Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

লিঙ্গ আর শ্রেণি বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘ উৎকণ্ঠা, দর্শক ধৈর্য ধরবেন তো?

লিঙ্গ এবং শ্রেণি- এই দু'টি বিষয়কে সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরলেও দিবাকরের নতুন ছবি দর্শকের ধৈর্য কতটা ধরে রাখতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়‌।

'সন্দীপ অউর পিঙ্কি ফরার' ছবির পোস্টার।

'সন্দীপ অউর পিঙ্কি ফরার' ছবির পোস্টার।

ইন্দ্রদত্তা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২১ ২০:৫৫
Share: Save:

'সন্দীপ' বললে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসবে একজন পুরুষের পরিচয় এবং 'পিঙ্কি' বললে কোনও মহিলার। কিন্তু পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সন্দীপ অউর পিঙ্কি ফরার' ছবিতে এই লিঙ্গ পরিচয়ের বিষয়টা ঠিক উল্টে যায়। সন্দীপ ওয়ালিয়া, ওরফে স্যান্ডি এখানে উচ্চশিক্ষিত এক মহিলা যিনি বর্তমানে এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর (পরিণীতি চোপড়া), এবং পিঙ্কি, তথা সত্যেন্দ্র দাহিয়া আসলে হরিয়ানা পুলিশের সাসপেন্ডেড কর্মচারী (অর্জুন কপূর)। পুরো ছবি জুড়ে নানা ভাবে লিঙ্গ সংক্রান্ত ধ্যানধারণা ভাঙার মধ্যেই এটি একটি। লিঙ্গ এবং শ্রেণি-- এই দু'টি বিষয়কে সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরলেও দিবাকরের নতুন ছবি দর্শকের ধৈর্য কতটা ধরে রাখতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়‌।

নায়িকার নাম সন্দীপ হওয়ার পিছনে ব্যাখ্যা হল-- পঞ্জাবি শিখ পরিবারে তার জন্ম, যেখানে প্রায়শই ছেলে মেয়েদের একই নাম রাখা হয়। কিন্তু অর্জুনের নাম পিঙ্কি হওয়ার পিছনে কোনো গল্প বা ব্যাখ্যা কিছুই দেননি দিবাকর, এবং এখানেই এই ছবি লিঙ্গ-বৈষম্য ভাঙার গতানুগতিক বলিউডি ধারা থেকে অনেকটা বেরোতে পেরেছেন পরিচালক। পিঙ্ক বা গোলাপি রংটাই লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। নারীত্বের সঙ্গে প্রচলিত ভাবে সংশ্লিষ্ট বলে পিঙ্কি কোনও দিনই পায়নি পুরুষদের সম্মান বা মর্যাদা। কোনও পুরুষের পরনে এই রঙের জামা থাকলে খাটো হয়ে যায় তার পৌরুষ। এমনকি, ছবির প্রথমে হাইওয়েতে চলন্ত গাড়ির দৃশ্যে একটি ছেলেকে বলতে শোনা যায় তার প্রাক্তন কী ভাবে তাকে একটি পিঙ্ক শার্ট পরতে বাধ্য করে। অবশ্য তার ব্যক্তিত্বের জন্য সে এমন একটি রঙেও নিজের জৌলুস অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছিল-- জিতে যায় পৌরুষ। এমন একটি রঙের সঙ্গে মিলিয়ে এক নির্দয় পুলিশ অফিসারের নাম রেখে দিবাকর প্রথমেই আমাদের লিঙ্গ পরিচয়ের পূর্বনির্ধারিত প্রত্যাশাগুলি ভেঙে দেন।

গল্পটির মূল প্লট পরিচিত, অভিনব বা নতুন কিছু নয়। সমাজের একেবারে দুই প্রান্তের দুই মানুষ, একজন পুরুষ একজন নারী, এক বিশেষ ঘটনা বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পরের সান্নিধ্যে চলে এসেছে। দু'জনকেই একই যাত্রার সঙ্গী হতে হবে অথচ একে অন্যের জীবন বরাবর সমান্তরালে চলেছে, কোনও দিন মিলিত হয়নি, হওয়ার কথাও ছিল না। এই ছবিতে স্যান্ডিকে খুন করার জন্য ত্যাগী নামের এক বড় পুলিশ কর্মচারীকে নিয়োগ করে স্যান্ডির বস পরিচয়। সেই পরিকল্পনায় চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাসে ত্যাগী জড়িয়ে ফেলে পিঙ্কিকে, কারণ এক বছর ধরে সাসপেন্ডেড থাকা পিঙ্কির জীবনের বিশেষ দাম তার উপরমহলের কাছে নেই। কিন্তু ঘটনাচক্রে একটি ভুল গাড়ির লোককে গুলি করে মেরে ফেলায় বেঁচে যায় স্যান্ডি ও পিঙ্কি, তবে সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত হয়না। ফলে- 'ফরার,' বাকি ছবি জুড়ে কেবল দৌড়োতে থাকা, জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, শেষতক।

ছবি কিছুক্ষণ চলার পরেই গুলি, মৃত্যু, রহস্য। একেই রাতের প্রেক্ষিত, তার উপর রাজধানীর হাইওয়ে, এবং তাতে খুন-- ছবির প্রথমেই একটা উৎকণ্ঠার ভিত তৈরি হয়ে যায়, যা পরিচালক ধরে রেখেছেন অনেকক্ষণই। তবে পরের দিকে তা এত দীর্ঘ মনে হয় যে, ধৈর্য হারানোর সম্ভাবনা খুব বেশি মাত্রায় বেড়ে যায়। দিবাকর এই ছবিতে অনেকটাই নির্ভর করেছেন ফ্ল্যাশব্যাকের উপরে, অর্থাৎ গল্পের ধারা বার বার ফিরে যেতে থাকে অতীতে। দর্শককে টুকটাক প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আবার গল্প ফিরে আসে বর্তমানে। এ ভাবে অতীত ও বর্তমানের চক্রাকার আবর্তন কিছু ক্ষেত্রে এত দীর্ঘায়িত হয়ে যায় যে, তা ক্লান্তিকর ঠেকে। ফলত, ঘটনা পরম্পরা এবং কার্য-কারণ সম্পর্ক বুঝতে বুঝতেই সিনেমার অধিকাংশ ফুরিয়ে যায়, দর্শক প্রায় শেষের দিকে চলে। কাহিনীকার যেহেতু দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বরুণ গ্রোভার ('মাসান'-এর চিত্রনাট্য লেখার জন্য যিনি কয়েক বছর আগেই যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছেন), তাই হয়ত প্রত্যাশার পারদও ছিল সামান্য বেশি।

সাসপেন্স বা থ্রিলারের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল প্রথমে, তা ক্রমেই ফিকে হতে থাকে এবং ছবি প্রবেশ করে খানিক কমেডির অঞ্চলে। স্যান্ডি ও পিঙ্কির ঘোড়দৌড়ের মধ্যে পিথোরাগড়ে এক বয়স্ক দম্পতির (রঘুবীর যাদব ও নীনা গুপ্ত) বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকার অংশটুকু বেশ মজার। এমনকি একটি বিয়ের আগের ককটেল পার্টি উপলক্ষে বলিউডি মূলধারার ছবির ফর্মুলা মেনে একটি জমজমাট নাচের দৃশ্যও আছে । তবে মজা এবং হাস্যরসের মধ্যেই ছোট ছোট দৃশ্যের মাধ্যমে দিবাকর লিঙ্গ ও শ্রেণি বিভাজনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। পুঁজির নিরিখে (শিক্ষা, সংস্কৃতি, টাকা-- সব রকম পুঁজি) পিঙ্কির চেয়ে অনেক এগিয়ে স্যান্ডি, প্রচুর সুবিধা ভোগ করেছে সে। পিঙ্কি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, "তোমাদের মতো লোকেরা সবই পায়। গোল্ড মেডেল, ইংলিশ মিডিয়াম, টাকা..." আবার, সমাজে সম্মান ও সুরক্ষার নিরিখে, কেবল পুরুষ হিসেবে নিজের লিঙ্গপরিচয়ের জন্য স্যান্ডির চেয়ে এগিয়ে পিঙ্কি। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের কারণে লিঙ্গ ও শ্রেণি বৈষম্যের প্রতি এই ছবির দৃষ্টিভঙ্গী কখনো একস্তরীয় হয়ে পড়েনি।

পরিণীতি চোপড়া স্যান্ডির ভূমিকায় মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন। জীবন হাতে নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার অসহায়তা ফুটিয়ে তোলার পিছনে যথেষ্ট পরিশ্রম ছিল তাঁর, এবং তা বোঝা গেছে। পিঙ্কির ভূমিকায় অর্জুন কপূরও যথাযথ। ভাল লাগে ত্যাগীর ভূমিকায় জয়দীপ অহলাওয়াটকে, কিন্তু এ ছবিতে অভিনয়ের বিশেষ জায়গা তিনি পাননি। তবে কোথাও যেন মূল চ‍রিত্রের দুই অভিনেতাকেও ছাপিয়ে যায় নীনা গুপ্ত ও রঘুবীর যাদবের অভিনয়। যেমন তাঁদের রসায়ন, তেমন কমিক টাইমিং, তেমনই অভিব্যক্তি। বিশেষ করে মনে থেকে যায় পার্টির দৃশ্যটি, যেখানে নীনা গুপ্ত গল্পের ছলে বলছেন-- একদিন তাঁর স্বামীর ওপর এত রাগ হল যে তিনি সত্যিই বেরিয়ে পড়েছিলেন বাড়ি থেকে, কিন্তু তাঁর আর কোথাও যাওয়ার নেই, এই বাড়িটুকুই তার আশ্রয়। ফলে আবার ফিরে আসতে হল তাঁকে। পুরুষতন্ত্রের সুদীর্ঘ প্রশিক্ষণে স্বামীর করুণায় জীবনধারণ এতটুকু অস্বাভাবিক মনে হয়নি তাঁর, বরং হেসে হেসেই তাঁর অসহায়তার কথা অক্লেশে ব্যক্ত করছেন তিনি।

দুর্বল চিত্রনাট্যকে খানিক মেরামত করেছে কিছু কিছু স্মরণীয় সংলাপ, এবং অভিনয়। ছবির শেষটুকু আবার বেশ ছাপ ফেলে যায়। দিবাকরের নিজের আবহসঙ্গীতও ছবির সঙ্গে বেশ মাননসই, এবং প্রশংসনীয়ও বটে। তুলনায় অনু মলিকের সঙ্গীত পরিচালনা আলাদা করে ভাল লাগে না। ক্যামেরার কাজ ভাল লাগে। ছবির শ্লথ গতিকে কিছুটা হলেও উতরে দিয়েছে পাহাড় এবং নদীর নিসর্গ। বেশ কিছু ফাঁক রয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, সমাজের লিঙ্গ ও শ্রেণি বিষয়ক আলোচনা এই ছবিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে 'সন্দীপ অউর পিঙ্কি ফরার' অপ্রত্যাশিত বন্ধুত্বের কথা বলে, বলে জীবনের কথা, রঙের কথা, বেঁচে থাকার কথা। কেবল এই কারণেই ছবিটি এক বার দেখা যায়। ছবিটি দেখা যাচ্ছে অ্যামাজন প্রাইমে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy