সত্যজিতের স্মরণে লিলি
সত্যজিৎ রায়ের থেকে প্রথম ডাক পাই ‘অপুর সংসার’-এর সময়ে। অপূর্বের স্ত্রী অপর্ণার চরিত্রে। তখন আমার বিশাল লম্বা চুল। আমাকে দেখে খুব পছন্দ হয়েছিল মানিকদার। তখন ওঁরা লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে থাকতেন। আমার অত চুল ভীষণ যত্ন করে বেঁধে দিয়েছিলেন বিজয়া বৌদি, সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী। ডুরে শাড়ি পরিয়ে মানিকদা অনেক ছবিও তুলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, আমি যাকে আগে বেছেছি, তার স্কুলে কিছু সমস্যা হলে তোমায় ডাকব। আমার তোমাকেও পছন্দ হয়েছে। পরে জেনেছিলাম, মানিকদার প্রথম পছন্দ ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। সমস্ত সমস্যা মিটে যাওয়ায় সে যাত্রায় আমার আর কাজ করা হয়নি।
আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম অন্য ছবির কাজে। তখন আমি মুম্বইয়ে। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আলাপ’ ছবিতে অভিনয় করছি। তার আগে হৃষিদার সঙ্গে কাজ করেছি ‘চুপকে চুপকে’ ছবিতে। সেই সময় হঠাৎই মানিকদার একটি চিঠি পেলাম। ওঁর ‘জন অরণ্য’ ছবির জন্য আমাকে বেছেছেন!
মুম্বইয়ে বসে সত্যজিৎ রায়ের ডাক পাওয়া মানে বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। হৃষিদাকে বলতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিয়ে দিলেন, ‘আগে সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করো’। আমিও ফিরে এলাম কলকাতায়।
পরের দিন সকালে গেলাম মানিকদার সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখেই বৌদির প্রথম কথা, ‘অত চুল ছিল তোমার! কোথায় গেল?’ বললাম, চড়া লাইট, মেক আপ এ সবেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। শুনে মানিকদা বললেন, আমি কিন্তু পরচুলা পরতে দেব না। আমিও সায় দিলাম তাতে। কিছুক্ষণ পরে আবার নিজেই বললেন, ‘‘ফুলেশ্বরী’তে তো তোমার অনেক চুল দেখেছিলাম!’ আমি জানালাম, ওটা পরচুলা ছিল। সামনের দিকে চুল উঠে পাতলা হয়ে গিয়েছে। তাই ওই অংশটুকু ঢেকে দিয়েছিলেন পিয়ার আলি। শুনে মানিকদা অনিলবাবুকে বললেন, ‘আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার মতো পরচুলা বানিয়েছেন যিনি শিগগিরি তাঁকে ডেকে নিয়ে আসুন।’ পিয়ার আলি আবারও আমার জন্য পরচুলা বানালেন। সেটা পরে সেটে যেতেই দেখি মানিকদা ঘুরেফিরে দেখতে আসছেন। আসলে, উনি সব কিছু স্বাভাবিক চাইতেন। পরচুলা পরেছি। মনটা খুঁতখুঁত করছিল। তাই বারেবারে দেখছিলেন। পরে নিজেই বললেন, ‘খারাপ লাগছে না। ঠিক আছে।’
এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা ধরে রাখার জন্য সত্যজিৎ আলাদা করে ডাবিংও করতেন না। বদলে স্টুডিয়ো ফ্লোরে যাতে কোনও শব্দ না হয় সে দিকে নজর রাখতেন। একটি কুকুরও সেখানে থাকতে পারত না। তাই সত্যজিতের ছবির শ্যুটিং শেষ মানে সমস্ত কাজ শেষ।
আমিও শ্যুট শেষ হতেই ফের মুম্বইয়ে। হৃষিদার ছবির কাজ শেষ করার জন্য। দিন কয়েক পরেই প্রদীপ মুখোপাধ্যায় এলেন। জানালেন, অল্প শব্দ এসেছে একটি দৃশ্যে। সেটা ডাব করতে হবে। মুম্বইতেই হল ডাবিং। ডাবিংয়ের দিন মানিকদা, বৌদিও ছিলেন। কাজ ফুরোতেই হোটেলে গিয়ে এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া হল। আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওঁরা চলে গেলেন।
‘আলাপ’-এর কাজ শেষ হতে আমি আবার কলকাতায়। ছবির পাশাপাশি মঞ্চে দু দফায় অভিনয় করছি। এক দিন শো করে বাড়ি ফিরেছি। রাত ১০টা নাগাদ ফোন সত্যজিতের। তখন ফোন ধরতে গেলে বাড়ির দ্বিতীয় তলায় উঠতে হত। কে না কে ফোন করেছে ভেবে ইচ্ছে করেই আর ধরতে যাইনি। মিনিট ১৫ পরে দেখি আবার ফোন বাজছে! এ বার ফোন ধরতেই আমাকে বলা হল, মানিকবাবু আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আনন্দে, আশায় বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। আবার কি তা হলে কাজের সুযোগ আসছে? মানিকদা বললেন, অনেক দিন দেখিনি তোমায়। আমার বাড়িতে আসতে পারবে? মানিকদারা তখন বিশপ লেফ্রয় রোডে চলে এসেছেন। যেতেই নিজেই দরজা খুলে সাদর অভ্যর্থনা। এ বার ডেকেছেন ‘শাখা-প্রশাখা’র জন্য। নিজেকে প্রচণ্ড সৌভাগ্যবতী মনে হল। প্রথম ছবির ১৫ বছর পরে ফের ডাকলেন মানিকদা। ১৫ বছর ধরে উনি মনে রেখেছেন আমাকে!
দেখা মাত্র প্রথম কথা, ‘শুনলাম তুমি নাকি মোটা হয়ে গিয়েছো? আমার চোখে তো ঠিকই লাগছে।’ আমায় যত্ন করে বসিয়ে বললেন, বিজয়া আসছে। তোমার সঙ্গে দেখা করবে। আর ৫ জন গৃহকর্তার মতোই তাঁর প্রশ্ন, ‘চা খাবে?’ আমি রাজি হতেই বিড়ম্বনার এক শেষ। দেখি, মানিকদা নিজে উঠে চায়ের জন্য ভিতরে বলতে গেলেন! লজ্জা পাওয়ার পাশাপাশি অবাকও হয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক মানের এক পরিচালক নিজে গিয়ে চায়ের বন্দোবস্ত করছেন! বৌদি আসতে তাঁর সঙ্গে কথা হল। ওঁরা পছন্দ করলেন আমায়। বললেন, ‘হাতে এখনও ৪ মাস সময় আছে। চাইলে অল্প রোগা হতে পারো। তবে বেশি রোগা হয়ে যেও না। বাড়ির বড় বৌ বেশি রোগা হলে দেখতে ভাল লাগবে না।’
মানিকদা নিজে হাতে দরজা খুললেন। এমনকি নীচু হয়ে দরজার নীচের ছিটকিনিটাও। আমাকে বলতেই পারতেন। কিন্তু সেটা করলেন না। উল্টে বললেন, ‘আমার জন্য বাড়িতে লিফট বসানো হয়েছে। এ বার থেকে তুমি ওতে চড়ে ওঠানামা করবে। ‘জন অরণ্য’-তে কাজের সময় মানিকদা নিজেই ক্যামেরা সামলাতেন। ‘শাখা প্রশাখা’র সময় দেখলাম, শরীরের খাতিরে সে টুকুই শুধু ছেড়ে দিয়েছেন।
১৫ বছরে আর কোনও বদল নেই খ্যাতি স্পর্শ করা ওই পরিচালকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy