‘উত্তম’ মানে ভাল, তাই উত্তম কুমারকে ‘ভাল কাকু’ ডাকতেন তাঁর ভাইঝি শর্মিষ্ঠা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমার ‘ভাল কাকু’! যৌথ পরিবারে বাড়ির বড় মেয়ে যে নাম ধরে কাকা-জ্যাঠাদের ডাকে সেই নামেই ছোটরা সেই মানুষকে ডাকতে আরম্ভ করে।বাঙালি পরিবারে এমন হয়েই থাকে। আমার জেঠতুতো দিদি উত্তমকুমারকে ‘ভাল কাকু’ বলতো, সেই দেখাদেখি আমিও। ‘উত্তম’ মানে ভাল, তাই ‘ভাল কাকু’।
আমার যখন জন্ম হয় তখন ভাল কাকু ‘হারানো সুর’ করে ফেলেছে। সকলের কাছে সুপারহিট নায়ক তিনি। ভাল কাকু গিরীশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে এলে গাড়ির দরজা খুলে দেয় পাড়ার মুচি। তখন ভাল কাকু গাড়ি থেকে নেমেই এক গোছা নোট দিয়ে রোজ তাঁকে খুশি করে। সে এক উজ্জ্বল ভাল কাকু! তাঁর চারপাশে আলো!
দুর্গাপুজোর পরে যত বার রীতি মেনে প্রণাম করতে গিয়েছি, দেখেছি ভাল কাকুর কী সুন্দর ধবধবে ফর্সা নিটোল পায়ের আঙুল! ছবিটা আজও চোখের সামনে ঘোরে। গিরীশ মুখার্জি রোডে আমাদের পাশাপাশি বাড়ি। ছোট থেকেই দেখছি ওঁদের বাড়িতে ভাল কাকুর জন্মদিনে কত লোক! গৌতমের জন্মদিনে কত হুল্লোড়। আমরা তো ছোট ছিলাম তাই ভাল কাকুর জন্মদিনে আমাদের যাওয়ার নেমন্তন্ন থাকত না। ভাল কাকু এমনি হাসিখুশি হলে কী হবে রাগলে কাউকে চিনতো না! এত যে ছবি করেছে, বাড়ির মেয়েরা দম বেঁধে সব ছবির প্রিমিয়ারে যাবে, এ সব কোনও দিন পছন্দ করত না ভাল কাকু। এক বার শুধু ‘বনপলাশীর পদাবলী’ দেখতে আমাদের বিজলি সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে ভাল কাকু নববর্ষে যে জলসা করতেন সেখানে মঞ্চে নানা গুণীজনকে মালা, চন্দন পরাতে আমাদের মতো ছোট মেয়েদের ডাক পড়ত।
ভাল কাকু মুম্বই গেলেন রাজেশ খন্না, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ছবি করতে। ওই একটাই ছবি করলেন তখন
আমার মনে আছে, আমি আর আমার জেঠতুতো দিদি ও রকম এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে চন্দন পরিয়েছি, ভাল কাকু আমাদের গাল টিপে আদর করেছে। অনুষ্ঠান শেষ ভাল কাকু পেছনের গেট দিয়ে তো উধাও! আমরা সামনের গেট দিয়ে বাবার সঙ্গে বেরোচ্ছি, ওমা! সবাই আমাদের গালে হাত বোলাচ্ছে! কী ব্যাপার? সকলে বলছে, “ওই গালেই তো গুরুর হাতের ছোঁয়া আছে।”
তবে যত আদরই করুক না কেন, ভাল কাকুর জন্মদিনে আমরা কোনও দিন যেতাম না। বড়রা বলতেন, ‘‘ওখানে খানাপিনা সব বড়দের ব্যাপার।’’ আমরা গৌতমের জন্মদিনে যেতাম। এই সব শাসন আমাদের পরিবারে ছিল। তবে হুল্লোড়ের দিন কিছু কম ছিল না। লক্ষ্মীপুজোর দিন ভাল কাকু নিজে পুজোর আসনে বসত। তখনকার ইন্ডাস্ট্রি পাড়ার কে না এসেছে ওই দিনে? আমার বন্ধুরা ভাল কাকুকে দেখার জন্য লক্ষ্মীপুজোয় নেমতন্ন পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকতো। বুঝতে পারতাম আমাদের ভাল কাকু বাঙালির কতখানি আদরের, কৌতূহলের নায়ক ‘উত্তমকুমার’ হয়ে উঠেছেন।
গৌরীদেবীকে আমরা ‘ই’ বলে ডাকতাম। ওই যে ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে বেশ জোরে ‘গৌরী-ইইই’ এই ডাকটা ঘুরে বেড়াত। সেখান থেকেই ‘ই’।
একটু একটু করে বড় হলাম। বুঝলাম, ভাল কাকুর দুটো সংসার। সকালে কাজ শুরুর আগে ‘ন দিদা’-র (উত্তমকুমারের মা) কাছে যেত। তার পর ‘ই’-র কাছে যেত, কথা বলত। গৌরীদেবীকে আমরা ‘ই’ বলে ডাকতাম। ওই যে ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে বেশ জোরে ‘গৌরী-ইইই’ এই ডাকটা ঘুরে বেড়াত। সেখান থেকেই ‘ই’। গৌতম তখন দার্জিলিংয়ে পড়তে গিয়েছে। এর পর ভাল কাকু স্টুডিয়োপাড়ায় সারাদিন কাজ করে ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে চলে যেত। এ বাড়ি আসতো না আর কোনওদিন। এ রকমই দেখেছি বরাবর।
এক বার বাড়ির ছোটদের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল ভাল কাকু। ওখানেই সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে আমার পরিচয়। কী আন্তরিকতা। চমৎকার অতিথি আপ্যায়ন! প্লেট ভর্তি লুচি তরকারি এগিয়ে দিয়েই বললেন, “জিলিপি খাবে? আমিও খুব জিলিপি খেতে ভালবাসি!” কে বলবে অত বড় স্টার! আমার বয়স হয়েছে, অনেক কিছু শুনেছি উত্তম-সুপ্রিয়াকে নিয়ে। আমি তো গিরীশ মুখার্জির বাড়ির, ভাল কাকুর বাড়ির মেয়ে, কিন্তু এটুকু বুঝি, সুপ্রিয়া দেবী খুব যত্ন করে রাখতেন ভাল কাকুকে।
ভাল কাকু মুম্বই গেলেন রাজেশ খন্না, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ছবি করতে। ওই একটাই ছবি করলেন তখন। খুব একটা বোধ হয় মনের মতো কাজ হল না মুম্বই থেকে ফিরে এলেন। তখন গৌতমকে ভাল কাকু, বিবেকানন্দ রোডে ওষুধের দোকান করে দিয়েছে। সেখানেও ব্যবসা সে ভাবে চলছে না। আরও কিছু সমস্যা ছিল। সবটা তো বুঝতে পারতাম না। ও রকম সময়েও সুপ্রিয়া দেবী ভাল কাকুর পাশে ছিলেন। গৌরী দেবী অনেক সময় অসুস্থ থাকতেন, ভাল কাকুর কী যত্ন নেবেন? নিজের এত শরীর খারাপ! তবে ভাল কাকু কিন্তু বিয়ের তারিখে, জন্মদিনে প্রত্যেক বার গৌরীদেবীকে বেনারসি শাড়ি, সোনার গয়না উপহার দিতেন। শুধু কি তাই, আমাদের পরিবারে কারও বিয়ে হলে ভাল কাকু সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত। আমার বিয়ের সময় যেমন আমার বাবাকে বললেন, “ কী লাগবে বল!” বাবা বলেছিল, “কিচ্ছু না, শুধু তুই থাকিস।” আমার বিয়েতেও সেই বেনারসি উপহার এল। ভাল কাকু খুব বেনারসি শাড়ি ভালবাসত।
ছবির শুটে উত্তম-সুপ্রিয়া
বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল! আমাদের পরিবারে সবার কাছেই ওই দিনটা একটা কালো দিনের মতো! ভাল কাকু যে দিন ময়রা স্ট্রিটে চলে যায় সে সময় কেউ ফিরে ডাকেনি ওঁকে। পরে আমার বাবা গিয়েছিল ওকে ফিরিয়ে আনতে, আসেনি ভাল কাকু। আজ জীবনের অনেকখানি পেরিয়ে এসে পরিবারের এক মানুষকে, আমার আত্মার আত্মীয়কে যখন তারার আলোয় নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে দেখি, মনে হয় ভাল কাকু সর্বত্র আছে। তখন মনে হয়, নিজের জীবনের শান্তির আশ্রয়টুকু খুঁজে পেতে নিজে ভাল করে বাঁচার জন্য ভাল কাকু যা করেছে তা-ই গ্রহণযোগ্য!
ভাল কাকুর জন্মদিনে বহু বছর বাদে আমাদের পরিবারে আর এক পুরুষ জন্ম নিয়েছে। হ্যাঁ, একই দিনে! সে আমার দ্বিতীয় সন্তান। আবছায়া মনে আজও শিউরে উঠি, ‘ও ভাল কাকু, এ রকমও হয়!”
(লেখক সম্পর্কে উত্তমকুমারের ভাইঝি)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy