Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

‘ফেয়ার’ সরল, মন থেকে ‘লাভলি’ সরলেও ভাল হত, মনে করছে টলিউড

কালো-ফর্সা দিয়ে বিভেদ আসলে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা বলে মনে করেন ঋতুপর্ণা।

গ্রাফিক- তিয়াসা দাস।

গ্রাফিক- তিয়াসা দাস।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২০ ২১:২৪
Share: Save:

এক প্রথম সারির পরিচালকের শুট চলছে কলকাতার এক নামী রেস্তরাঁয়। দুই ডাকসাইটে অভিনেত্রীর মুখোমুখি শট। একজনের গায়ের রং ফর্সা, অন্য জন বেশ কালো। দু’জনেই শক্তিশালী অভিনেত্রী। সে দিন হঠাৎ দেখা গেল কালো চামড়ার অভিনেত্রী নিজে মেক আপ করে ফ্লোরে এসেছেন। তাঁর গালে সাদা ফাউন্ডেশনের পোচ। মোদ্দা কথা, তিনি ফর্সা হয়ে এসেছেন! ফ্লোরে তিনি কারও কথা শুনবেন না। অগত্যা পরিচালক তাঁকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানালেন, তাঁর ছবিতে কালো রং বলেই তাঁকে তিনি কাস্ট করেছেন!

অভিনেত্রীদের আইডেন্টিটির সঙ্গে যেমন তাঁর শরীর জড়িয়ে আছে, তেমনই জড়িয়ে আছে চামড়ার রং। সে ফেয়ার মুছে লাভলি থাক বা ফেয়ার লাভলি দুই-ই থাক! আজ সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘ফেয়ার’ , ‘লাইটনিং’ শব্দ পণ্যের প্রচার থেকে সরিয়ে দেওয়ায়এক বিজ্ঞাপন কোম্পানি সাধুবাদ কুড়োচ্ছে। তবে কয়েকটা শব্দ মুছে দিলেই কি সব বদলে যায়?

‘‘সারা জীবন শুনে এলাম, কালোর মধ্যে মুখটা কী মিষ্টি! শুনতে শুনতে কান ফেটে রক্ত বেরিয়ে গেল। উফফ!’’ ধারাবাহিক ‘কোরাপাখি’-র ফ্লোর থেকে বললেন পার্নো। মানুষ আজও ‘সুন্দরী’ মেয়ের বর্ণনায় ভাবে লম্বা চুল, টিকোলো নাক, আর টকটকে ফর্সা রং, সেই কথা বোঝাতে গিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘আমাকে বলা হয়েছিল, গায়ের রং এমন হবে যে মুখের মধ্যে গরমে বাষ্প তৈরি হলে সেই বাষ্পের রংও সাদা হবে!’’ যেন অভিনেত্রীদের ফ্যান্টাসাইজের প্রথম মাপকাঠি তাঁদের চামড়ার রং। সবটাই তো তৈরি করা। এই ‘ফর্সা’, ‘প্রকৃত সুন্দরী’ ট্যাগলাইন আজও কি ইন্ডাস্ট্রির পিছু ছেড়েছে?তা হলে কেন শ্রীদেবী থেকে কাজল, প্রত্যেককেই মেলানিন ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে চামড়া ফর্সা করতে হয়?

ভেতরে কি তবে থেকে যায় কালো মেয়ের ফর্সা হওয়ার না বলা ইচ্ছা?

হয়তো তাই। নয়তো এ সপ্তাহে ধারাবাহিকের দৌড়ে সকলকে টপকে যে‘কৃষ্ণকলি’ দর্শকদের পছন্দের তালিকায় সেরা, তার প্রধান বিষয়ই তো কালো মেয়ের লড়াই নিয়ে।কোথাও ধরে নেওয়াই হয়েছে মেয়ে কালো হলে তাকে সমাজের সঙ্গে লড়াই করতেই হবে। ‘‘ধারাবাহিকে যে ভাবে গল্প বলা হয় তা সরাসরি বাস্তব থেকে নেওয়া। কালো মেয়ে মানেই তো খারাপ নয়। তাই কৃষ্ণকলির সূত্রপাত’’, বুঝিয়ে দিলেন কৃষ্ণকলির ‘শ্যামা’ ওরফে তিয়াসা

তা হলে কালো থেকে কৃষ্ণকলি আবার ফর্সা হল যে?

‘‘সে তো অন্য মানুষ। কৃষ্ণকলি আর আম্রপালি এক নয় কিন্তু। একরকম দেখতে হলেও এক জন কালো, আর এক জন ফর্সা’’, স্পষ্ট করলেন তিয়াসা। তা হলে রং দিয়েই আলাদা হল চরিত্র!

এই বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে তিয়াসা বললেন, ‘‘গল্পের কথা জানি না। তবে আমি যখন কালো হই, শ্যামা সাজি, তখন আমায় দেখতে অনেক বেশি ভাল লাগে। মনে হয় আমার কালো রং থাকলেই তো হত!’’

কালো-ফর্সা দিয়ে বিভেদ আসলে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা বলে মনে করেন ঋতুপর্ণা। ‘‘শ্বেত পাথরের থালা’য় যখন অভিনয় করলাম বলা হল আমার গায়ের চামড়া বেশি চকচকে, চোখ কটা, নায়িকাসুলভ নই আমি। ওই সব কথা মাথায় রাখিনি। কারণ জানি, অভিনয় আর আত্মবিশ্বাস আসল। নয়তো আমাদের দেশে জিনাত আমন বা স্মিতা পাতিলের মতো অভিনেত্রী তৈরি হত না।’’ সাফ কথা ঋতুর।তবে কোনও ব্র্যান্ড যদি ওই ‘ফেয়ার’‘হোয়াটনিং’, এই শব্দ মুছে দেয় সেটা ভাল খবর বলেই ভাবছে টলিপাড়া।

লকডাউনে অনেক ভাল দিক উঠে আসছে বলে মনে করেন পাওলি। ‘‘ছোটবেলায় শুনতাম কালো! বিয়ে হবে? এটা কোনও কথা? সৌন্দর্যের সঙ্গে ফর্সা-কালোর কোনও সম্পর্ক নেই। এই ‘ফেয়ার’ বিষয়টা যে বাদ পড়েছে, এই শুরুটার জন্য খুব ভাল লাগছে। আস্তে আস্তে আমরা অনেক পুরনো ভুল ধারণাকে বদলাতে পারব,’’ খুশির সুর পাওলির গলায়।

ছোটবেলায় লক্ষ্মীপুজো করতেন তিনি, আর বলতেন,‘‘মা, আমি যেন তোমার মতো সুন্দর হই।’’ সেই ছোট মেয়ে আজ ইন্ডাস্ট্রির শ্রাবন্তী। বললেন, ‘‘আমি ফর্সা হলে কী হবে? সারাক্ষণ শুনছি, ‘‘বাবা! তুই যা ফর্সা অন্ধকারেও চকচক করিস!’’ছোটবেলায় তো ‘দুধ পাটালি’ বলে খ্যাপাতো আমায়। এখন আমার বরের নাম রোশন, মানে আমি উজ্জ্বল রঙেই থাকি। তবে কালো ফর্সা জিনগত ব্যাপার, ও দিয়ে কিছু হয় না। ফেয়ারনেস শব্দ বিজ্ঞাপনে আলাদা প্রাধান্য পাক, চাইনি কখনও।’’

শ্রাবন্তীর ফর্সা রং তাঁর ইউএসপি হলেও ফর্সা-কালোর দ্বন্দ্ব নিয়ে বলতে বসে প্রথমেই আক্ষেপ কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, ‘‘আমার ক্ষেত্রে তো উল্টোটাই হয়েছে! ফর্সা রংয়ের জন্য অনেক ভাল চরিত্র হাতছাড়া হয়েছে।অনেক কম কাজ পেয়েছি। ফর্সা রং অনেক সময় মাইনাস পয়েন্টও হতে পারে। কনীনিকাও ছোটবেলায়‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ মেখেছেন, স্বীকার করলেন অকপটে।

তা হলে তাঁর মনেও কি ধবধবে রংয়ের প্রতি দুর্বলতা লুকিয়ে ছিল?

‘‘ছোটবেলায় সবাইকে এই কথাটাই শেখানো হয়, কালো নয় সাদা শুভ। বাড়িতে তাই কালো বেড়াল পোষা হয় না। রাস্তা কেটে গেলে অশুভ মানা হয়। শ্রীকৃষ্ণ বা দেবী কালিকার পুজো করব। কিন্তু কালো মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে কালঘাম ছুটবে মা-বাবার। পণের তোলায় চাপাতে হবে তাকে।’’

বলতে বলতে ক্ষোভ বাসা বাঁধল গলায়, ‘‘সবাই তাই কালো, অন্ধকারকে পাশ কাটায়। আলোয় থাকতে চায়। আমি কিন্তু অন্ধকারে থাকতে ভালবাসি।’’

এক নামী সংস্থার ক্রিম সরিয়ে নিয়েছে ‘ফেয়ারনেস’ শব্দ। অভিনেত্রী নন্দিতা দাস সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, শব্দ সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ ভাল। তবে ক্রিমটা তো সেই থেকেই গেল! অস্বস্তি আছে তাঁর প্রশ্নে। সমাজের শিকড়ে আঘাত করেছেন তিনি এই তৈরি করা ‘কালো’ রঙের উপর!যেমন অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ বলছেন,‘‘ফেয়ারনেস নিয়ে বলতে বসেছি, এটাই কী ভীষণ লজ্জার, পিছিয়ে পড়া মানসিকতার, তাই না?’’ ফেয়ারনেস ক্রিমের নাম বদল নিয়ে কথার শুরুতেই হাসতে হাসতে এই জবাব দিয়ে ‘নাম বদলে কিচ্ছু হবে না’ মনোভাবকেই যেন মান্যতা দিলেন সায়নী।

গায়ের রং মাজা, এই অজুহাতে কেউ কোনওদিন চড়া মেকআপ করিয়েছে? এমন ‘আনফেয়ার’ প্রশ্ন শুনে তাঁর হাসি আরও বাড়ল, ‘‘কারও কোনওদিন সাহসেই কুলোয়নি! আমি যেমন, গায়ের সেই রং নিয়েই অভিনয় করে এসেছি। করে যাব।’’সায়নীর কথায়, ‘‘মা দুধে-আলতা, বাবা কুচকুচে কালো। তাই আমার গায়ের রং কেমন হবে তাই নিয়ে ভীষণ চিন্তা ছিল পরিবারের। আমার রং মাঝারি। তারপরেও মাকে বলে দিয়েছি, বেসন-হলুদ মাখতে পারি ঔজ্জ্বল্য ফেরাতে, ফর্সা হওয়ার জন্য নয়।’’

বিদীপ্তা চক্রবর্তী যেমন হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘আমার গায়ের রং বেশ চাপা। কালোই আমি। তাই নিয়ে সমস্যার হয়েছে কিনা জানতে চাইছেন?’’ তারপরে জানালেন, ‘‘না, কোনও সমস্যা হয়নি। বরং, সবাই আমার গায়ের রংয়ের প্রশংসাও করেন। বিশেষ করে সিনেমাটোগ্রাফার বা ডিওপি-রা বলেন, আমার গমরঙা গায়ের রং নাকি ক্যামেরার পক্ষে দারুণ কমফর্ট জোন। গায়ের রং আসলে কখনওই শিল্পীর প্রতিবন্ধকতা হয় না। তবে চরিত্র বিশেষে ম্যাটার করে।’’

ব্যক্তি বিদীপ্তা গায়ের রং নিয়ে মাথা ঘামান? ‘‘একে ভাবনার বিষয় বলেই মনে করি না!’’, অভিনেত্রীর দৃপ্ত জবাব।তবে একটা শব্দ মুছলেই সব বদলে যাবে, এমনটায় বিশ্বাসী নন বিদীপ্তা। তাঁর মতে, ‘‘শিকড়ে ঢুকে গিয়েছে এই বিদ্বেষ। নাম বদলে মোছা খুব মুশকিল।’’

অভিনেত্রী কাঞ্চণা মৈত্র অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন পণ্যের এই প্রচারে। ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ থেকে ফেয়ার বাদ গিয়েছে। খুব ভাল। কিন্ত লাভলি কেন? ক্রিম কী বলছে, আপনার চামড়াকে হেলদি করব? সবাই তো সবার মতো করে লাভলি। ফর্সা মেয়ে হলেই কি লাভলি?সুন্দরের সংজ্ঞা এক হওয়া উচিত নয়। এক এক জনের এক এক রং, রামধনুর মতো।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy