অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
করোনাক্রান্ত বিশ্বে এল তাঁর জন্মদিন। ধুপ ও মালা দিয়ে মণ্ডপে পুজো নেই। ভোর থেকে রাত অবধি নানা গান, কবিতা ভরা রবীন্দ্রবরণ, নতুন শাড়ি, পাঞ্জাবি থেকে বাদ পড়েছেন এ বার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তবে বিস্ময়ের কারণ নেই। বাদ কেবল জমায়েতে আর মঞ্চ গানে। এ বার জন্মদিন বাড়ি-গানে। যে বাড়ির নাম ‘জুম’ বা ‘গুগল প্লে’ বা স্বয়ং ফেসবুক। গান-কবিতা, ছোট ছবি, নৃত্য, ছোটগল্প পাঠ— রবিবাবুর সব পুজো ভার্চুয়াল মিডিয়ায়।
“সারা বছর রবীন্দ্রচর্চা করি। এই বয়সে এসে রবীন্দ্রনাথের এই ভার্চুয়াল জন্মোৎসব আমার একেবারেই পছন্দ নয়। আজকাল ফেসবুক খুলতে ভয় লাগে। শুধু গান! যাঁরা একেবারেই গাইতে পারেন না তাঁরাও গাইছেন। যাঁরা শিল্পী তাঁরাও গাইছেন। সব মিলেমিশে একাকার। এই লকডাউন তো অনেকদিন চলবে। শেষ হলেও মঞ্চে গান শুনতে যাবে না মানুষ। তত দিনে আরও গান গাওয়া বাড়বে। ফলে পেশাদার শিল্পীদের গান টিকিট কেটে আর কেউ শুনতে যাবে? মনে হয় না!” বিরক্তির সুর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী প্রমিতা মল্লিকের গলায়। সঙ্গে থাকার অনেক অনুরোধ এসেছে তাঁর। এ ভাবে মুখ দেখিয়ে সঙ্গে থাকতে নারাজ তিনি।
যে বিষয় ঘিরে মানুষের মধ্যে ‘ক্রেজ’ বা ‘উন্মাদনা’ দেখা যায় তা চিরস্থায়ী হয় না বলে মনে করেন সঙ্গীতশিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত।“করোনা যেন ছলনা। মানুষ কর্মহীন। তাই চারিদিকে এই গান গাওয়ার হুজুগ। লকডাউন চলে গেলে এই হুজুগ সরে যাবে”,বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
সবটাই পরিস্থিতির স্বীকার। এই ভার্চুয়াল জন্মোৎসবে রবীন্দ্রনাথের গান, নাচ বা কবিতা বলার পরিসর যেন আরও বড় হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকার। “অনেকে মিলে এই যে মানুষ পার্টিসিপেট করছে এটা খুব ভাল লাগছে দেখে। মন খুলে নাচ গান করতে পারছে সবাই যে যার মতো করে। কোনও অনুষ্ঠানের ডাকের জন্য কাউকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না” বুঝিয়ে দিলেন জয়। কিন্তু পরিবেশনের গুণগত মান? জয়ের কথায়: “মানুষের হাতে অপশন বাটন আছে। ভাল না লাগলে মানুষ শুনবে না।” দীর্ঘ সময় ধরে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বাতন্ত্র্য আর ঐতিহ্যকে শিক্ষার মাধ্যমে প্রচার করে আসছে ‘দক্ষিণী’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার কর্ণধার সুদেব গুহঠাকুরতা এই ভার্চুয়াল জন্মোৎসবকে কোন চোখে দেখছেন? “প্রচুর শিল্পী আজ থেকেই গান গাইছেন। এ এক ধরনের আত্মপ্রচার! আমার সংশয় আছে যাঁরা রোজ ফেসবুকে বা অন্য ডিজিটাল মাধ্যমে গান গাইছেন তাঁরা কতজন রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন? তবে এই সাময়িক পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রজন্মোৎসব এ ভাবেই হবে, কিছু করার নেই। তবে যাঁরা ভয় পাচ্ছেন যে এর পর মানুষ মঞ্চে গিয়ে টিকিট কেটে গান শুনবে না তাঁদের ভয় অমুলক। লাইভ অনুষ্ঠান আর ডিজিটালি ঘরে বসে গানের কোনও তুলনা হয় না”, সোজাসাপ্টা কথায় মনের ভাব বুঝিয়ে দিলেন সুদেব গুহঠাকুরতা।
আরও পড়ুন- কলকাতায় এ বার রবীন্দ্র-বরণ কোয়রান্টিন রেডিয়োয়!
অনলাইন ক্লাস করছেন। পরিকল্পনা আছে ওয়ার্কশপ করার। এর মাঝে এই রবীন্দ্রজন্মোৎসব ভাল লাগছে না শ্রাবণী সেনের। “লোকে বলেছে সেজেগুজে ভিডিয়ো দিতে? করোনায় সাজ! রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের অধিকার সকলের আছে। তবে যে যেমন করে পারছে গান গাইতে শুরু করছে। এতে গুণগত মান থাকবে না আর। এমন সময় আসবে মানুষ আর রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে চাইবে না!” সাফ কথা শ্রাবণীর।
লকডাউনে এমনিতেই চারপাশ স্তব্ধ! বৈশাখের দাবদাহও নেই। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’ বা ‘দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও’। একই গান ফিরে ফিরে আসছে ফেসবুকে। তাতে কী? কুছ পরোয়া নেই। ইতিমধ্যেই মেজকাকা থেকে বড়পিসি, সবাই তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে হারমোনিয়াম নামিয়ে ফেলেছেন। স্যান্ডো গেঞ্জি বা আর ম্যাক্সির উপর কাঁথা স্টিচের চাদর জড়িয়ে রোজ গান গাইছেন তাঁরা লাইভে!
“কী যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না। লকডাউনের যন্ত্রণা তো ছিলই! এ বার করোনায় গানের যন্ত্রণা। তবে মানুষ ঘরে বসে কী বা করবে? তাই গান গাইছে, কানেক্টিভিটির জন্য। লকডাউন খুললে মানুষ যাতে শিল্পী হিসেবে তাঁদের মনে রাখে এই ভাবনাটাও কাজ করছে। তবে সারাক্ষণ নিজের গান শোনাতে গিয়ে শ্রোতাদের বিরক্তির কারণ হয়ে যাচ্ছেন না তো তাঁরা?ভেবে দেখবেন।এই ভিড়ে না হয় একটু রাশটা ধরে রাখলেন,” ব্যাখ্যা করলেন সঙ্গীতশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য। তিনি মনে করেন ভার্চুয়াল আসর কখনওই মঞ্চ আসরের বিকল্প হতে পারে না। মঞ্চের গুণগত মান ভার্চুয়াল আসরে কিছুতেই পাওয়া যাবে না।তবে তিনি এক ভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছেন। যে যন্ত্রশিল্পী আর সাউন্ড নিয়ে কাজ করা মানুষেরা তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করেন তাঁদের কথা ভেবেই তিনি আর জয়তী চক্রবর্তী দু’ঘণ্টা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের কথা ভেবেছেন অনলাইনে।
দীর্ঘ দিন ধরে কবিতার সঙ্গে যুক্ত সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন জন্য কবিতার ভিডিয়ো পাঠিয়েছেন বহু চ্যানেলে। “ফেসবুকে মানুষ যে ভাবে কবিতা পড়ছে শুনে খুব বাজে লাগছে! উচ্চারণ থেকে পোশাক কোনও কিছুর ঠিক নেই। মনে হচ্ছে ফেসবুক যদি কবিতা পড়ার অডিশন নিত,এ বার মন খারাপের পঁচিশে বৈশাখ!”
ইউটিউবে এক ভিন্ন ভাবনাকে প্রকাশ করছেন সুজয়প্রসাদ।জার্মানির ঔপন্যাসিক টমাস মান রবীন্দ্রনাথকে অপমান করেন। সেই অপমানের সরাসরি জবাব দেননি রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন। জয়তী চক্রবর্তীর গানের সঙ্গে এই ভাবনা উপস্থাপন করবেন সুজয়। “জন্মদিনের অনুষ্ঠান ভার্চুয়াল স্পেসে হচ্ছে এই ভাবনা নিয়ে আমি ভাবিত নই। আমার কাছে বিষয়ভাবনাই মুখ্য থেকেছে”,বললেন সুজয়প্রসাদ।
আস্ত কবিপক্ষকে ডিজিটাল মাধ্যমে আনা কি সম্ভব?
“কবিপক্ষ একদিনের নয়। সারামাস জুড়ে চলে। এই ভার্চুয়াল মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের পালনের জন্য এমন হুজুগ দেখে আমার শিল্পীসত্তা যে খুব খুশি এমনটা বলতে পারছি না। তবে লকডাউনের সময় এই কবিপক্ষের মাধ্যমেই বিশ্বের সকল শিল্পীর সঙ্গে সংযোগস্থাপন হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে ভাল দিক”, বললেন সঙ্গীতশিল্পী জয়তী চক্রবর্তী।এই সংযোগস্থাপনে বাংলাদেশের শিল্পীর সঙ্গে তাই কলকাতার শিল্পী একসঙ্গে গান গাইছেন। ভার্চুয়াল জমায়েতে মুখরিত হবে এ বার রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ।
লকডাউনের পর থেকেই আশা অডিয়ো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নানা কনটেন্ট নিয়ে আসছে। আশা অডিয়োর তরফ থেকে অপেক্ষা লাহিড়ী বললেন, “এই পরিস্থিতিতে চেষ্টা করছি আমরা পেড কনসার্ট করতে। কিন্তু টেকনিক্যালি মঞ্চের কোয়ালিটি ডিজিটাল মাধ্যমে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থা সাময়িক।”
রবীন্দ্রনাথ এখন যেন এক পাঁচমাথার মোড়। যে মোড়ে এসে জমা হচ্ছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান। এই ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ থেকেই লকডাউন-পরবর্তী রাস্তা আসবে কোনও একদিন। পঁচিশে বৈশাখের সকালে এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিতে চায় সঙ্গীতমহল। ফেসবুকের দেওয়াল, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ভরে গিয়েছে রবীন্দ্র অনুষ্ঠানের তালিকায়। নামী হোন বা অনামী, কমপক্ষে ৫ থেকে ১০টি ‘জুম’, ‘গুগল প্লে’ ‘স্ত্রিমইয়ারড’-এ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান না গাইলে বাঙালির ‘কবিগুরু স্মরণ’ যেন অসমাপ্ত থেকে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy