‘তালি’ ওয়েব সিরিজ়ে সুস্মিতা সেন। ছবি: সংগৃহীত।
ছেলেটিকে স্কুলে শিক্ষিকা প্রশ্ন করেছিলেন সে বড় হয়ে কী হতে চায়। ছাত্রের সপাট উত্তর, ‘‘আমি মা হতে চাই।’’ ক্লাস জুড়ে সহপাঠীদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু। কড়া জবাবে শিক্ষিকা বুঝিয়ে দিলেন যে, পুরুষেরা কখনও মা হতে পারে না। কিন্তু তা রূপান্তরকামী সমাজকর্মী গৌরী সবন্তের স্বপ্ন ভাঙতে পারেনি। সমাজের বিপরীতে হেঁটে গৌরীর লড়াই কিন্তু সহজ ছিল না। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তালি’ ওয়েব সিরিজ়টি গৌরীর জীবন অবলম্বনেই তৈরি। গৌরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুস্মিতা সেন।
বর্তমান এবং অতীতের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে ছয় পর্বের ওয়েব সিরিজ়ের কাহিনি। সুপ্রিম কোর্টে শুনানির দিন। আদালত চত্বরে গৌরীর মুখে কালি ছেটানো হল! রূপান্তকামীদের তৃতীয় লিঙ্গ রূপে স্বীকৃতির দাবিতে পিটিশন ফাইল করেছিল সে। বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে নিজের জীবনের গল্প বলতে শুরু করে গৌরী। মায়ের সমর্থন থাকলেও ছেলেকে কোনও দিন ‘মেয়েলি’ মেনে নিতে পারেনি গৌরীর পুলিশ অফিসার বাবা। অল্প বয়সে গৃহত্যাগী হয়ে রূপান্তরিতদের সমাজে নিজের জায়গা করে নেওয়া থেকে শুরু করে তাদের ‘আম্মা’ হয়ে ওঠা— গণেশ থেকে গৌরী হয়ে ওঠার দীর্ঘ যাত্রাপথের এই গল্প অবশ্যই অনুপ্রেরণাদায়ক।
সিরিজ় জুড়ে রাজত্ব করেছেন সুস্মিতা। প্রাক্তন ব্রহ্মাণ্ডসুন্দরী অভিনেত্রীর সৌন্দর্যের প্রতীক থেকে রূপান্তরকামীর চরিত্রে রাজি হওয়া নিসঃন্দেহে সাহসিকতার দাবি রাখে। সত্যি বলতে, সিরিজ়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন সুস্মিতা। এই সিরিজ়ে অভিনয়ের আগে বাস্তবের গৌরীর সঙ্গে দীর্ঘ দিন তিনি তাঁর জীবনের গল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন। রূপান্তরকামীদের আদবকায়দা শিখেছেন। পর্দায় তা সুন্দর ভাবে ফুটিয়েও তুলেছেন সুস্মিতা। মাঝেমধ্যে কণ্ঠস্বর বদলে তিনি সংলাপ বলার চেষ্টাও করেছেন। বিশেষ করে লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচারের পর তাঁর সেরে ওঠার পর্বটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। কিন্তু গল্পের কারণেই সুস্মিতার যাবতীয় প্রয়াস মাঠে মারা গিয়েছে। প্রথমত, সিরিজ়ে রূপটান তাঁকে গৌরী হয়ে উঠতে সাহায্য করেনি। গালে হালকা দাড়ির আভাস, জুলপি বা কম বয়সে পরচুলা একটু দৃষ্টিকটু ঠেকেছে। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর সেরাটা দিলেও গভীরতাহীন চিত্রনাট্য সেই অভিনয়কে দর্শক-মনে গেঁথে দিতে পারেনি। গৌরী সবন্ত কি নিজেও এই চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন? সিরিজ় দেখার পর সে প্রশ্নও মনে উঁকি দিয়ে যায়।
সিরিজ়ে অন্যান্য অভিনেতারা চিত্রনাট্যের হাতের পুতুল হয়েই রয়ে গিয়েছেন। তবে মন্দের ভাল, আলাদা করে গৌরীর বাবার চরিত্রে নজর কেড়েছেন নন্দু মাধব। অল্প বয়সের গৌরীর চরিত্রে ক্রুতিকা দেওর অভিনয়ও বেশ সাবলীল। গান এবং আবহসঙ্গীত গল্পে কিছু আবেগপ্রবণ মুহূর্ত তৈরি করলেও তা সিরিজকে উৎরোতে খুব একটা সাহায্য করেনি।
সমকামিতা বা তৃতীয় লিঙ্গের দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করে ইদানীং বলিউড অনেক বেশি সাহসী। সে দিক থেকে ‘তালি’-র মতো ওয়েব সিরিজ়ের জন্য পরিচালক রবি যাদবের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু এই সিরিজ় গৌরীর জীবনের গভীরে আলোকপাত করতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই গল্পের শ্লথ গতি দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, তা কি এপিসোডের সংখ্যা বৃদ্ধির স্বার্থে? ছয় পর্বের ওয়েব সিরিজ়টি দেখে মনে হতে পারে, যে আদপে নির্মাতারা সিরিজ়ের তুলনায় গৌরীর গল্পকে সিনেমার দৈর্ঘ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তা আরও উপভোগ্য হতে পারত। জাতীয় পুরস্কার জয়ী পরিচালকের ঝুলিতে ‘নটরং’ এবং ‘ন্যুড’-এর মতো ছবি রয়েছে। সেখানে এই সিরিজ়ে তিনি কিন্তু গৌরীর জীবনের মূল অধ্যায়গুলোকে ছুঁয়েছেন মাত্র। পরিবর্তে ভারী ভারী সংলাপ গল্পের সাবলীলতা নষ্ট করেছে। ফলে সেখানে চিত্রনাট্যে রূপান্তরকামী সমাজের প্রকৃত চিত্র রয়ে গিয়েছে অধরা। তাই এই রকম একটা সিরিজ়ের জন্য মনের গভীর থেকে করতালি বাজাতে ইচ্ছা হলেও তার শব্দ খুব বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy