গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
খুলছে শুটিং ফ্লোর। সাধারণের জন্য বন্ধ হচ্ছে স্টুডিয়োপাড়ার দরজা। পাস না দেখালে আর ঢোকা যাবে না স্টুডিয়োপাড়ায়। মিডিয়ার প্রবেশও নিষেধ। খুলছে কমিউনিটি কিচেন। বন্ধ হচ্ছে শিশুদের প্রবেশ। টলিপাড়ার নিয়মঘেরা দুর্গে টহল দিল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
একেবারে নতুন ভাবে ফিরছে টলিউড। যে টলিউডে গায়ে গায়ে ঘেঁষে আড্ডা দেওয়া নেই, খাবার শেয়ার করা নেই। একসঙ্গে মেকআপ রুম ভাগ করা নেই। থাকার মধ্যে রয়েছে আড়াই মাস ক্ষতির ক্ষত, ঘুরে দাঁড়ানোর একবুক আশা। বাকি আর পাঁচদিন। তারপরেই ‘রাণী রাসমণি’, ‘কৃষ্ণকলি’, ‘শ্রীময়ী’, ‘কোড়াপাখি’, ‘মোহর’, ‘প্রথমা কাদম্বিনী’, ‘জয় বাবা লোকনাথ’দর্শকের বেডরুমে।
কোন ধারাবাহিক কখন শুরু হচ্ছে?
যে ভাবে ক্ষতির মুখ দেখেছে টলিউড তাতে প্রযোজনা সংস্থাগুলি আদপে প্রথম দিন থেকেই সমস্ত ধারাবাহিকের শুটিং শুরু করবে নাকি এক একটি প্রযোজনা সংস্থা থেকে বিশেষ বিশেষ ধারাবাহিকের শুটিং শুরু হবে? এসভিএফ প্রযোজনা সংস্থা থেকে জানা গেল, তাদের প্রযোজনায় আপাতত ‘ত্রিনয়নী’, ‘জয় বাবা লোকনাথ’, ‘দুর্গা দুর্গেশ্বরী’, ‘প্রথমা কাদম্বিনী’ ধারাবাহিকের শুটিং শুরু হতে চলেছে। অন্য দিকে ম্যাজিক মোমেন্টস প্রযোজনা সংস্থার অন্যতম কর্ণধার এবং চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায় এ ব্যাপারে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, নির্দেশ অনুযায়ীআপাতত‘শ্রীময়ী’, ‘কোড়াপাখি’ এবং ‘মোহর’,তাঁদের প্রযোজনার এই তিন ধারাবাহিকের শুটিংই দশ তারিখ থেকে শুরু হতে চলেছে। প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফ এর কর্ণধার মহেন্দ্র সোনির কথায়, “রাতারাতি এই ভাইরাস চলে যাবে না। তাই করোনাকে নিয়েই বাঁচতে হবে আমাদের। সুরক্ষাবিধির কথা মাথায় রেখেই যে ভাবে ফেডারেশন, আর্টিস্ট ফোরাম সহ বিভিন্ন সংগঠনগুলি এবং মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস আবারও শুটিং শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে আমি খুশি। সুরক্ষা মেনে আবার কাজে ফিরতে আমি এবং আমার টিম মুখিয়ে রয়েছি।”
বয়স্করা কি কাজে আসতে চাইছেন
করোনাকালে বাদ পড়ছেন কি যৌথ পরিবারের পিসিদিদা, ঠাম্মা-দাদু? বাংলা ধারাবাহিকের বেশিরভাগই যে পরিবারকেন্দ্রিক। অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন প্রোডিউসারস-এরসভাপতি, পরিচালক শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “সাবিত্রীদি, মাধবীদি, মন্টুদা, প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত ভাবে আবার কাজে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।” ইন্ডাস্ট্রির প্রবীণ অভিনেতারা নিজেদের ‘বুড়ো’ ভাবতে মোটেই রাজি নন। ইন্ডাস্ট্রির বাকিদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে আবারও কাজে যোগ দিতে মুখিয়ে তাঁরা। তবে তাঁদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রযোজনা সংস্থাগুলি থেকেও মানা হচ্ছে বেশ কিছু নিয়মকানুন। প্রবীণদের যাতে শুটিংয়ে এসে বেশিক্ষণ বসে থাকতে না হয় সে দিকেও কড়া নজর রেখে একটানা কাজ করে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এখানেই শেষ নয়, যে যে দিন বয়স্ক অভিনেতাদের শুট থাকবে সেই সেই দিন আরও ভাল করে স্যানিটাইজ করা হবে শুটিং ফ্লোর। তবে করোনায় মৃত্যু হলে অভিনেতা এবং কলাকুশলীদের জন্য যে ২৫ লক্ষ টাকার বিমার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেই আওতায় থাকছেন না বয়স্করা।আর সেই কারণেই এসেছে মুচলেকার প্রসঙ্গ। সব প্রবীণ অভিনেতার জন্য তৈরি হবে নথিপত্র, সেখানে সই করে তাঁদের কাজে যোগ দিতে হবে।
'কোড়াপাখি' ধারবাহিকের একটি দৃশ্য
ব্যবস্থা করা হতে পারে কমিউনিটি কিচেনের
মাস্ক পরে শিল্পীকে শট বোঝাতে কাছে গিয়েও পরমুহূর্তেই সরে আসছেন পরিচালক। শুটের ফাঁকে সহ-অভিনেতার গলা জড়িয়ে সেলফি তুলতে গিয়েও থমকে যাচ্ছেন নায়িকা। একটু ফাঁক পেয়ে সিগারেটটা জ্বালাতে গিয়েই মনে পড়ে যাচ্ছে, বারণ রয়েছে। এর আগে শুটিং ইউনিটে সকলের খাবার ব্যবস্থা করত প্রযোজনা সংস্থা। কিন্তু এখন তা আর নিরাপদ নয়। সে জন্যই ঠিক হয়েছে যে অভিনেতা-টেকনিশিয়ানরা বাড়ি থেকে খাবার আনতে চান, তাঁরা তা করতে পারেন। কিন্তু যাঁদেরবাড়িথেকেখাবারনিয়েআসারঅসুবিধারয়েছে তাঁদের কথা মাথায় রেখে প্রতিটি শুটিং ইউনিটে কমিউনিটি কিচেন চালু করার ব্যবস্থা করা হবে। তবে রান্না যাঁরা করবেন তাঁদের প্রত্যেককেই পরতে হবে গ্লাভস, মাস্ক, হেয়ার ক্যাপ। ব্যবস্থা করা হবে ডিসপোজেবেল প্লেটেরও। আগের মতো অভিনেতাদের ঘরে গিয়ে খাবার দেওয়ার চলও এ বার থাকছে না। শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, শুক্রবার ক্যান্টিন এবং খাবার সরবরাহকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে টেলিপাড়া।
মেকআপ আর্টিস্টরা কি কাজ হারাচ্ছেন?
করোনা-উত্তর যুগে মেকআপ কী করে করা হবে তা নিয়ে চলছিল সবিস্তার আলোচনা। কারণ টলিপাড়ায় মেকআপ শেয়ার করে করার রীতি রয়েছে। সেখান থেকে যে সংক্রমণ ছড়াবেনা তার কী নিশ্চয়তা? আর্টিস্ট ফোরামের তরফে জানানো হয়েছে, “যে সমস্ত শিল্পী মেকআপ কিট নিয়ে আসেন নাতাঁদের জন্য প্রযোজনা সংস্থা থেকে দেওয়া হবে ব্যক্তিগত মেকআপ কিট, কেউ যাতে কারও মেকআপ কিট ব্যবহার না করেন।” তবে শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে বলেন, “প্রতিটি অভিনেত্রীরই মেকআপ কিট রয়েছে। প্রযোজনা সংস্থা থেকে কাউকে মেকআপ কিট দেওয়া হবে না। আমরা চাইছি, অভিনেত্রীরা যাতে বাড়ি থেকে মেকআপ করে আসেন।” বাড়ি থেকেই যদি মেকআপ করে আসা হয় সে ক্ষেত্রে মেকআপ আর্টিস্টদের কী হবে? তাঁরা তো রাতারাতি বেকার হয়ে যাবেন? খানিকটা চুপ করিয়ে দিয়েই শৈবাল বলেন, “মিডিয়ার এটা বোঝা দরকার, কারও কোনও চাকরি যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। তাঁদেরকেও নিয়ে আসা হবে। দূরে দাঁড়িয়ে তাঁরা নির্দেশ দেবেন।
এ তো গেল মেকআপ কিটের কথা। মেকআপ রুম? জানা গিয়েছে, একটি রুমে কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে থাকতে পারবেন অন্তত দু’জন। একটু বড় মেকআপ রুম হলে সে ক্ষেত্রে আরও বেশি অভিনেতা থাকতে পারবেন। তবে অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
'ত্রিনয়নী' ধারবাহিকের একটি দৃশ্য
গণ পরিবহণে যাতায়াত করে কোনও টেকনিশিয়ান এবং শিল্পী যদি করোনায় আক্রান্ত হন?
ইন্ডাস্ট্রির মানুষ মানেই সবাই যে গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়ান এমনটা মোটেও নয়। ইন্ডাস্ট্রির বেশিরভাগ কলাকুশলীরই ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। সে ক্ষেত্রে? ফেডারেশন জানাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের উপরেই আপাতত নির্ভর করতে হবে। কিন্তু যাঁরা কলকাতার বাইরে থাকেন? “যাঁরা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন তাঁরা কলকাতার বাইরে থাকলেও কাজের সুবাদে টলিগঞ্জের আশেপাশে ঘর ভাড়া নিয়ে বা ফ্ল্যাটে থাকেন। এ দিকে গতকাল আর্টিস্ট ফোরাম জানিয়েছিল, কলাকুশলী এবং শিল্পীদের ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকলে প্রযোজনা সংস্থা পিকআপ এবং ড্রপ দেবে। আজ এ ব্যাপারে আর্টিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “প্রাথমিক ভাবে সে রকমই কথা হয়েছিল। তবে এ নিয়ে সবার সঙ্গে আরও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি।”
'কৃষ্ণকলি' ধারাবাহিকে শ্যামা এখন আম্রপালি
শিশুদের নিয়েই যে ধারাবাহিকগুলি তাদের কী হবে?
নির্দেশিকা অনুযায়ী, দশ বছরের নীচে শিশুরা যোগ দিতে পারবে না কাজে। তা হলে ‘ফিরকি’, ‘কাদম্বিনী’-সহ যে সমস্ত ধারাবাহিকের মুখ্য ছিল শিশুশিল্পী, সেগুলো কি বন্ধ হয়ে যাবে? বিভিন্ন সংগঠন জানিয়েছে, এ ব্যাপারে চ্যানেল যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। তারা যদি চিত্রনাট্য বদল করে ধারাবাহিকটি চালাতে চায় তা হলে চালাতেই পারে। যদিও এ প্রসঙ্গে জিবাংলা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলে এখনও কোনও উত্তর মেলেনি।
পোশাকের ক্ষেত্রে দায়িত্ব বাড়ল শিল্পীদের
প্রযোজনা সংস্থা থেকে যে পোশাক দেওয়া হত, আগে তা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব বর্তাত না শিল্পীর উপর। দায় ছিল প্রযোজনা সংস্থার। কিন্তু নতুন নিয়মে সেই সমস্ত পোশাক নিয়ে যেতে হবে বাড়ি। কেচে, ধুয়ে আবার নিয়ে আসতে হবে শুটিংয়ে।
কমতে পারে পারিশ্রমিকও
স্যানিটাইজেশনের খরচ রয়েছে, এরই মধ্যে এতদিন কাজ বন্ধ। সেই কোপ পড়তে পারে শিল্পী, কলাকুশলীদের পারিশ্রমিকেও। পোস্ট করোনা শুটিংয়ে প্রযোজনা সংস্থাগুলির খরচ বাড়ার কারণে অভিনেতারাও একটু মানিয়ে নেবেন বলেই আশাবাদী শৈবাল। “আপাতত পুরনো পারিশ্রমিকে কাজ শুরু হলে আশা করি শিল্পীরা আপত্তি করবেন না। আরে, সারাজীবন তো আর এমনটা থাকবে না। একদিন না একদিন ইন্ডাস্ট্রি আবার ঘুরে দাঁড়াবে,” বলছিলেন তিনি।
শুটিং মানেই আর দীর্ঘ প্রতীক্ষা নয়
কাজ হবে অনেক তাড়াতাড়ি।নতুন নিয়মে শুটিং ফ্লোরে ছয় জনের বেশি ঢোকার অনুমতি নেই। তাই কাজ করতে হবে খুব দ্রুত। বসিয়ে রাখার ব্যাপার নেই। যাতে ছ’জনের শট নিয়ে আবার বাকি ছ’জনকে তাড়াতাড়ি ডেকে নেওয়া যেতে পারে। ১২ জনের শট হলে মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে ওই দুই শটকে। লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, “এত দিন যে ভাবে মানুষ বিয়ে দেখেছে ধারাবাহিকে, এ বার হয়তো একদম নতুন কিছু দেখবে দর্শক।” অতএব ভোলবদল যে হচ্ছে, লীনার কথাতেই তার আভাস মিলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy