গেট বন্ধ।
টলিপাড়া শেষ হাসি হেসেছে মার্চের মাঝামাঝি। এর পরেই করোনাতঙ্কে বন্ধ হয়ে গিয়েছে শুটিং। সেলেবদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়ি বসেই শর্টফিল্ম বানাচ্ছেন, আবার কেউ বা বিভিন্ন চ্যানেলের নির্দেশে গৃহবন্দি অবস্থাতেই এপিসোড শুট করে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন?
সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী তৃতীয় দফার লকডাউন চলবে ১৭ মে অবধি। এর পর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। যে হারে প্রতি দিন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন চিকিৎসকেরাও। টেকনিশিয়ানদের মুখভার। তারকাদের মনে চিন্তা। পুরনো সিরিয়াল দিয়ে আপাতত কাজ চালালেও তা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে যে মোটেই কার্যকরী হতে পারে না সে বিষয়ে সব মহলই প্রায় একমত।
তা হলে? লকডাউন উঠলেই কি শুরু হবে শুটিং? কিন্তু কী ভাবে? সংক্রমণের ভয় থাকবে না?
দিন কয়েক আগে ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন) থেকে একটি বিশেষ তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে একগুচ্ছ নিয়মবিধি মেনে শুটিংয়ের একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।
• যেমন, শুটিং ফ্লোরে ঢোকার আগে প্রত্যেকের থার্মাল স্ক্রিনিং হবে। বাইরের জামাকাপড় পরে ফ্লোরে ঢোকা যাবে না। সেটে পরার জন্য জামাকাপড়ের সেট রাখা থাকবে আগে থেকে। ফ্লোরে ঢোকার আগে বাইরের জামা বদলে পরে নিতে হবে সেটের পোশাক। বেরনোর আগে ছেড়ে ফেলতে হবে সেটি। রোজ সেটি কাচাও বাধ্যতামূলক।
• শুটিং চলার সময় প্রত্যেক টেকনিশিয়ানের মাস্ক, গ্লাভস, জুতো পরে থাকা বাধ্যতামূলক। থাকবে স্যানিটাইজার। প্রত্যেককে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে সেটি। সমস্ত টেকনিশিয়ানকে খাবার আনতে হবে বাড়ি থেকে। তার জন্য অবশ্য টেকনিশিয়ানদের খাবারের ব্যয়ভার বহন করতে হবে প্রযোজকদের। খাবারের সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে ৪৫ মিনিট। তার মধ্যে প্রত্যেক শিল্পী ও টেকনিশিয়ানকে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
• শিল্পী কিংবা টেকনিশিয়ানদের মধ্যে কেউ অন্তঃসত্ত্বা হলে কিংবা পরিবারের অন্য কোনও সদস্য প্রেগন্যান্ট থাকলে, কোনও ভাবেই শুটিং স্পটে আসা চলবে না। সিরিয়াল এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য সমস্ত আউটডোর শুটিং বন্ধ। যা শুট করার, তা সারতে হবে ইনডোরেই।
• স্টোরি লাইন ও চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রেও বেঁধে দেওয়া হয় নিয়ম। এমন দৃশ্য শুট করতে হবে, যাতে দু’-তিন জন অভিনেতা থাকবেন তার বেশি নয়। প্রয়োজনে জুনিয়র আর্টিস্টকেও শুট করার অনুমতি দেওয়া হবে। স্টোরি লাইন ও স্ক্রিপ্ট এমন ভাবে লিখতে হবে, যাতে সমস্ত নিয়ম পালন করা যায়।
তবে এ ছিল শুধুই খসড়া। ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার অভ্যন্তরীণ আলোচনা। একা একা তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকার, চিকিৎসক ও ইম্পা-র অন্য সংগঠনের অনুমোদন। এ ভাবে শুটিং করা কি আদপে সম্ভব? যে সব নিয়ম মেনে চলার কথা সেখানে উল্লেখ রয়েছে তা আদপে কতটা যুক্তিযুক্ত এবং নিরাপদ সে বিষয়ে শুরু হয়েছিল জল্পনা।
আরও পড়ুন- নবাগত অজয়কে বড় ক্ষতি থেকে বাঁচান, সলমনের ফোনে ফিল্ম থেকেই সরে যান গোবিন্দা!
এর পরেই ওয়েলফেয়ার অ্যাসোশিয়েশন অব টেলিভিশন প্রোডিউসারস-এর পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়। সেখানে স্পষ্টতই জানানো হয়, এই করোনা আবহে সরকারি অনুমোদন না পেলে কোনওমতেই শুটিং শুরু করার কথা ভাবছে না তারা।
অ্যাসোশিয়েশনের সভাপতি শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “নানা ধরনের সংগঠন থেকে নিজেরা নিজেরা ফরমুলেট করতে আরম্ভ করেছে যে ‘এই ভাবে শুটিং শুরু হবে, ওই ভাবে শুটিং শুরু হবে’… । এই করোনা আবহে এই সব খবর আরও বেশি বিভ্রান্তিকর। আবার বলছি, সরকার এবং স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশিকা না পাওয়া পর্যন্ত শুটিং শুরু করার কথা কেউ ভাবছিই না। নির্দেশিকা পেলে আলোচনা করে শুটিং শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
ইম্পা-র সভাপতি পিয়া সেনগুপ্তও এই নির্দেশিকার ব্যাপারে কিছুই বলতে পারলেন না। এই কঠিন সময়ে কী ভাবে শুটিং শুরু হবে সে বিষয়ে অন্ধকারে তিনি। ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের তো উল্টো প্রশ্ন, “কবে লকডাউন শেষ হবে আপনি বলতে পারবেন? যদি পারেন তবে আমরা শুটিংয়ের ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত আপনাদের জানাতে পারব।”
কিন্তু যাঁদের নির্দেশিকাকে কেন্দ্র করে এত আলোচনা সেই ডিরেক্টরস’ গিল্ডের সভাপতি অনিন্দ্য সরকার এ ব্যাপারে কী বলছেন? অনিন্দ্যর কথায়: “আমরা তো কোনও অফিসিয়াল নির্দেশিকা পাঠাইনি। অনেক দিন ধরেই শুটিং বন্ধ। তাই লকডাউন উঠলে আবার কী ভাবে নিরাপদে শুটিং শুরু করা যাবে সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে একটি প্রাথমিক খসড়া বানানো হয়েছিল। তবে তা কী ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল তা-ও আমরা জানি না। ঘটনাটায় আমরাও আশ্চর্য এবং বিরক্ত।”
তিনি আরও যোগ করেন, “তা ছাড়া ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসই তো বলে দিয়েছেন এই মুহূর্তে কোনও রকম ভাবে শুটিংয়ের কোনও চান্সই নেই। তাই এ নিয়ে আর কথা এগনোর কোনও মানেই হয় না।”
এই নির্দেশিকা যে একেবারেই অমূলক এবং মেনে চলা প্রায় অসম্ভব সে সুর বারে বারেই শোনা গেল পরিচালক, শিল্পী এবং টেকনিশিয়ানদের কণ্ঠেও। সেই অ্যাডভাইজারি তে মেকআপ আর্টিস্টদের পিপিই কিট পরার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পিপিই কিট পড়ে মেকআপ করা কি আদপে সম্ভব? এ ব্যাপারে মেকআপ আর্টিস্ট মহম্মদ ইঊনুস বলছিলেন, “মেকআপ করা খুব সূক্ষ্ম কাজ। এ ভাবে কাজ করতে গেলে আসল কাজটাই নষ্ট হবে।”
পরিচালক শৈবাল মিত্র যেমন বললেন, “এ ভাবে শুটিং করা কোনও দিনই সম্ভব নয়। এত কিছু গাইডলাইন কী করে মেনে চলব? নিরাপত্তার কথা মাথায় তো রাখতেই হবে। কিন্তু এই যে এত জনের বেশি কাউকে নিয়ে শুটিং করা যাবে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি তা কি সত্যিই মেনে চলা সম্ভব?”
প্রযোজক- পরিচালক-কাহিনিকার সুশান্ত দাস যেমন বলছিলেন, “একটা সিরিয়ালের শুটিং করতে অনেক কর্মী লাগে। সিরিয়ালগুলো বড় ফ্যামিলির গল্প। তিন-চার জন অ্যাক্টর নিয়ে শুট করা সম্ভব নয়। এর বাস্তব ভিত্তি নেই।”
আরও পড়ুন- ছবি ‘চুরি করে’ পোস্ট! তোপের মুখে নুসরত
অ্যাক্রোপলিস সংস্থার অন্যতম প্রযোজক, কাহিনিকার স্নিগ্ধা বসু শুটিং শুরুর বিষয়ে এখনই কিছু ভাবতে চান না। তাঁর মতে, “করোনা ভাইরাস যে ভাবে চরিত্র পাল্টাচ্ছে এখন কিছু ভেবে লাভ নেই। আগে লকডাউন উঠুক। কবে উঠবে তার উপর সমস্ত কিছু নির্ভর করছে। আর তা ছাড়া করোনার পর দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে। স্টুডিয়ো স্যানিটাইজ করতে হবে, সবার স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে হবে। অনেক কাজ।”
শুটিং কবে শুরু হবে, কবে আবার টলিপাড়া মুখর হয়ে উঠবে তা কেউ জানে না। সমস্ত জল্পনা-কল্পনাই আপাতত বিশ বাঁও জলে। তবে এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে প্রযোজক থেকে পরিচালক থেকে বিভিন্ন গিল্ড তাকিয়ে রয়েছে সরকারি নির্দেশিকার দিকে। পেটে টান তো নিশ্চয়ই পড়েছে, কিন্তু স্বাস্থ্যের দিকটাও তো মাথায় রাখতে হবে, তাই আপাতত শুটিংয়ের চিন্তা থেকে পিছিয়ে আসছেন সবাই।
এক দিকে রুজিতে টান, অন্য দিকে সংক্রমণের ভয়, এরই পাশাপাশি শুটিং শুরুর দিনক্ষণ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা। এই দ্বন্দ্বে আপাতত গভীর সঙ্কটে টালিগঞ্জ পাড়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy