Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Tollywood lockdown short

টেকনিশিয়ানদের বাদ দিয়ে শর্ট ফিল্মের ভবিষ্যৎ কী? উত্তর খুঁজছে টলিউড

বাড়ি বসেই মেকআপের আলতো টাচ, টাইমারে কারিকুরি, আর একটা মানানসই স্ক্রিপ্ট— ব্যাস, চার-পাঁচ মিনিটের লকডাউন শর্টস তৈরি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

বিহঙ্গী বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২০ ১৩:১৭
Share: Save:

শুটিং পাড়ার লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের হাঁকডাক বন্ধ হয়েছে বহু দিন। ওয়েবসিরিজ দেখে, ডালগোনা কফি বানিয়ে আজ ক্লান্ত টলিউড। সৃষ্টিশীলতাকে কিছুটা চাঙ্গা রাখতেই লকডাউনের বাজারে হিড়িক লেগেছে শর্টফিল্মের। বাড়ি বসেই মেকআপের আলতো টাচ, টাইমারে কারিকুরি, আর একটা মানানসই স্ক্রিপ্ট— ব্যাস, চার-পাঁচ মিনিটের লকডাউন শর্টস তৈরি। আর শুধু শর্টসই বা কেন? বিভিন্ন চ্যানেলও বাড়ি বসেই মোবাইল শুট করা নতুন এপিসোড নিয়ে আসছেন দর্শকের দরবারে।

কলাকুশলীদের নিখুঁত অভিনয় হার মানাছে ভৌগোলিক দূরত্বকেও। এই যেমন দিন কয়েক আগে অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য নিজের বেহালার বাড়িতে বসে আন্দুলে প্রিয়ঙ্কাকে সঙ্গে নিয়ে বানিয়ে ফেলেছিলেন শর্টফিল্ম ‘শামুক’… দিন দু’ই আগে পরিচালক শিলাদিত্য মৌলিক অভিনেত্রী পায়েল সরকারকে নিয়ে বানিয়েছেন ‘একটি তারা’। কৃষ্ণকিশোর মুখোপাধ্যায় বানিয়েছেন ‘ব্লু বোট’। প্রযোজনা সংস্থা উইনডোজ তো সেই কবে থেকেই একের পর এক শর্ট ফিল্ম বানিয়েই চলেছে।

আর এতেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। দ্বন্দ্ব না বলে বোধহয় ‘অভিমান’ বলাই ভাল। এই যে বাড়ি বসে শর্টফিল্ম, নতুন এপিসোড শুট করার হিড়িক তাতে অভিনেতা-পরিচালকদের শৈল্পিক বিকাশ ঘটলেও ব্রাত্য টেকনিশিয়ানরা। বাড়িতেই শুট, বাড়িতেই হচ্ছে মেকআপ, চুল বাঁধা থেকে ডায়লগ থ্রো— সব কিছুই একা হাতেই করছেন অভিনেতারা। আর তাতে করেই পাহাড় জমেছে অসন্তোষের। ‘এই যে একটি চ্যানেলে বাড়িতে বসেই রিয়ালিটি শো-র চারটে এপিসোড শুট হয়ে গেল, টেকনিশিয়ানদের ভাগ্যে কী জুটল? কাঁচকলা !’, বলছিলেন টলি পাড়ারই এক মেকআপ আর্টিস্ট। শোনা যাচ্ছে এ নিয়ে ফেডারেশনের কাছেও ক্ষোভ জানিয়েছেন টেকনিশিয়ানদের একাংশ। বাড়িতে বসে শুট হলেও টেকনিশিয়ানদের ‘ভাগের টাকা’ যাতে দেওয়া হয় সে বিষয়ে অনুরোধ করেছেন তাঁরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনেমাটোগ্রাফার তো বলেই ফেললেন, “এই সব গুচ্ছের শর্টফিল্ম নিয়ে আমি একটুও আপ্লুত নই। করছে, ভাল করছে। আমি গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছি না। এর চেয়ে বাড়ি বসে একটু সিনেমা সংক্রান্ত পড়াশোনা করলে কাজে দিত। কী আর বলব! ”

আরও পড়ুন- মা হলেন অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক

কস্টিউম ডিজাইনার অভিষেক রায় আবার একেই ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছেন। “কী করা যাবে। উপায় তো নেই। সবার একটা ক্রিয়েটিভ স্যাটিসফেকশন থাকে, সেটাকেই পূরণ করছে। তবে হ্যাঁ, ডেফিনিটলি পুরো প্রসেসটার পার্ট না হতে পারাকে মিস করছি। কখনও কখনও মনে হচ্ছে এই জামাটা কেন পরল, এক বার জিজ্ঞাসা করে নিতে পারত। ” তবে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেও নিচ্ছেন বলে জানান অভিষেক। হেয়ার ড্রেসার হেমা মুন্সির গলাতেও শোনা গেল একই সুর। “খারাপ তো লাগছেই। মানুষ হয়তো ওঁদের অভিনয় দেখছে। আমি যখনই শর্ট ফিল্ম, অথবা এপিসোডগুলো দেখছি আমার মনে হচ্ছে, ‘ইস, যদি পার্টেড হেয়ারের জায়গায় ব্যাকক্লিপ দিয়ে নিত। আমার চোখ তো ওখানেই আটকে যাচ্ছে। ভীষণ ভাবে মিস করছি প্রতিটা মুহূর্ত। শুটিং সেট, মানুষজন।”

লকডাউনে সব কিছুই এতটাই ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, তাতে ভয় গ্রাস করছে টেকনিশিয়ান পাড়ায়। কবে শুটিং শুরু হবে কেউ জানে না। তত দিন কি তবে এ ভাবেই ফোনে ফোনে শুটিং চলবে? আর শুটিং শুরু হওয়ার পরেও তো রয়েছে একগুচ্ছ বিধিনিষেধ। তা হলে? আগামী এক বছর কি তবে টেকনিশিয়ানদের ‘ছুটি’? ফোন-ছবিই কি তবে ভবিষ্যৎ?

ক্ষোভ জমেছে অসন্তোষের

পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল যেমন এই আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, “খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক, কিন্তু আশঙ্কা-ভয় অমূলক। এই অস্থির পরিস্থিতিতে শিল্পীরাও চেষ্টা করছেন তাঁদের শৈল্পিক নৈপুণ্যকে সচল রাখার।” সৌকর্য আবার এ ক্ষেত্রে নিয়ে এলেন ‘ওয়ার পোয়েট’-দের প্রসঙ্গ। “বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্রেঞ্চ কবির জন্ম হয়েছিল ‘ট্রেঞ্চ পোয়েম’ বলে একটি নতুন জনরা আসবে বলে তো নয়! তাঁরা ট্রেঞ্চে থাকতেন। পাশাপাশি তাঁরা কবি। এখানেও একই ব্যাপার। তবে অবশ্যই লংটার্মের ক্ষেত্রে এটি কার্যকরী হবে না কোনওদিনই”, বলছিলেন তিনি। নিজে যদিও লকডাউনে শর্টফিল্ম বানাননি সৌকর্য। এ দিকে আবার পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাড়িতে বসে শর্টফিল্ম পরিচালনা করার হাজার অনুরোধ আসা স্বত্বেও তিনি রাখতে পারেননি। বলছিলেন, “আমি স্ক্রিপ্ট লেখা নিয়ে ব্যস্ত। আর তা ছাড়া সামনে ফেলুদা-ফেরত মুক্তি পাবে। এই সব নিয়েই সময় কেটে যাচ্ছে।” রাজ চক্রবর্তী প্রযোজনা সংস্থা থেকেও বানানো হচ্ছে না কোনও শর্টফিল্ম।

পরিচালক শৈবাল মিত্রও হাঁটা লাগিয়েছেন সৃজিত-রাজের পথে। তাঁকেও বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনিও রাজি হননি। শৈবাল বললেন, “টেকনেশিয়ানদের খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। আর তা ছাড়া শুটিং পুনরায় শুরুর নিয়ম নিয়ে এই যে নতুন অ্যাডভাইসারি দেওয়া হয়েছে তাও অত্যন্ত অমূলক। কিন্তু উপায় তো নেই।”

‘সোয়েটার’ ছবির পরিচালক শিলাদিত্য মৌলিক লকডাউনে শর্টফিল্ম বানালেও টেকনিশিয়ানদের অনুপস্থিতি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছেন। শিলাদিত্য বলছিলেন, “এই যা প্রোডাকশন হচ্ছে এই মুহূর্তে তা নিয়ে আমি কি খুব স্যাটিসফায়েড? একেবারেই নয়। টেকনিশিয়ানদের তো কোনওদিন রিপ্লেস করা যাবে না। আমার যে তিন নম্বর শর্টফিল্মটি আসতে চলেছে তা থেকে যে টাকা উঠবে তার পুরোটাই আর্টিস্ট ফোরামকে দেওয়া হবে। আর তা ছাড়া সবাইকেই বুঝতে হবে যে এই পুরো ব্যাপারটায় আমরা কিন্তু কেউই কোনও পারিশ্রমিক নিচ্ছি না।“

গোটা বিষয়টিতে আর্টিস্টরা কী বলছেন? অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীই প্রথম নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ নিয়ে বড়সড় একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এক চ্যানেলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল এই লকডাউন সময়ে শুট করে পাঠানোর জন্য। তিনি করেছেন। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তাঁর মনে পড়েছে তাঁর মেকআপ আর্টিস্ট, হেয়ার ড্রেসারদের কথা। সুদীপ্তা বলছিলেন, “যখন চ্যানেল থেকে যোগাযোগ করা হয় তখন প্রথমে তো বেশ এক্সসাইটমেন্ট নিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম। পরে বুঝলাম গোটা ব্যাপারটা কত ঝামেলার। আমার বাড়ির লোকেরা কোনওরকমে সেট তৈরি করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু টেকনিশিয়ানদের যে পারফেকশন তা কি সম্ভব আমার পক্ষে?” মন থেকে খুশি নন তিনি। হেয়ার স্টাইলিং করার সময় মিস করেছেন তাঁর হেয়ার স্টাইলারকে। মিস করেছেন মেকআপ আর্টিস্টকে। আর শুধু মেকআপ আর্টিস্ট-হেয়ার ড্রেসারই নয়, আর্ট ডিরেক্টর, বুম ম্যান, টি-বয় থেকে শুরু করে স্পটবয়, ক্যামেরা অ্যাসিসট্যান্ট থেকে ‘ড্রাইভার দাদা’র সঙ্গে আড্ডার কথাও মনে পড়েছে তাঁর প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু সুদীপ্তার মতে ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’। তাই যত্ন নিয়েই শুটিং করেছেন সেই চ্যানেলের।

দেখুন সুদীপ্তার পোস্ট

তবে এই যে বাড়ি থেকে শুট করে পাঠানোর প্রক্রিয়া তা নিয়ে কিন্তু শিল্পী মহলের অন্দরেও ফিসফাস শুরু হয়েছে। এক জনপ্রিয় অভিনেতাকে যেমন বাড়িতে সেট তৈরি করে, এক চ্যানেলের পাঠানো স্ক্রিপ্ট নিয়ে শুটিং করতে বলা হয়েছিল। ‘এত আয়োজন করে শুট করতে পারব না’, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। অভিনেত্রী সায়ন্তনী গুহঠাকুরতা আবার সদ্য কাজ করলেন রিঙ্গো বন্দ্যোপাধ্যায়ের শর্টফিল্মে। টেকনিশিয়ানদের মিস করেছেন তিনিও। তাঁদের ছাড়া যে ইন্ডাস্ট্রি অচল সে কথা স্পষ্টই জানিয়েছেন সায়ন্তনী।

জমা অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি, মন কষাকষি যাই থাকুক না কেন, অভিনেতা থেকে ফ্লোর ম্যানেজার, পরিচালক থেকে মেকআপ আর্টিস্ট সবার এখন একটাই চাওয়া— টলি পাড়া আবার ভরে উঠুক লোক সমাগমে, শুরু হোক শুটিং, ঘুরে দাঁড়াক বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy