‘লোকি’-র পোস্টার।
'আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!' 'লোকি' মিনি সিরিজ দেখার পরে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই পঙক্তিটিই ঘুরেফিরে মনে আসে।
মিথ্যের দেবতা লোকি? নাকি কৌশলের দেবতা? নর্স পুরাণের পথভ্রষ্ট এক দেবরাজকুমার হল লোকি, যার একমাত্র লক্ষ্য, রাজা হওয়া! মাঝে মাঝেই সে তার পালক পিতা, সর্বশক্তিমান ওডিন বা অমিত শক্তিশালী ভাই থরকে হারিয়ে নর্স স্বর্গ, অ্যাসগার্ডের সিংহাসন জয় করার চেষ্টা করতেই থাকে, কিন্তু বার বার বিফল মনোরথ হওয়ায় সে ঠিক করে, পৃথিবী বা মিডগার্ডের রাজা হবে সে। সেখানকার মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের ভগবান হয়ে থাকা সোজা!
যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। মহাজাগতিক যুদ্ধবাজ থ্যানোসের হাত ধরে লোকি পৃথিবীতে ভিনগ্রহী সেনা চিটাউরিদের নিয়ে চড়াও হয়। লক্ষ্য, পৃথিবী জয় এবং টেসের্যাক্ট নামের একটি অমিত শক্তিধর বস্তুর উপর অধিকার বিস্তার। যার সাহায্যে লোকি এক মুহূর্তেই ব্রহ্মাণ্ডের এপার থেকে ওপারে চলে যেতে পারবে। অবশ্য এ বারেও লোকিকে খালি হাতে ফিরতে হয়। পৃথিবীর সুপারহিরোর দল 'অ্যাভেঞ্জার্স' লোকিকে থামিয়ে দেয়।
এর পর যখন তারা লোকিকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতের আয়রন ম্যান, টোনি স্টার্কও এই টেসের্যাক্টে র খোঁজে আসে। কিন্তু হাল্কের ধাক্কায় টেসের্যাক্ট হাতছাড়া হয়ে যায় আর লোকির হাতে গিয়ে পড়ে সেই বস্তু। লোকি সময় নষ্ট না করে টেসের্যাক্টের সাহায্যে সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়। শুধু থরের গলা পাওয়া যায়, “লোকি কই? লোকি কই?”
টেসের্যাক্ট একটি ইনফিনিটি স্টোন। ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তুগুলির মধ্যে অন্যতম। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত লোকি সেই টেসের্যাক্টের সাহায্যে নিউ ইয়র্ক থেকে এসে পড়ে গোবি মরুভুমিতে। সেখানকার গ্রাম্য মানুষ এই অদ্ভুত প্রাণীটিকে দেখতে আসে কৌতুহলবশতই। লোকি দেখে, এই তার সুযোগ, সে তাদের জীবনে নিজের 'গৌরবময় উদ্দেশ্য' ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এমন সময়ে আধাসামরিক বাহিনীর বেশে কিছু পুলিশ গোছের মানুষ এসে পড়ে একটা পোর্টালের ভিতর দিয়ে। টিভিএ নামের এক সংস্থার নাম করে তারা লোকিকে ধরে নিয়ে যায়।
সেখানে এসে লোকি জানতে পারে যে, সময় অনেক ধারায় বয়ে চলেছে। প্রত্যেকটি সময়ধারা এক একটি স্বতন্ত্র সময়স্রোত। সব ক'টি সময়স্রোতই একটি মূল সময়স্রোতকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে অনুসরণ করে। এই মূল সময়স্রোতটির নাম 'সেক্রেড টাইমলাইন'। এই মূল সময়স্রোতটির ধারক-বাহক হচ্ছে তিন জন অত্যন্ত রহস্যময় জীব, যাদেরকে 'টাইম কিপার' বা 'সময় রক্ষক' বলা হচ্ছে। এই সময় রক্ষকরা তিন বিধাতার মতো। আর এই টিভিএ বা টাইম ভেরিয়্যান্স অথরিটি খানিকটা যে কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করে। সময় রক্ষকদের কাছে লোকি একজন অপরাধী। কারণ সে টেসের্যাক্ট নিয়ে পালিয়েছিল যা এই মূল সময়ধারার থেকে তার বিচ্যুতি, যার পোশাকি নাম 'নেক্সাস ইভেন্ট'। লোকির কারণে সময়ধারায় আমূল পরিবর্তন আসতে পারে, তাই তার সময়ধারাটিকেও উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
টিভিএ-র আদালতে বিচার হয় লোকির, বিচারে সে দোষী সাব্যস্ত হয়। কিন্তু এই সময়ে উদয় হয় এক টিভিএ এজেন্ট মোবিয়াসের।
মোবিয়াস জানায় যে সে আর এক লোকির খোঁজ পেয়েছে, অন্য এক সময়ধারার লোকি সে। তাকে ধরতে তার এই গ্রেফতার হওয়া লোকিকে প্রয়োজন। মোবিয়াসের হাতে তুলে দেওয়া হয় মূল সময়ধারার লোকিকে। লোকি প্রথমে ভাবে যে, এটা কেউ একটা মিথ্যে কাহিনি ফেঁদেছে তাকে বোকা বানাতে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন সে দেখে যে টিভিএ-তে এসে তার অমিতশক্তিধর টেসের্যাক্ট অকেজো হয়ে গেছে বাদবাকি ইনফিনিটি স্টোনগুলোর মতো, লোকি প্রশ্ন করে, তবে কি এই টিভিএ-ই ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় শক্তি? তার রোখ চেপে যায় টিভিএ-র পিছনে কে বসে আছে জানার।
মোবিয়াস লোকিকে একটা সময় তদন্তে নিয়ে যেতে চায়, যেখানে দ্বিতীয় লোকিকে ধরার একটা সু্যোগ থাকতে পারে তাদের। টিভিএ-র বিচারপতি, র্যাভোনা রেনস্লেয়ার মোবিয়াসকে বলে লোকিকে বিশ্বাস না করতে, কিন্তু লোকির মিথ্যের দোলাচলে সন্দিহান হলেও, মোবিয়াস বলে, এক বার বিশ্বাস করে দেখি। যা বলব, তার অন্যথা করলে ছাঁটাই করে দেব!
তদন্তের ব্রিফিংয়ের সময়ে লোকি জানতে পারে যে, তারই মতো আরও অনেক লোকিকে কখনও না কখনও টিভিএ ধরে এনেছে। তাদের মধ্যে কেউ ট্যুর ডি ফ্রান্স জিতেছে, আবার কেউ হাল্কের মতো পেল্লায় চেহারার দৈত্য! কিন্তু তারা যে লোকির সন্ধানে বার হয়, তাকে কেউ দেখেনি এর আগে।
তদন্তের জন্য লোকিকে নিয়ে যখন মোবিয়াস ও টিভিএ-র পেয়াদা বাহিনী পৌঁছয় ঘটনাস্থলে, তখন নতুন লোকির সঙ্গে পুরনো লোকির পরিচয় হয়। লোকি যে নিজে শ্রেষ্ঠ, এই গর্ব তার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। নতুন লোকি জানায়, তার নাম লোকি নয়, সিলভি! কিছুটা কৌতূহল, অনেকখানি অ্যাডভেঞ্চার আর জীবনের একটা নতুন গৌরবময় উদ্দেশ্যের লোভে লোকি সিলভিকে অনুসরণ করতে শুরু করে। এর পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে একটা কিংবদন্তির টান, পর্দার পিছনের রহস্যাবৃত সেই টাইম কিপারদের আসল পরিচয় জানার বাসনা।
মার্ভেলের প্রোডাকশন ডিজাইন থেকে কোনও দিনই চোখ ফেরানো যায় না। ১৯৭০-এর দশকের মার্কিন সরকারি অফিসের আদলে তৈরি করা টিভিএ, পুরনো সিআরটি স্ক্রিনে চলতে থাকা তাদের ম্যাসকট মিস মিনিটস, আবার ল্যামেন্টিসের বা ভয়েডের মতো সমূহ বিনাশের মুখে পড়ে থাকা লোকেশনের সিজিআই দর্শককে সেইখানেই নিয়ে যায়, যেখানে যেখানে লোকি নিজে যাচ্ছে, তার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প নিয়ে।
লোকির চরিত্রে টম হিডলস্টন আর সিলভির চরিত্রে সোফিয়া ডি মার্টিনো এক কথায় অনবদ্য! সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন ওয়েন উইলসন, রিচার্ড গ্রান্ট, গুগু এম্বাথারের মতো অভিজ্ঞ অভিনেতারা।
লোকি চরিত্রটির আসল প্লাস পয়েন্ট তার কৌশল। লোকি যে শুধু অত্যন্ত পারদর্শী একজন জাদুকরই নয়, তার আর এক অস্ত্র হচ্ছে নিজেকে বার বার নতুন করে আবিষ্কার করার ক্ষমতা। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানের শো 'রিক অ্যাণ্ড মর্টি'-খ্যাত লেখক মাইকেল ওয়ালড্রনের কলম থেকে তাই খানিকটা হতাশাই এসেছে, যখন লোকির কৌশল, তার সংলাপের ভারে কোথাও উধাও হয়েছে। কিন্তু লোকি নিজেকে যখনই মেলে ধরতে পেরেছে, কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে কোথাও বোধ হয় পুরাণেরও অবতারণা হয়েছে, যা লোকির জাদুকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে, আর দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ রেখে টিভি বা মোবাইলের স্ক্রিন থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও অন্য কোথাও যেতে দেয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy