বাংলা ধারাবাহিকের একটি চল নিয়ে কথা বললেন উষসী চক্রবর্তী, অপরাজিতা আঢ্য, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, রণজয় বিষ্ণু। ছবি: সংগৃহীত।
স্বামীর নাম মুখে আনা নাকি পাপ! তাই এক কালে বঙ্গবধূরা ‘ওগো শুনছ’ সম্বোধনের উপর ভরসা করে এসেছেন। স্বামীর পরিচয় দিতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন সন্তানের পিতার পরিচয়।
তবে মিলেনিয়াল বা জেন জ়ির অভিধানে এই সব সম্বোধন নেই। কারণ, তাদের অন্তত দুই প্রজন্ম আগে থেকেই স্বামীর নাম ধরে ডাকার প্রচলন রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুই-তোকারির সম্বোধনও ইদানীং খুব স্বাভাবিক, কারণ নতুন প্রজন্মের সম্পর্কের অন্যতম ভিত— বন্ধুত্ব। কিন্তু বাংলা ধারাবাহিকে গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে এক অন্য ধারা। নাম ধরে সম্বোধন তো দূর, ‘ওগো’ বা ‘হ্যাঁগো’-ও নয়। বাংলা ধারাবাহিকের নায়কদের নায়িকারা ডাকছেন ‘অমুক বাবু’, ‘তমুক স্যর’ অথবা দাদা সম্বোধনে। সঙ্গে তো রয়েছেই আপনি সম্বোধন।
টিআরপি তালিকায় প্রথম পাঁচে থাকা ধারাবাহিকে এই ধারা দেখা যায়। যেমন ‘ফুলকি’ ধারাবাহিকে নায়িকা তাঁর স্বামীকে সম্বোধন করেন ‘রোহিত স্যর’ নামে। ‘কোন গোপনে মন ভেসেছে’ ধারাবাহিকেও নায়ককে ডাকা হয় ‘অনিকেত স্যর’ নামে। একই চল ‘কথা’ ধারাবাহিকে— সেখানে নায়িকা তাঁর স্বামীকে ডাকে ‘পাচক মশাই’ বলে, কারণ নায়ক সেখানে একজন শেফ। ‘রোশনাই’ ধারাবাহিকে নায়ককে নায়িকা সম্বোধন করেন ‘স্যরজি’ বলে। এক কালের অতি জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘মিঠাই’-এর ‘উচ্ছেবাবু’ ডাক তো প্রায় সকলেরই জানা। ধারাবাহিকের জগতে তিন বছর ধরে বিরাজ করা ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ ধারাবাহিকের নায়িকা বছরের পর বছর তাঁর স্বামীকে ডাকছে ‘ডাক্তারবাবু’ বলে। এমনকি স্বামীর আপত্তি সত্ত্বেও তাকে নাম ধরে ডাকতে পারেনি সে। এখন মেয়েরা বড় হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ‘ডাক্তারবাবু’ বদলায়নি।
কিন্তু খুব আগের কথা নয়, ‘শ্রীময়ী’, ‘অন্দরমহল’, ‘বিন্নি ধানের খই’, ‘তোমায় আমায় মিলে’, বা ‘রাশি’র মতো ধারাবাহিকে অনায়াসেই নায়ককে তার নাম ধরে সম্বোধন করতেন নায়িকারা। সে বয়সের ব্যবধান যেমনই থাকুক। বাস্তবে দাম্পত্যে যেমন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, তেমনই পর্দায় উঠে আসত। কিন্তু হঠাৎই বদলে গেল সেই ধারা।
নায়ক কখনও শিক্ষক, কখনও কোনও অফিসের বস্, কখনও মিষ্টির দোকানের মালিকের নাতি। এক ছাদের তলায় স্বামী-স্ত্রী হিসাবে থাকলেও, নায়িকার চোখে নায়ক যেন সেই শিক্ষক, বস্ অথবা দোকানের মালিক। নাম মুখে আনা যাবে না। তাই নায়কের পেশাকেন্দ্রিক নামই চলুক! সঙ্গে রয়েছে আপনি সম্বোধন। যেখানে বাস্তবে সমাজ এগোচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীরা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠছে। সংসারের সবটা সমান ভাগে ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে ধারাবাহিকে নায়ককে উল্লিখিত নামে সম্বোধন করে রাখার অর্থ নিজেকে নত করে রাখা নয়? প্রশ্ন রেখেছিল আনন্দবাজার অনলাইন।
উত্তরে উষসী চক্রবর্তী বলেন, “আমার কিন্তু এই ধরনের সম্বোধন বেশ মিষ্টি লাগে। হতে পারে এখন এটাই ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কী? এখানে পুরুষতন্ত্র কোথাও নেই। এ তো মিষ্টি সম্পর্ক। বয়সে বড় হলে তো এমন সম্বোধন করাই যায়। তেমন হলে তো বয়সে বড় নায়িকা দেখাতে হবে গল্পে। যেখানে নায়ক ‘অমুকদি’ বলে ডাকবে নায়িকাকে। তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সেটার জন্য তেমন গল্প প্রয়োজন। আর সব কিছুকে যদি নারীবাদ আর ‘পলিটিকালি কারেক্টনেস’ দিয়ে বিচার করি, জীবন থেকে রোম্যান্স হারিয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, বয়সে বড় নায়িকা দেখানোও যেতে পারে ধারাবাহিকে। এই সম্বোধনগুলো কিন্তু প্রেম ও শ্রদ্ধা থেকেই আসছে। কোথাও পিতৃতন্ত্র দেখতে পাচ্ছি না।”
তবে অন্য সুর অপরাজিতা আঢ্যের কথায়। ধারাবাহিকের অধিকাংশ দর্শক মহিলা। মহিলারাই পুরুষতন্ত্রের আওতায় থাকতে পছন্দ করেন। এমনই মনে করেন অপরাজিতা। তাঁর স্পষ্ট মত, “হ্যাঁ, এটা একটা ট্রেন্ড। ধারাবাহিক কিন্তু মহিলারাই দেখতে ভালবাসেন। তাঁরা হয়তো পছন্দ করেন যে, নায়িকারা নায়ককে এই ধরনের সম্বোধন করুক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলারা অনেক নীচের দিকে থাকুক, মহিলাদের সম্মান নষ্ট হোক। মহিলারাই হয়তো এটা দেখতে পছন্দ করেন। আমার খুব অসম্মানজনক লাগে এই বিষয়টা। কিন্তু মানুষ পছন্দ করে বলেই এই ধরনের ধারাবাহিক তৈরি করা হচ্ছে। সমাজকে এই ধারাবাহিক পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজ এমনিতেই পিছিয়ে রয়েছে বলেই এ সব পছন্দ হচ্ছে। সমাজে আবার ভাল পরিবর্তনও কিছু হয়েছে। কিন্তু ধারাবাহিকের এই ট্রেন্ড মহিলাদেরই পছন্দ হচ্ছে।”
অভিনেতা রণজয় বিষ্ণুর দাবি, এই ধরনের সম্বোধন দিয়ে তৈরি ট্রেন্ডের যে প্রভাব রয়েছে সেই বিষয় কখনও ভেবে দেখেননি। তাঁর কথায়, “ধারাবাহিক সাধারণত নারীকেন্দ্রিক হয়। মহিলারাই সবটা করেন। সেটা ভাল এক দিক দিয়ে। তার কারণ গ্রামগঞ্জের মহিলারা দেখে অনুপ্রাণিত হন। মনোরঞ্জনের মাধ্যমে হোক বা অতিনাটকীয়তা দেখিয়ে হোক— যে কোনও ভাবেই তাঁদের এই ধারাবাহিক অনুপ্রেরণা দেয়। নায়িকাই প্রধান। নায়ককে ধারাবাহিকের প্রধান পার্শ্বচরিত্র হিসাবে দেখি। নায়ক আসলে নায়িকার ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ এবং বয়সে অনেকটা বড়। কাছাকাছি বয়সের প্রেম খুব কমই দেখানো হয়। দেখা যায়, নায়িকার থেকে বয়স ও কাজে অনেকটাই অভিজ্ঞ নায়কের চরিত্র। দেখা যাচ্ছে সেই কাজের জগতেই নায়িকা এগোতে চাইছে। তাই সম্মান দিতেই এই সম্বোধনগুলি করা হয়।”
ফের এক নতুন ধারাবাহিকে ফিরছেন সুদীপ মুখোপাধ্যায়। যদিও ধারাবাহিকপ্রেমীরা তাঁকে ‘অনিন্দ্যদা’ নামেই বেশি চেনেন। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “এটা একটা মিষ্টি ডাক। স্ত্রী হয়তো স্বামীকে মিস্টার ব্যানার্জি বলে ডাকছেন। সেটাই হয়তো আদরের ডাক। আর ‘বাবু’ ডাকের মধ্যে আদর রয়েছে। আমার স্ত্রীও তো আমাকে ‘বাবি’ বলে ডাকেন। তা ছাড়া বাস্তবের জীবনের থেকে পর্দার গল্পে কিছু তো পার্থক্য থাকবেই। না হলে মানুষের আগ্রহ তৈরি হবে কেন? এটা একটা নতুন ট্রেন্ড হতেই পারে। ধারাবাহিকের প্রভাব তো রয়েছেই। মানুষ খুব মন দিয়ে দেখে ধারাবাহিক। একাত্ম হয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু এই সম্বোধন তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আর লিঙ্গসাম্য অনেক বড় বিষয়। পুরুষ ও নারী পরস্পরের পরিপূরক। আমরা বলি পিতৃতান্ত্রিক দেশ। আবার বলি দেশমাতৃকা। পুজোর ক্ষেত্রেও দেবীদের বেশি রমরমা। কিন্তু বাস্তবে আবার অন্য রকম। আমরা আসলে অদ্ভুত একটা সমাজে বাস করছি।”
ধারাবাহিকের দর্শকের সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। নির্দিষ্ট সময়ে আজও বসার ঘরে টিভির সামনে জড়ো হয় পরিবার। অথবা ট্রেনে-বাসে যাতায়াতের পথে মোবাইল ফোনে ওটিটি-তে প্রিয় ধারাবাহিক দেখে নেয় দর্শক। নতুন ধারা তৈরি হলেও কোনও বাধা আসে না। গল্প ভাল হলেও যে কোনও ধারা গ্রহণ করতেই তাঁরা রাজি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy