সিনেমা ভালবাসত কিশোরী গঙ্গু, তাঁর দু চোখ ভর্তি স্বপ্ন সে নায়িকা হবে। গুজরাতের কাথিয়াওয়াড়ের এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর পনেরো বছর বয়সী মেয়ে গঙ্গু তাঁর প্রেমিক রামনিকের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল স্বপ্নের শহর মুম্বইয়ে। স্বপ্নে ও প্রেমে বিভোর গঙ্গু বোঝেনি রামনিকের সুকৌশলে পাতা ফাঁদ।
এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর পনেরো বছর বয়সি মেয়ে গঙ্গু তাঁর প্রেমিক রামনিকের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল স্বপ্নের শহর মুম্বইয়ে
আমাদের শহরে
প্রত্যেক ধর্মের মানুষের জন্য
ভিন্ন ভিন্ন দেবালয়,
কিন্তু সকল ধর্মের মানুষদের জন্য
একটিই বেশ্যালয়—
কোনও সমস্যা নেই।
কবিতাটি রণজিৎ দাশের। সঞ্জয় লীলা ভন্সালী হয়তো তাঁর কবিতা পড়েননি, পড়েছেন সাংবাদিক এস হুসেন জাইদির লেখা ‘মাফিয়া কুইনস অফ মুম্বই’ বইটি (যার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই ছবি)। অথচ সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘গঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি’ দেখতে দেখতে ঠিক এই লাইনগুলি মনে পড়ছিল। এ যেন গঙ্গুবাইয়েরই কথা, যিনি প্রশ্ন করেছিলেন বারবণিতাদের প্রতি সভ্য সমাজের দ্বিচারিতার মনোভাবকে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষ আসেন যৌনপল্লি, যৌনকর্মীরা তাদের সকলের চাহিদা মিটিয়ে দেন। তারা যদি সমাজের প্রতি কোনও ভেদাভেদ না করেন, তবে তাদের প্রতি সমাজের এমন ভেদাভেদের আচরণ কেন? আজাদ ময়দানে মাঠভর্তি শ্রোতার সামনে গঙ্গু ছুড়ে দিয়েছিলেন এই অমোঘ প্রশ্ন, যার উত্তর দিতে বোধহয় আজও অপারগ আমাদের সমাজ।
বেশি দূর পিছিয়ে যেতে হবে না। আগের শতকের ৫০-৬০এর দশকে মুম্বই শহরে গঙ্গু লড়েছিলেন এক অসীম সাহসী লড়াই, লড়েছিলেন কামাঠিপুরার যৌনকর্মীদের সম্মানের দাবিতে। আজব শহর মুম্বাই। হিন্দি সিনেমার ঝাঁ চকচকে প্রাণকেন্দ্রের অলিতে গলিতে চোরাস্রোতের মতো লুকিয়ে আছে হিংস্রতা, রহস্য, রক্তপাত। তারই মধ্যে যৌনপল্লির হতভাগ্য মেয়েদের জন্য লড়াই করেছিলেন তাদেরই মতো হতভাগ্য এক সাতাশ বছরের তরুণী— গঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি।
সিনেমা ভালবাসত কিশোরী গঙ্গু, তাঁর দু চোখ ভর্তি স্বপ্ন সে নায়িকা হবে। গুজরাতের কাথিয়াওয়াড়ের এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর পনেরো বছর বয়সি মেয়ে গঙ্গু তাঁর প্রেমিক রামনিকের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল স্বপ্নের শহর মুম্বইয়ে। স্বপ্নে ও প্রেমে বিভোর গঙ্গু বোঝেনি রামনিকের সুকৌশলে পাতা ফাঁদ। হিন্দি ফিল্মের চোখ-ধাঁধাঁনো দুনিয়ার পরিবর্তে তাই তাঁর ঠাঁই হল অন্ধকার-স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে, রাত নামলে যেখানে শরীর বেচে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় শতাধিক মেয়ের। তেমনই আর এক কিশোরী মধুকে নিজের গল্প শোনানোর সময় ফ্ল্যাশব্যাকে ভন্সালী ধরেছেন গঙ্গুর অতীতকে।
গঙ্গুর মোড় ঘুরে যায় এলাকার মাফিয়া ডন করিম লালার সহায়তায়। লালা একজন নিষ্ঠাবান পাঠান, তাঁর দাপটে থরহরিকম্প মুম্বইয়ের তাঁবড় লোকজন। সেই লালার দলের এক পাঠানের হাতে যখন ধর্ষিত হতে হয় গঙ্গুকে, তখন একরোখা গঙ্গু ইনসাফ চান লালা, তথা তাঁর করিম ভাইয়ের কাছে। ইনসাফ মেলে, সঙ্গে মেলে স্বীকৃতি ও ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার জোরে গঙ্গু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং দাপুটে রাজিয়া বাইকে হারিয়ে জিতেও যান। কিন্তু ক্ষমতার চাকচিক্য তাঁকে বিচ্যুত করেনি নিজের পরিসর থেকে, কামাথিপুরার কোঠি ও তার অগণিত বারবণিতাদের মধ্যেই ছিল তাঁর ঘর।
সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ছবি মানেই বিরাট এক ক্যানভাস জুড়ে আলো-রঙের খেলা। মহাকাব্যিক ফ্রেম। ঘটনার ঘনঘটা। অতিনাটকীয় সংলাপ। এ সবের মধ্যে বাস্তবের গঙ্গুবাই কেমন ছিলেন তা হুবহু জানতে চাওয়া বৃথা, সেই গঙ্গুবাইকে ভন্সালীর চোখ-ধাঁধাঁনো সেটে খুঁজতে যাওয়াও অর্থহীন। গঙ্গুর চরিত্র নির্মিত হয়েছে জাইদির বইয়ের ছায়ায়। মুম্বইয়ের তেরো জন ‘মাফিয়া কুইন’-দের নিয়ে বইয়ের তেরোটি অধ্যায়, তাঁর মধ্যে একজন গঙ্গু। বইটি পড়ে কেউ ছবিটি দেখতে গেলে প্রথম থেকে বেশ খানিক সাদৃশ্য পাবেন, তবে ছবি যত এগোয়, বোঝা যায় গঙ্গু, জাইদির বই থেকে উঠে এলেও ক্রমেই ডালপালা-শাখাপ্রশাখা নিয়ে প্রসারিত হন, ভন্সালীর প্রত্যাশিত ফর্মুলায়। ছবির শেষে তিনি একাধারে মা, রক্ষক, কামাথিপুরার প্রেসিডেন্ট ও সমাজকর্মী। পরনে সাদা শাড়ি, চোখে রোদচশমা ও হাতে মদের বোতল—এই সবকিছু নিয়ে গঙ্গু এক বৃহৎ মহীরূহ, যার বাইরেটা রূক্ষ হলেও, অন্তর স্নেহ ও সহমর্মীতায় পরিপূর্ণ। যেমনটা আছে ছবির সংলাপেই—‘প্যায়ার কো গালি দেতি হ্যায় পর উস্কি গালি মে ভি প্যায়ার হ্যায়’ (ভালবাসাকে সে গালিগালাজ করে কিন্তু তার গালিগালাজেও ভালবাসা আছে)।
এমন এক চরিত্রে কেমন অভিনয় করলেন আলিয়া ভট্ট তা জানার কৌতূহল অনেক মানুষেরই। সিনেমার ঝলক থেকেই মোটামুটি স্পষ্ট ছিল যে এ ছবিতে গঙ্গুবাই একাই একশো। খানিক প্রত্যাশিত ভাবেই এক ইঞ্চিও জমি তিনি ছাড়েননি অন্য কাউকে। শুরু থেকে শেষ কার্যত রাজত্বই করলেন আলিয়া। প্রথম প্রথম তাকে অবশ্যই সাতাশ বছরের জেদি গঙ্গু হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু ছবির চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছেন তিনি। নাচে-গানে-সংলাপে একেবারে মাতিয়ে রাখেন তিনি। ‘ঢোলিড়া’ গানে তাঁর নাচ মনে করায় ভন্সালীরই অন্য এক ছবি ‘রামলীলা’-র ‘নগাড়ে সং ঢোল’। তবে আলিয়ার পাশাপাশি তার প্রিয় বন্ধু কমলির চরিত্রে ইন্দিরা তিওয়ারি অসাধারণ। গঙ্গুর মতো চরিত্রের পাশেও তিনি শুরু থেকে শেষ নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন, কোনও অংশে কম যাননি। নজর কেড়েছেন শান্তনু মহেশ্বরী। আলিয়ার সঙ্গে তার দৃশ্যগুলি বেশ মিষ্টি এবং উপভোগ্য। রাজনৈতিক জটিলতা, কূটনীতি ও যৌনপল্লির ফ্যাকাশে যাপনের মধ্যে এই দৃশ্যগুলি টাটকা বাতাসের মতো। সীমা পাহওয়া অভিনয় করেছেন গঙ্গুবাইয়ের কোঠির দেমাকি মালকিন শীলা মাসির চরিত্রে, শুরু থেকেই যার সঙ্গে গঙ্গুর ঠান্ডা লড়াই চলে। তাঁর মতো দক্ষ অভিনেত্রীর প্রতি এই চরিত্র সুবিচার করতে পারল না। এ কথা বললেও ভুল হবে না যে তাঁর অভিনয়-ক্ষমতাকে ভাল মতন ব্যবহারই করা হয়নি। একই কথা খাটে জিম সর্ভ অভিনীত উর্দু পত্রিকার সাংবাদিকের চরিত্রেও। ছোট চরিত্রে অজয় দেবগণ ও বিজয় রাজ ভাল।
তবে ভন্সালীর অন্য সকল ছবির মতোই এ ছবিতেও কেন্দ্রে চরিত্র বা অভিনেতা নয়, বরং বিরাট সেটের বহর যা ভন্সালীর যে কোনও ছবির শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। এই ছবির রং ধূসর। ছবি জুড়ে যৌনপল্লীর ধূসর ক্যানভাসের মাঝে সাদা শাড়ি পরিহিত গঙ্গু সব সময়েই আকর্ষণের কেন্দ্রে, তাঁর উপস্থিতি চোখ টানে সর্বক্ষণ। ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ধরা কামাথিপুরার ফ্রেমগুলি মুম্বই শহরের সমান্তরাল ও আড়াল জীবনের ছবি আঁকে। মনে পড়তে পারে যৌনকর্মীদের জীবন নিয়ে তৈরি শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত আর এক স্মরণীয় ছবি ‘মান্ডি’-র কথা। লো অ্যাঙ্গেল ও হাই অ্যাঙ্গেল শট ব্যবহার করে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে দৃশ্য-বয়নে। বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার পাবেন দর্শক। তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় বোধ হয় কমলীর মৃত্যুদৃশ্য। মৃত্যু মানেই সাদা পোশাক, শোকের ঘনঘটা, নির্জনতা, ও নীরবতা। ভন্সালী দেখালেন অন্য রকম এক শেষ বিদায়। কমলীর মরদেহকে সেখানে সাজানো হয়েছে লাল শাড়িতে। তাঁকে ঘিরে রয়েছে তাঁর অজস্র সহচরী, কেউ সাজিয়ে দিচ্ছেন তো কেউ কমলীর ঘন কালো চুলে বেণী বেঁধে দিচ্ছেন শেষ বারের মতো। মাঝখানে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছেন কমলী। মুখে গভীর প্রশান্তি। এক ঝলকে দেখে কারও মনে হবে না তাঁর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সঙ্গে ভন্সালী আশ্চর্য ভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন জীবনকে, সাহচর্যকে, নারীর সঙ্গে নারীর বন্ধুত্বকে।
ছবির শুরু থেকে শেষ অসংখ্য সিটি মারার ও হাততালি কুড়নোর মতো সংলাপ। বস্তুত সেট ও সংলাপ— এই দুইই ‘গঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়’-এর মূল আকর্ষণ। এর জোরেই দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা বসে থাকার ধৈর্য দেখানো যায়। যদিও কোনও কোনও দৃশ্য অহেতুক ঠেকে। শীলা মাসি রেডিয়ো শুনতে ভালবাসতেন বলে তার মৃত্যুর পর হঠাৎ আকাশবাণীর থিম মিউজিকের ব্যবহার খানিক হাস্যকর। আজাদ ময়দানে সব দর্শক-শ্রোতাদের পরনে সাদা পোশাক কেন, বা গঙ্গুর সমস্ত সন্তানই (যাদের শিক্ষার অধিকারের জন্য গঙ্গু লড়াই করেন) বা মেয়ে কেন তা বোঝা যায় না। এই রকম ছোট ছোট অসঙ্গতি বাদ দিলে আড়াই ঘণ্টার জমজমাট বিনোদনের জন্য এ ছবি বেশ উপযুক্ত। এক কথায় যদি বলতে হয় তবে এই ছবি গঙ্গুবাইয়ের উদ্যাপন। সেই সঙ্গে আজীবন যা যা মতামত তিনি রেখে এসেছেন তারও উদ্যাপন এই ছবি, যার একটি হল বেশ্যাবৃত্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া।
মিলল কি আইনের স্বীকৃতি? উত্তর মিলুক বা না মিলুক, যৌনকর্মীদের অবস্থা নিয়েও যদি একটি মূলধারার ছবি অন্তত ভাবায়, এই বা কম কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy