Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Brahmastra

‘ব্রহ্মাস্ত্র’ কি বিবিধ ছায়ার অবলম্বন? ভারতীয় ফ্যান্টাসির আসল উদ্দেশ্য কী?

৪০০ কোটির ছবি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ কি আদতে কিছু নামকরা হলিউডি ছবি আর বিখ্যাত উপন্যাস থেকে সোজা ধার করা? তাই কি দর্শকেরা ভিড় করে দেখেছেন? বুঝতে চেষ্টা করল আনন্দবাজার অনলাইন।

‘ব্রহ্মাস্ত্র’এমন এক দুনিয়ার কথা বলে, যা চেনা বাস্তবের সমান্তরাল নয়।

‘ব্রহ্মাস্ত্র’এমন এক দুনিয়ার কথা বলে, যা চেনা বাস্তবের সমান্তরাল নয়। ছবি: সংগৃহীত।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২২ ১৭:৫০
Share: Save:

অয়ন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ব্রহ্মাস্ত্র: পার্ট ওয়ান— শিবা’ গত ৯ সেপ্টেম্বর মুক্তির পর ভাল ব্যবসা করে শিরোনামে এসেছে। কিন্তু পাশাপাশিই কিছু ‘অপ্রিয়’ সত্য নিয়েও নাড়াঘাঁটা চলছে।

ঘটনাচক্রে, বহুকথিত, বহুচর্চিত, বহুনন্দিত এই ছবি বেশ কিছু বিদেশি ছবি ও দেশীয় সাহিত্যের আনাচকানাচ থেকে তুলে এনেছে তার চিত্রনাট্যের রসদ, দৃশ্যায়ন এবং বক্তব্য। ট্রেলার মুক্তির বহু আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ এক ‘ফ্যান্টাসি ঘরানার অ্যাকশনধর্মী’ ছবি। সাম্প্রতিক কালে বলিউডের ‘ফ্যান্টাসি’ মানেই অতিমাত্রিক হিন্দুত্বের দিকে ঢলে পড়া। ছবির অন্যতম চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায় সেই খাতাই খুলেছেন।

প্রথমত, অয়ন ফ্যান্টাসির এক ‘মহাজগৎ’ নির্মাণ করতে চেয়েছেন, যা তাঁর মতে ‘অস্ত্রভার্স’। ঘটনাচক্রে, মার্ভেল কোম্পানির ‘সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স’-এর ধারণাও আবিশ্ব দর্শকের মন জয় করেছে। অন্য বৃত্তে একই কাজ করেছে হ্যারি পটার সিরিজ় বা তারও বহু আগে নির্মিত কল্পবিজ্ঞান ছবির সিরিজ ‘স্টার ওয়ার্স’। অয়নের ‘অস্ত্রভার্স’ সে সবের থেকে ভাবনাগত ভাবে খুব দূরের নয়।

দ্বিতীয়ত, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ এমন এক দুনিয়ার কথা বলে, যা চেনা বাস্তবের সমান্তরাল নয়। বরং তা এক আপাত ‘গোপন’ বিশ্ব। এর সঙ্গে হ্যারি পটার সিরিজ। উল্লিখিত তিনটি জাদুবস্তুর (‘ইনভিজ়িবিলিটি ক্লোক’, ‘রেজারেকশন স্টোন’ এবং ‘এল্ডার ওয়ান্ড’) মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর উপন্যাসমালায় জেকে রোওলিং এল্ডার ওয়ান্ডকে এই তিন জাদুবস্তুর মধ্যে সব থেকে শক্তিশালী বলে বর্ণনা করেছিলন। ‘ডেথলি হ্যালোজ়’ নামে পরিচিত এই তিন জাদুবস্তু কেউ করায়ত্ত করতে পারলে সে বিশ্বের সব থেকে ক্ষমতাবান জাদুকরে পরিণত হবে। অয়নের ছবিতে অগ্নি-অস্ত্র, বরুণাস্ত্র, নন্দী-অস্ত্র ও বানরাস্ত্র রাখা হয়েছে এবং সেগুলির নিয়ন্তা হিসেবে ব্রহ্মাস্ত্রকে দেখানো হয়েছে। হ্যারি পটার সিরিজ়ে ‘ডেথলি হ্যালোজ়’-এর সুলুকসন্ধান জানত জাদু-বিশ্বের এক বিশেষ এবং গোপন সম্প্রদায়। ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-ও এক গুপ্তসমিতির কথা জানাচ্ছে, যা ব্রহ্মাস্ত্র-রহস্যকে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে এবং তার অপব্যবহার রোধ করতে চায়।

 ট্রেলার মুক্তির বহু আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ এক ‘ফ্যান্টাসি ঘরানার অ্যাকশনধর্মী’ ছবি।

ট্রেলার মুক্তির বহু আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ এক ‘ফ্যান্টাসি ঘরানার অ্যাকশনধর্মী’ ছবি। ছবি: সংগৃহীত।

তৃতীয়ত, ক্রিস্টোফার সি ডয়েল তাঁর ‘দ্য মহাভারত সিক্রেট’ (২০১৩) উপন্যাসে বেদব্যাস-রচিত মহাকাব্যের অষ্টাদশ পর্বের বাইরেও একটি পর্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। তার নাম ‘বিমান পর্ব’। সেখানে নাকি অসম্ভব শক্তিশালী সব দৈব অস্ত্রের বর্ণনা রয়েছে। যা মহাভারতের কাল থেকেই গোপন রাখা হয়। ডয়েলের কাহিনি অনুযায়ী, সম্রাট অশোক সেই অস্ত্রভান্ডারের সন্ধান পান এবং শান্তিকামী সম্রাট সেই বিপুল শক্তির উৎস গোপন রাখতে ৯ জন বিশিষ্ট মানুষের এক গুপ্তসমিতি গড়েন। অস্ত্রভান্ডারের হদিস সেই ৯ জনের মধ্যে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে রাখেন। এঁদের কেউ বিজ্ঞানী, কেউ শিল্পী, কেউ বা কবি-সাহিত্যিক।

অয়নের ‘অস্ত্রভার্স’-এর গুপ্তজ্ঞানের রক্ষকও একটি বিশেষ সম্প্রদায়। যাদের সদর দফতর হল ‘আশ্রম’। যেখানে এই রহস্যের ধারক ও বাহকরা মাঝেমাঝে সমবেত হয়। এই সম্প্রদায়েরই এক ক্ষমতালিপ্সু সদস্যের হাত থেকে বাঁচাতে মূল ব্রহ্মাস্ত্রকে তিন টুকরোয় ভেঙে ফেলা হয় এবং তার দু’টি টুকরো যথাক্রমে এক বিজ্ঞানী ও এক শিল্পীর কাছে আছে। তৃতীয়টি হারিয়ে গিয়েছে। ডয়েলের উপন্যাসের সঙ্গে এই কাহিনি-কাঠামোর মিল কি নেহাত কাকতালীয়? বা হ্যারি পটার সিরিজ়ে উল্লিখিত তিন জাদু-বস্তুর মধ্যে দু’টির সন্ধান পাওয়া গেলেও সব থেকে শক্তিশালী তৃতীয়টি খুঁজে পাওয়া না-যাওয়ার কাহিনিও কি সমাপতন?

‘আশ্রম’-এ বেশ কিছু বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী শিশু থাকে। সেখানে ছায়া ফেলে আমেরিকান ফ্যান্টাসি লেখক র‍্যানসম রিগসের বিখ্যাত উপন্যাস ‘মিস পেরেগ্রিনস হোম ফর আনন্যাচরাল চিলড্রেন’এবং সেটি অবলম্বনে একই নামের ছবি (২০১৬)। যেখানে এক অনাথাশ্রমে ঠাঁই পায় এমন সব শিশু, যাদের কিছু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা রয়েছে।

‘ব্রহ্মাস্ত্র’-য় শিবা এমনই এক শিশু, যে জন্মলগ্নেই মাকে হারায় এক অগ্নিকাণ্ডে। অথচ সেই আগুনে তার কিছু হয় না। যার উপর ছায়া পড়ে হ্যারি পটার সিরিজ়ের গোড়াতেই উল্লিখিত ১ বছরের শিশু হ্যারিকে লর্ড ভোল্ডেমর্টের কোপ থেকে বাঁচাতে তার মা লিলি আত্মাহুতি দেয়। ভোল্ডেমর্টের ছোড়া মারণ-অভিশাপ হ্যারিকে মারতে ব্যর্থ হয় এবং হ্যারি ‘দ্য বয় হু লিভড’ পরিচিতি লাভ করে। পরে সে জানতে পারে, তার মায়ের বিশুদ্ধ ভালবাসাই তাকে সর্বদা রক্ষা করে আসছে। যে কথা তাকে জানান হগওয়ার্টস জাদু বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার ডাম্বলডোর। প্রবীণ জাদুকর ডাম্বলডোর হ্যারি-সিরিজের প্রায় প্রতিটিতেই একটি কথা বলে গিয়েছেন— ভালবাসা সব থেকে বড় অস্ত্র। ঠিক এই বাক্যটিই প্রায় হুবহু বসেছে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-এর ‘গুরুজি’ (অমিতাভ বচ্চন)-র মুখে।

‘ব্রহ্মাস্ত্র’-এর সব থেকে লক্ষ করার জায়গা হল নায়ক ‘শিবা’র জন্মরহস্য এবং তার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা। ঔপন্যাসিক শমিত বসু ২০০৪ থেকে ২০০৭-এর মধ্যে লেখেন তাঁর ফ্যান্টাসি-ত্রয়ী ‘দ্য গেম ওয়ার্ল্ড ট্রিলজি’। তার প্রথম পর্ব ‘দ্য সিমোকিন প্রফেসিজ’-এ নায়ক কিরিন জানতে পারে, তার জন্মদাতা পিতা আসলে ডান-জেম নামে এক রাক্ষস, যাকে ধ্বংস করতে না পারলে তাদের জগতের লয় অনিবার্য। কিন্তু কিরিন শেষ পর্যন্ত থমকে যায় ডান-জেমকে হত্যা করতে গিয়ে। সে নিজেই অন্ধকারের অধিরাজ ডান-জেমের উত্তরাধিকারী হয়ে দাঁড়ায়।

‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবির অন্তিম অংশ অনিবার্য ভাবে গেমওয়ার্ল্ড ট্রিলজির প্রথম ভাগের অন্তিম পর্বকে মনে করিয়ে দেয়। অয়নের ছবি আট আনা হ্যারি পটার, চার আনা অন্য ফ্যান্টাসি আর বাকি চার আনা শমিত বসু হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আর তার গায়ে চাপানো রয়েছে মার্ভেলের মতো বিকল্প বিশ্বসন্ধানের প্রায় অনুরূপ এক পাতলা চাদর।

শিবার ‘দ্য চোজেন ওয়ান’ হয়ে ওঠার পুরো ধারণাটিই হ্যারি পটার থেকে টানা। রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ থেকে বিভিন্ন সুতো খামচে এনে এক জামেওয়ার শাল বোনার প্রচেষ্টা। তবে তা সত্ত্বেও জনতা ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ দেখেছে। তা হলে কি এই উল্লাস সেই সব অগণিত ভারতীয়ের, যাঁরা হ্যারি পটার দেখেননি বা ওটিটি মঞ্চের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় নেই?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy