‘বিশ সাল বাদ’ ছবির শ্যুটিং ফ্লোরে হেমন্তদা খুব কম আসতেন। ছবির জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল। হেমন্তদা গ্রামেগঞ্জে অনুষ্ঠান করে সেই টাকা ছবির জন্য জোগাড় করতেন। ফাইল চিত্র।
আমার জীবনে হেমন্তদা ছিলেন বটগাছের মতো। ওঁকে আমি ‘মেজদা’ বলে ডাকতাম। যাঁর ছায়ায় বলিউডের ছবির জগতে আমার পথ চলা শুরু। তখন কলকাতার মঞ্চে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটক করছি। মাঝে মাঝে মুম্বই যাচ্ছি নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।
গুরু দত্ত ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এ আমার অভিনয় দেখেন। সেই দিন গ্র্যান্ড হোটেলের এক পার্টিতে আমাকে মুম্বইয়ে আসার কথা বলেন। ঠিক হয় ওঁর ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে ভূতনাথের চরিত্র আমি করব। উনি মুম্বইয়ে সব শিল্পীর সঙ্গে আমাকে ভূতনাথ বলেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মীনা কুমারী, ওয়াহিদা রহমান আমাকে গুরু দত্তের ছবির ‘হিরো’ বলেই জানতেন। শেষ পর্যন্ত আমার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে অভিনয় করা হয়নি।
‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্তদা। গুরু দত্তকে উনি আমার থেকে বেশি চিনতেন। আমি গুরু দত্তের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করছি শুনে চমকে ওঠেন। এই চুক্তিতে আমি রাজি হলে পাঁচ বছর আমি আর কোনও ছবিতে কাজ করতে পারব না, এটা দাদা জানতেন। এ দিকে, গুরু দত্তের ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, এটাই আমার কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। ভাবনা চিন্তা করার সময় পাইনি। মুম্বইয়ে অনেকেই জানতেন, গুরু দত্ত ছবি বানিয়ে ফেলে রাখতেন। কোনওটা রিলিজ হত, কোনওটা পড়ে থাকত। হেমন্তদা চাননি পাঁচ বছর আমার কেরিয়ার আটকে থাকুক। আমাকে গুরু দত্তর ছবিতে কাজ করতে বারণ করেন।
শেষ পর্যন্ত গুরু দত্তকে জানিয়ে দিই, ওঁর ছবিতে কাজ করতে পারব না। সে দিন মেজদার কথা শুনে ঠিকই করেছিলাম।
এর কয়েক মাস পরের ঘটনা। রংমহলে নাটক করছি, ব্যাকস্টেজে দেখি হেমন্তদা বসে আছেন। সে দিনই আমাকে ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দিলেন। হেমন্তদার একটা শর্ত ছিল।ওঁর ছবিতে অভিনয় করতে হলে আমাকে মঞ্চের অভিনয় ছাড়তে হবে।
মুম্বইয়ের ছবির জগতে আমার কাজ শুরু হল।
‘বিশ সাল বাদ’ ছবির শ্যুটিং ফ্লোরে হেমন্তদা খুব কম আসতেন। ছবির জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল। হেমন্তদা গ্রামেগঞ্জে অনুষ্ঠান করে সেই টাকা ছবির জন্য জোগাড় করতেন। শুধু টাকার জন্য অসুস্থ শরীরেও অনুষ্ঠান করতে ছুটতেন। এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে, ভাল করে বসতে পারতেন না। একটা বালিশের ওপর বসে গান গাইতেন।
‘বিশ সাল বাদ’ আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এক বার গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছিলাম। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। জ্ঞান ফিরতেই দেখি মাথার কাছে ধুতি-শার্ট পরা লম্বা লোকটা দাঁড়িয়ে!
আমার কোনও ক্ষতি হতে পারে এ রকম কিছু দেখলেই আগে থেকে আমাকে সাবধান করে দিতেন হেমন্তদা। ছবির জগতেই এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। হঠাৎ এক দিন হেমন্তদা আমাকে ডেকে বললেন, ‘‘ওঁর সঙ্গে কথা বলবি না। ও তোর ক্ষতি করতে চায়।’’ হেমন্তদা ঠিকই বলেছিলেন, পরে সেটা বুঝতে পারি।
হেমন্তদা জন্মদিন পালন করতে চাইতেন না। ওঁর জীবদ্দশায় ঘটা করে কখনও জন্মদিন পালন হয়নি। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর ওঁর বাড়িতে পার্টির আয়োজন করতেন। ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই ওই পার্টিতে আমন্ত্রণ পেতেন। হেমন্তদা পার্টিতে একটা পানীয়ের গ্লাস হাতে ঘুরে বেড়াতেন,ওই গ্লাস থেকে মদ খেতে দেখিনি কখনও।
একটাই আক্ষেপ, আমি অনেক গান গেয়েছি, কিন্তু হেমন্তদার সুরে কোনও গান গাওয়া হল না। মেজদা প্রায়ই বলতেন, ‘‘বিশ্বজিৎ, তোর জন্য একটা গানের সুর করব ভাবছি।’’ সেই গান আর তৈরি হল না।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy