কবি অজয় সাহাব এবং সঙ্গীতশিল্পী রাজেশ সিংহ। ছবি: সংগৃহীত।
খুব চেনা কোনও সুরে বাজছে হারমোনিয়াম। সৌম্যকান্তি এক প্রৌঢ়ের কণ্ঠ থেকে যে কথাগুলি বেরিয়ে এল, তার অনুষঙ্গও খুব পরিচিত। ১৯৬১ সাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ এই গানটিকে শুনে চলেছে। এমনকি, তার বিবিধ ব্যবহারও দেখেছে। কিন্তু, সাহির লুধিয়ানভি রচিত এবং জয়দেব সুরারোপিত ‘আভি না যাও ছোড় কর’ বার বার শুনেও শ্রোতা অন্তঃস্থলে বলতে থাকেন ‘দিল আভি ভরা নহি’। এই অনন্ত অতৃপ্তির পরে কী? সেই প্রৌঢ় গেয়ে উঠলেন এমন কয়েকটি স্তবক, যা সাহির লেখেননি, জয়দেব সুর করেননি, যাতে দেব আনন্দ ঠোঁট মেলাননি, যা হয়তো অনাগত বর্ষার মেঘের মতো থমকে ছিল শ্রোতার মনের সীমানার একটু বাইরে— “আভি উঠা হুঁ নিদ সে/ তুমহারা খোয়াব দেখ কে/ আভি তুম এক খোয়াব হো/ আভি পসে হিজ়াব হো/ ম্যাঁয় ছু কে তুমকো দেখ লুঁ/ কে সচ মেঁ মেরে পাস হো/ মুঝে থি জিসকি জুস্তজু/ ওহি মেরে তালাশ হো…”। দর্শকাসনের উপরে যেন নেমে এল সেই ‘জুস্তজু’ (সন্ধান), গান ফিরে এল ‘ধুয়ায়’। “আভি না যাও ছোড় কর/ দিল আভি ভরা নহি”। সাহিরের লেখা পঙ্ক্তিমালার পরে এই নতুন স্তবক যেন জানিয়ে দিল— আরও আছে। কবিতার কোনও শেষ নেই।
ইউটিউবে এই মুহূর্তে তাঁদের চ্যানেল ‘আফলাজ় আউর আওয়াজ়’-এর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। অজয় পাণ্ডে এবং রাজেশ সিংহের জুড়ি নিয়ে উপমহাদেশের গজ়লপ্রেমীরা আবেগে ভাসছেন। কবি বা শায়ের হিসাবে অজয়ের যাত্রা শুরু গজ়লের স্বর্ণযুগেই। তাঁর লেখা ‘নজ়ম’ গেয়েছেন পঙ্কজ উধাস বা জগজিৎ সিংহের মতো ব্যক্তিত্বও। জনপ্রিয় উর্দু কবিতার ওয়েবসাইট রেখতা ডট কম-এ গেলে পড়া যায় অজয়ের কবিতা। উর্দু কাব্যের দুই দিকপাল মির তাকি মির এবং মির্জ়া গালিবের দুই ভিন্ন ভাবধারা এক সময় একীভূত হয়েছিল সাহির লুধিয়ানভি থেকে শুরু করে পাকিস্তানের কবি ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়ের কলমেও। অজয়ও সেই পথেরই পথিক। মিরের আবেগ আর গালিবের বৌদ্ধিক কবিকৃতির ঝলক তাঁর লিখনেও। কিন্তু, মৌলিক কবিতার সমান্তরালে কেন বেছে নিলেন বিখ্যাত গানগুলির নতুন স্তবক রচনার কাজ?
যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছিল অজয়ের সঙ্গে। অধুনা মুম্বইবাসী অজয় জানালেন, সাহির লুধিয়ানভি বা মজ়রুহ্ সুলতানপুরির মতো কবির লিখনের প্রতি তাঁর আসক্তির কথা। ‘কভি কভি মেরে দিলমেঁ খয়াল আতা হ্যায়’ বা ‘লাগ যা গলে’-র মতো গানের নতুন স্তবক লিখতে শুরু করেন প্রথমে। মনের ভিতরে নতুন কিছু করার বাসনা প্রায় সব কবিরই থাকে। কিন্তু, একান্ত পরিচিত গানগুলির নতুন স্তবক শ্রোতারা গ্রহণ করবেন কি না, সে কথা একেবারেই ভাবেননি অজয়। নেহাতই সৃষ্টির নেশায় লিখে গিয়েছেন তাঁর প্রিয় গানগুলির নতুন স্তবক। এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে রাজেশের পরিচয়। সেখান থেকেই দু’জনের একত্রে যাত্রা শুরু।
২০১৭ সালে হায়দরাবাদের সালার জঙ্গ মিউজ়িয়ামে তাঁদের প্রথম অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানেই অজয় টের পান, নস্ট্যালজিয়ার সঙ্গে নতুনের এই সংশ্লেষ শ্রোতাদের পছন্দ হয়েছে। তাঁর কথায়, “সৃজনশীলতার সঙ্গে কোনও রকম আপস না করেও যে ঐতিহ্যকে প্রকাশ করা যায়, তা শ্রোতারা বুঝতে পেরেছিলেন।” কার্যত, সাহিত্য জগতে কোনও বিখ্যাত সৃজনের অনুষঙ্গে রচিত কাজ নতুন কিছু নয়। পশ্চিমি জগতে তা ‘পাশতিশ’ নামে পরিচিত। বিশ্বের তাবড় সাহিত্যকর্মের পাশতিশ হয়েছে, যার মধ্যে শার্লক হোমসকে নিয়ে কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র বা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের পাশতিশও লেখা হয়েছে। কিন্তু, কবিতায় পাশতিশ বিরল। সেই বিরল কাজটিই করতে শুরু করলেন অজয় পাণ্ডে। উর্দু কবিতার জগতে ‘অজয় সাহাব’ হিসাবে পরিচিতি বাড়তে লাগল তাঁর। কিন্তু, শুধু নতুন স্তবক রচনা করলেই তো হবে না! সেগুলি গাওয়ার জন্য উপযুক্ত কণ্ঠেরও প্রয়োজন। নব্বইয়ের দশকের পরে গজ়লের শ্রুতি এ দেশে কমে আসে। জগজিৎ সিংহ, পঙ্কজ উধাস, তালাত আজ়িজ় বা পিনাজ় মসানির পরে নতুন নাম সে ভাবে নজর কাড়তে পারেনি। সে দিক থেকে দেখলে, রাজেশ সিংহের কণ্ঠ তাঁকে আকৃষ্ট করে। রাজেশ বেনারস ঘরানার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী। পরে কলকাতায় দ্বিজেন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে তালিম নিয়েছেন। গালিব, মির, ফয়েজ় প্রমুখ ইতিহাস প্রসিদ্ধ কবির কাব্যে সুরারোপ করেছেন রাজেশ। সমান্তরালে চালিয়ে গিয়েছেন বশির বদর, আহমেদ ফরাজ়, নিদা ফজ়লির মতো সমকালীনদের রচনাতেও সুরারোপ। রাজেশ দীর্ঘ সময় পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন। বাংলা বলেন প্রায় বাঙালিদেরই মতো। সলিল চৌধুরীর সুরে ‘আনন্দ’ ছবির গান ‘কহিঁ দূর যব দিন ঢল যায়ে’-এর অজয় রচিত পাশতিশ গাইতে গাইতে অনায়াসে চলে যান ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’য়। উর্দু নজ়মের শব্দঝঙ্কারে মিশে যায় ভাগীরথী-তীরের নাগরিক বিষাদ। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্বের ছাত্র রাজেশ এমফিল করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে সরকারি উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কিন্তু, সুরসাধনা থেকে সরে আসেননি। আজ কোনও মঞ্চে অজয় সাহাবের পাশে রাজেশের উপস্থিতি অনিবার্য। দর্শক আগে থেকেই জানেন, তাঁরা কী পেতে চলেছেন তাঁদের নিবেদন থেকে। কখনও তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ দেন জ্ঞানিতা দ্বিবেদী। এ ভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে ‘গুমরাহ্’ ছবির জন্য সাহির লুধিয়ানভির লেখা ‘চলো এক বার ফির আজনবি বন যায়ে’র নতুন স্তবকমালা। মূর্ত হয়ে ওঠে ‘মমতা’ ছবিতে মজ়রুহ্ সুলতানপুরির লেখা ‘রহেঁ না রহেঁ হম’-এর সম্প্রসারিত অংশ।
অজয় জানালেন, চল্লিশের দশক থেকে সাহির লুধিয়ানভির মতো কবি হিন্দি ছবির গানকে কাব্যিক স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই জায়গাটি আজ অনেকটাই শূন্য। সেই শূন্যতাকে তাঁর সাধ্যমতো ভরাট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পেশা, গান লেখাই। কিন্তু, তেমন উচ্চতার কাব্যিক চরিত্র না থাকলে ফিল্মের জন্য গান লিখতে নারাজ অজয় সাহাব। তথাকথিত ‘ট্র্যাডিশন’ আঁকড়ে থাকায় কি নতুন প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে তাঁর গানের প্রতি? উত্তরে বেশ প্রত্যয়ী অজয়। জানালেন, লন্ডন, সুইৎজ়়ারল্যান্ড, দুবাইয়ের মতো জায়গাতেও অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখেছেন ১৬ থেকে ৩০-এর কোঠার শ্রোতারা তাঁদের ঘিরে ধরেছেন, সলিল চৌধুরী, খৈয়ামের সুরে আবেগে ভেসেছেন। পুরনো গানের নতুন স্তবকের সংযোজন তাঁদের কৌতূহলী করে তুলছে।
এর বাইরে নতুন কাজ? ইউটিউবে অজয়ের নজ়ম-এ রাজেশের সুরে ‘লফ্জ় ভিগে হ্যায়’ অ্যালবামটির শ্রোতার সংখ্যা এই মুহূর্তে তিন কোটিরও বেশি। অথচ গজ়লের ‘স্বর্ণযুগ’ অতিক্রান্ত বলে আফসোস করতে শোনা যায় অনেককেই। সে দিন আর নেই যে, লাউডস্পিকারে ভেসে আসা ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ’ শোনার জন্য ট্রেন না ধরে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে বসে থাকবেন কোনও যুবা। কলেজ ক্যান্টিন মুখরিত হবে ‘তুম ইতনা যো মুসকুরা রহে হো’-র সুরে। ‘ঝুকি ঝুকি সি নজ়র’ নামিয়ে কোনার বেঞ্চিতে বসে থাকবে ফার্স্ট ইয়ারের সালওয়ার-কামিজ। দৃষ্টি ঝাপসা করে দেবে ‘রেখায়োঁ কি খেল হ্যায় মুহব্বত’-এর মতো পঙ্ক্তি। অজয় কি ফেরাতে চাইছেন সেই অপেক্ষার বর্ণালিগুলিকে? ফিরিয়ে আনতে চাইছেন, ‘পত্তা পত্তা বুটা বুটা’ ছড়িয়ে পড়া প্রেমের খবরকে? মির তাকি মিরের কালসীমা পার হয়ে আসা গজ়লেও নতুন পঙ্ক্তি সংযোজন করেছেন অজয়। মজরুহ্ সুলতানপুরি সেই কাব্যে তাঁর পঙ্ক্তি যুক্ত করেছিলেন। অজয় তাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিলেন নতুন প্রজন্মের দিকে। পীযূষ পানওয়ারের কণ্ঠে সেই পাশতিশ এই মুহূর্তে ভাইরাল। অজয়ের নতুন স্তবকে কণ্ঠ দিচ্ছেন পাপনের মতো খ্যাতনামী শিল্পীরাও।
‘আফলাজ় আউর আওয়াজ়’-এর দৌলতে এক দিকে যেমন প্রৌঢ়দের সামনে এক লহমায় খুলে যাচ্ছে স্মৃতিসড়কের দরজা, অন্য দিকে তেমনই নতুন প্রজন্মও ফিরে শুনছেন সাহির অথবা মজ়রুহ্কে। আবিষ্কার করছেন হারিয়ে যাওয়া এক মহামূল্যবান রত্নকে। যার নাম ‘বিষাদ’। গজ়ল বিষণ্ণ হৃদয় থেকে উঠে আসা এক শিল্প, সে কথা সম্প্রতি বুঝিয়েছেন কর্ণ জোহর তাঁর ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি’ ছবিতে। বিস্মরণের অসুখে সব কিছু ভুলে যাওয়া ধর্মেন্দ্র যখন তাঁর বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে আনলেন হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার মুখচ্ছবি, তখন তাঁর দৃষ্টির শূন্যময়তা পূরণ করে দিচ্ছে ‘আভি না যাও ছোড় কর/ দিল আভি ভরা নহিঁ’। সত্যিই তো ছেড়ে যাওয়া হবে না এই প্রেমের সংসারকে! অন্তরের অতৃপ্তি দিগন্তখোলা প্রান্তরে চৈত্রবাতাসের মতো ঘূর্ণি তুলে পাক খাবে। মনে হবে, আরও আছে…। গজল কখনও থেমে থাকে না। এক যুগের স্রষ্টার শিল্পের সূত্র ধরেন আর এক যুগের কবি। নজ়মের পরে নজ়ম পার হয়ে গান বয়ে যায় অনন্তের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy