়ো। সেখানে দেখা যায় ধারাবাহিক ‘রাঙামতী তিরন্দাজ’-এর সেটের অন্দরকাহিনি। শুটিংয়ের অবসরে সহকারী পরিচালক সঞ্চারি চট্টোপাধ্যায় মগজমারির খেলা (ব্রেন স্টর্মিং গেম) খেলছিলেন। পাশে ছিলেন অভিনেত্রী ঐশ্বর্য মণ্ডল, সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনেত্রী ঐশ্বর্য আনন্দবাজার অনলাইনকে জানিয়েছেন, তখনই অসাবধানে তিনি বলে ফেলেন, “তুই তা হলে ‘অটিস্টিক’ বা ‘পাগল’ নোস!” কথায় সায় দিতে দেখা যায় সুদীপ্তাকেও।
এই ভিডিয়োটি সমাজমাধ্যমে ভাগ করেছিলেন পোশাক পরিকল্পক অভিষেক রায়। বিবরণীতে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি লেখেন ‘ছিঃ’। যদিও পরে সেটি তিনি মুছে দিয়েছেন। কিন্তু তত ক্ষণে সেই ঝলক সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান বাচিকশিল্পী, অভিনেত্রী অমৃতা মুখোপাধ্যায়-সহ অনেকেই। অমৃতার একমাত্র সন্তান বুরনের ডাউন সিনড্রোম। প্রতিবাদ জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গ শিশু সুরক্ষা কমিটির তরফ থেকেও।
রবিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে অভিনেত্রী সুদীপ্তা বলেন, “ইদানীং সমাজমাধ্যমে বুদ্ধি পরীক্ষা করার জন্য নানা ধরনের মজার খেলা চালু হয়েছে। সে রকমই একটা খেলা ধারাবাহিকের এক সহকারী পরিচালক খেলছিলেন। তখনই শব্দ দু’টি উচ্চারিত হয়।” তিনি দাবি করেন, অটিজ়ম সমন্বিত শিশুর সমস্যা বা সেই শিশুর মা-বাবার মানসিক অবস্থা কী হয় তা তিনি বোঝেন। তাই এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কটাক্ষ বা রসিকতার প্রশ্নই ওঠে না।
জানা যায়, ব্যক্তিগত স্তরে অমৃতা কথা বলেছিলেন অভিনেত্রী ঐশ্বর্যের সঙ্গে। তিনি নাকি সে সময় ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষমা চেয়েও নিয়েছেন তাঁর কাছে। কিন্তু এ ভাবে সমস্যা মেটার নয়। অমৃতাদের দাবি, যেমন সকলের সামনে ওই শব্দ দু’টি উচ্চারণ করেছিলেন অভিনেত্রীরা, তেমনই সকলের সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। সমস্যা সেখান থেকেই জটিল হয়ে উঠেছে।
অমৃতার ছেলের ডাউন সিন্ড্রোম। শরীরের বয়স তেরো হলেও মানসিক বয়স মাত্র ছয়। এখনও পর্যন্ত ওকে নিয়ে রাস্তায় বেরোলে নানা অবাঞ্ছিত প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তাঁকে। অমৃতার আফসোস, সমাজ এখনও বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। রাজ্য সরকার এখনও অটিস্টিকদের জন্য বাকিদের মতো স্বাভাবিক স্কুল তৈরির কথা ভাবে না। তাঁর আক্ষেপ, “সেই জন্যই এখনও সাধারণ মানুষের চোখে অটিস্টিক মানে ‘পাগল’!” অমৃতার অভিযোগ, “প্রাথমিক কিছু বাদানুবাদের পর ঐশ্বর্য ক্ষমা চাইতে রাজি হন। শিশু সুরক্ষা কমিটির নির্দেশ ছিল, যে ভাবে প্রকাশ্যে তিনি শব্দ দু’টি উচ্চারণ করেছেন সে ভাবেই প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।”
অমৃতাই জানিয়েছেন, প্রথমে ক্ষমা চেয়ে প্রথমে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের স্টোরিতে একটি ভিডিয়ো ভাগ করেন ঐশ্বর্য। কিন্তু ১৫ মিনিটের মধ্যেই সেই ভিডিয়ো মুছে দেন তিনি। অভিনেত্রী দাবি করেন, তিনি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। কিন্তু নিজস্ব অ্যাকাউন্ট ‘লক’ করে রাখায় কেউই সেই ভিডিয়ো দেখতে পাচ্ছেন না। ঐশ্বর্যের এই আচরণে আরও বিরক্ত শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা।
ঐশ্বর্য অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর পাল্টা দাবি, “ভিডিয়ো বার্তায় ক্ষমা চাওয়ার পরেই সেই বার্তা এমন ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন অমৃতা-সহ সকলে যাতে আমার ব্যক্তিগত জীবন, পেশাজীবন বিপর্যস্ত।” তাই তিনি সমাজমাধ্যমের পাতা লক করতে বাধ্য হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন শিশু সুরক্ষা কমিটির চেয়ারপার্সন তুলিকা দাসের সঙ্গে। তিনি নতুন করে আনন্দবাজার অনলাইনের মাধ্যমে ক্ষমা চাইছেন বলেও দাবি করেছেন। আগামীতে কথা বলার সময় আরও সচেতন হবেন, জানিয়েছেন অভিনেত্রী।
আরও পড়ুন:
শিশু সুরক্ষা কমিটির চেয়ারপার্সন তুলিকা দাসও এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন, তিনি আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সুদীপ্তার বক্তব্য পড়েছেন। সে প্রসঙ্গে তাঁর মত, “সংবাদমাধ্যমের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, সঙ্গে সাধারণ মানুষ যে সফল মানুষদের খুঁত ধরেন, সে কথাও উল্লেখ করেছেন। কেউ আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইলে কি এ ভাবে কথা বলেন?” ঐশ্বর্য প্রসঙ্গে তুলিকার সাফ কথা, “ভিডিয়োটি ভাইরাল হওয়ার পর অভিনেত্রীর নামে প্রচুর অভিযোগ জমা পড়তে থাকে। অমৃতা এবং ওঁর মতো আরও অনেক মা-বাবা একত্রে অভিযোগ জানান। লিখিত আকারে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন তাঁরা। বিষয়টির গভীরতা বুঝে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলি ঐশ্বর্যের সঙ্গে। জানাই, প্রকাশ্যে খেলাচ্ছলে শব্দদুটো উচ্চারণ করতে পারলে ক্ষমাও প্রকাশ্যেই চাইতে হবে।”
তুলিকা দাবি করেছেন, তিনি ঐশ্বর্যকে বলেছিলেন ক্ষমা চাওয়ার ভিডিয়োটি যেন সমাজমাধ্যমে অন্তত দু’দিন থাকে। প্রাথমিক ভাবে ঐশ্বর্য সে কথায় রাজি হন। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। প্রথমে স্টোরিতে ক্ষমা চাওয়ার ভিডিয়োটি দিয়েছিলেন। যা সমাজমাধ্যমের নিয়ম অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরে গিয়েছে। পরে ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিয়োটিও তিনি সম্ভবত ‘ব্যক্তিগত’ করে দেন। ফলে, কেউই সেটি আর দেখতে পাচ্ছেন না! ফলে, আবার অভিযোগ জমা পড়ছে তাঁর কাছে।
রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিটি কি তা হলে এ বার কোনও পদক্ষেপ করবে? তুলিকার কথায়, “প্রয়োজন হলে অন্য অভিযোগের ক্ষেত্রে যে রকম আইনানুগ পদক্ষেপ করা হয় এ ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু করা হতে পারে।”