ভাঙন ধরেছেন তথাগত এবং দেবলীনার দাম্পত্য?
‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে, আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে...’
অনেকখানি সময় কেটে গেল টের পাওয়া যায়, সমাজ-পরিবার-সমকালীন মানুষ ঠিক কেমন দূরত্বের গ্রহে বসবাস করে আমাদের চলচ্চিত্রে দেখা, বইয়ে পড়া পৃথিবী থেকে।
ক্ষেত্র বিশেষে নিজেকে বুদ্ধিমান আর সবজান্তা ভাবতে যতই ভাল লাগুক, আদপে যে আমি বোকার হদ্দ তা নিয়ে আমার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই। নিজের চোখ আর কানের উপর এতটা নিশ্চিন্ততা আর বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা সত্বেও 'সময়' যে কান ধরে গরুকে ডাইনোসর আর ডাইনোসরকে টিকটিকি বানিয়ে ফেলতে পারে, সে বোধ আর আমার কোথায়? তাই আশপাশের মানুষকে যুক্তি আর মানবিকতার আতশকাচে দেখা আমি নিছকই একজন ধোঁয়াটে মানুষ হয়ে থেকে যাই। যার একটি হল এক আস্ত 'স্বপ্নদ্বীপ'-এর একার মালিকানা। উঁচু থেকে পড়লে চোটও বেশি লাগে, এ কথা খুব স্বাভাবিক। আর স্বপ্নদ্বীপের সব ক’টি বাড়ি যেখানে মেঘেদের কাছাকাছি।
কেউ বলছে, অষ্টমীতে গরু রান্নার শাস্তি। কেউ বলছে, বয়সে বড় তো... তাই। কেউ বলছে, ছেলেটা চরিত্রহীন। আবার কেউ বলছে সব নাটক! কেউ কেউ এও বলছে, অন্য কারওর জন্য ছেড়ে দিয়েছে। সবাই কিছু না কিছু বলছেই। কারণ, আমরা বলেছি ব্যক্তিগত, আমাদের বলার কিচ্ছু নেই। যা কিছু ব্যক্তিগত, তা-ই স্বাধীন। 'ব্যক্তিগত' শব্দটি কোনও রকম ঢাল কিংবা আড়াল নয়, এ এক ধরনের সহবতের অভ্যাস। সচেতন মনুষ্যত্ববোধের প্রমাণপত্র। যার বিশ্বাসে আমাদের কাছের মানুষেরা নিশ্চিন্তে স্বপ্ন, হিংসে, রাগ, হতাশা ভাগ করে যান, নির্দ্বিধায়...। ভবিষ্যৎ যাই লুকিয়ে রাখুক আস্তিনে, উল্টোদিকের প্রতি ভরসা থাকেই, আজীবন। ভরসা থাকে দাবিহীন বন্ধুত্বে।
দেবলীনা আর আমি এক সঙ্গে যে হাঁটা শুরু করেছিলাম, তা আজীবন এক ছাদের নীচে থাকার বাধ্যতামূলক শংসাপত্র-সহ বিক্রি হয় না কোনও বিয়ের ছাদনাতলায়। বিয়ে পারিবারিক এবং সামাজিক স্বীকৃতির মাধ্যম হতে পারে বর্তমান ‘কনজিউমার সভ্যতা’কে টিকিয়ে রাখার জন্য, স্থান বিশেষে যার রকমফের ঘটে। কিন্তু আমি 'বিয়ে' নামক বিষয়টিকে বরাবরই কেজো কিছু সুযোগ-সুবিধার মাধ্যম ছাড়া কোনও ভাবেই দেখে উঠতে পারিনি। যেমন, সে পাসপোর্ট অফিসই হোক কিংবা এলআইসি পলিসির নমিনি। আদপে দুটো মানুষ যখন নির্ভর করতে শুরু করে, বিশ্বাস করতে শুরু করে, ভালবাসতে শুরু করে তাদের ‘ভাল বাসা’র নিশ্চিন্ত আশ্রয়টাকে; সেটিই বোধ হয় 'বিয়ে' নামক ধারণার প্রকৃত মূল্যায়ন। অন্তত আমার কাছে।
থাইল্যান্ডের কো লাণ্টার বিচে আমি আর দেবলীনা যখন সূর্যকে লাল থেকে হলুদ, হলুদ থেকে কমলা আর কমলা থেকে এক আশ্চর্য রঙে ডুবে যেতে দেখেছি, শ্রীলঙ্কার ইয়ালার জঙ্গলে একটা কাঠের বাড়িতে বসে ফায়ারপ্লেসের আগুনের ওমে একটু একটু করে উষ্ণ হয়েছি, সেরেঙ্গেটিতে ভোরবেলা তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখেছি তাঁবুর সামনে দুটো জিরাফ দাঁড়িয়ে পাতা চিবোচ্ছে একটুও ভয় না পেয়ে, রাতের বেলা তাঁবুতে ফেরার সময় টর্চের আলোয় একসঙ্গে দেখেছি চারপাশে ঘিরে থাকা হায়নাদের, সমুদ্রের নীচে প্রথম বার একসঙ্গে দেখেছি একটা অন্য গ্রহ, যেখানে শব্দ নিষিদ্ধ, কিংবা রঙিন মাছেদের ঝাঁকে প্রথম বার স্কুবা ডাইভিং একসঙ্গে, না ফিরতে পারার ভয়-- আমার কাছে বিয়ের মানে এই সব। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া তাদের প্রয়োজন, কুকুরদের জন্য এক সঙ্গে মিছিলে হাঁটা, চিৎকার করা অবোলাগুলোর শব্দ হয়ে, উঁচু ছাদে আটকে পড়া বেড়াল উদ্ধার, হাতে দুটো বালতি ভর্তি খাবার নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া্ খাবার দেওয়ার সময় কে কাগজ পাতবে আর কে খাবার দেবে, তাই নিয়ে ঝগড়া করা.. আমার কাছে বিয়ে মানে এই সব।
প্রথমে ছোট ছবি ‘শুঁয়োপোকা’। নায়িকা দেবলীনা। নিজেদের বাড়িতেই সব সাদা চাদরে ঢেকে শ্যুটিং। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা। ঘুরতে যাওয়ার অজুহাতে একটা আস্ত ছবির অংশ বিদেশে ক্যামেরাবন্দি করে ফেলা, আমার জন্য বিয়ে মানে এই সব। আরও অনেক না হওয়া সিনেমার চিত্রনাট্য, ক্রমাগত নতুন দেশের খোঁজ মানচিত্রে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, সমাজের নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো বাঁচার যে বিয়ে আমি আর দেবলীনা করেছিলাম, সেই বিয়েটি মুক্তির। আসলে শেয়ালদের ভিড়ে আমি ভান করে যাওয়ার অভিনয় শিখিনি। যে বাবা-মা আমায় বড় করেছেন তাঁরা আমায় ব্যক্তিস্বাধীনতা শিখিয়েছেন জীবন দিয়ে। চেয়েছিলেন, ছেলে চিকিৎসক হোক। হয়েছি শিল্পী। তাতেও বাধা দেননি! বরং সব রকম ভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন তাঁদের সবটুকু দিয়ে।
আমার কাছে জীবন চটু্ল, সস্তা সুড়সুড়ি দেওয়া বাংলা ছবির সংলাপ নয়। কোনও চিটিংবাজ প্রযোজকের বিনোদনও নয়। আমার কাছে জীবন বাঁচার স্বাধীনতা। কাউকে একটুও বিরক্ত না করে নিজের মতো বাঁচার স্বাধীনতা। আমি আর দেবলীনা সেই বাঁচাকেই বেছেছি। কারণ বিগত বছরগুলিতেও এ ভাবেই বেঁচেছিলাম আমরা, নিজেদের মতো করে। দুটো মানুষ যখন আলাদা ছাদের নীচে থাকতে শুরু করে তাদের ছাদগুলির মাঝে দূরত্ব থাকলেও তাদের সত্যিগুলি মুছে যায় না। সে কেউ স্বীকার করুক বা অস্বীকার। তাই আমার আর দেবলীনার মধ্যে সত্যি এটাই, আমরা আলাদা ছাদের নীচে থাকলেও আমাদের চারপেয়ে ছানাদের নিয়ে আমাদের রোজ কথা হয়। চিন্তা হয় আমার খোঁড়া জার্মান শেফার্ডকে নিয়ে। তারা রাতে আমার ছাদে ঘুমোতে আসে। রোজ কাজ শেষ করে আমি ওকে আনতে যাই দেবলীনার ছাদ থেকে। চেরি, মোগলি কখনও ঘুরতে ঘুরতে আমার কাছে আসে। কখনও আমি যাই ওদের সঙ্গে দেখা করতে দেবলীনার ছাদের নীচে। কদাচিৎ আপনারাও আমাকে আর দেবলীনাকে একসঙ্গে দেখে ফেলতে পারেন কোনও কফিশপের আড্ডায়! ছাদ আলাদা বলে পথ আলাদা হয়ে যায়নি।
মানুষ দেবলীনার প্রতি আমার বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা একই রকম ভাবে রয়েছে। কোনও কাগজের টুকরো কিংবা 'বিয়ে' নামক কোনও সামাজিক তকমা তাকে মুছে ফেলতে পারবে না। বিয়েকে নিয়ে এত হতচ্ছেদ্দা করার আগে দু-দুটো বিয়ে করে ফেলা লোকের মুখে এ কথা মানাচ্ছে না হয়তো। আসলে ‘বিয়ে’ শব্দটাকে জীবনের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে উঠতে পারিনি কখনও। তাই ‘বিয়ে’ নামক প্রতিষ্ঠানটি বরারবই নিছক কেজো অজুহাত হয়ে থেকে গিয়েছে। যে সমস্ত ভালবাসার মানুষেরা আমাদের এ বিচ্ছেদে হতাশ। ফেসবুকে, ফোন করে যাঁরা তাঁদের দুঃখ জানিয়ে চলেছেন, তাঁদের জন্যই আমার কলম ধরা। কোনও বিচ্ছেদ ছাদে কিংবা কোর্ট পেপারে হয় না, মনের তৈরি করা পাঁচিলে হয়। আমার আর দেবলীনার মধ্যের পাঁচিল এতটাও উঁচু নয় যে, তাতে বিচ্ছেদ হবে! আমরা আগে এক রকম ভাবে ছিলাম। এখন অন্য ভাবে বেঁধে থাকব। কোনও ভাবেই আলাদা হয়ে নয়। বন্ধুত্বে কি আলাদা হওয়া যায়?
আর সেই সমস্ত হঠাৎ শুভাকাঙ্ক্ষী, হঠাৎ আত্মীয় এবং নেটমাধ্যমে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নীতিপুলিশদের এটাই বলার, যখন এক সঙ্গে এক ছাদের নীচে থাকতে শুরু করেছিলাম, আপনাদের ভাবাবেগে আঘাত হল কি হল না, ভাবিনি। তাই আজ একসঙ্গে না থাকার সময়ও বলছি, ‘বেশ করেছি’। দেবলীনা নিরামিষ খাবার খায়। আমি এবং আমার বন্ধুরা গরু, শুয়োর, মুরগি, পাঁঠার মাংস খাই। তার সঙ্গে বিয়ে বা সম্পর্কের কোনও সম্পর্ক নেই। ঠিক যেমন শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে সচেতন মানুষের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। অনেকেই ভাবছেন, এত দিন ‘ব্যক্তিগত’ শব্দটি ব্যবহারের পর আজ এত কথার কারণ কী? কারণ, ‘ব্যক্তিগত’ শব্দটির ব্যুৎপত্তির কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে ব্যক্তি বিশেষে তার যে কোনও সিদ্ধান্তই ব্যক্তিগত। আর যা কিছু ব্যক্তিগত, তাই শুদ্ধ। কোনও ভান বা মিথ্যে ভড়ং ছাড়াই। অনেকেই আছেন, যাঁরা আমায় আর দেবলীনাকে ভালবাসেন শিল্পী আর মানুষ দুই সত্তা মিলিয়ে। চারদিকে যে ভাবে মুখোরোচক খবর পরিবেশিত হচ্ছে একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে, তার মানসিক যন্ত্রণা থেকে তাঁদের মুক্তি দেওয়া আমার কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। তাঁদের ভালবাসি। তাই আমার সত্যিগুলিকে স্পষ্ট করে জানানোর তাগিদ বোধ করেছি। যা এত দিন করিনি।
এবার আসি বিবৃতি চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গে। আমার ছবি ‘ভটভটি’র নায়িকার সঙ্গে আমার যোগাযোগ, সম্পর্ক— সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। যদি কোনও দিন জানানোর মতো কিছু ঘটে, আমি নিশ্চিত জানাব।
‘ইউনিকর্ন’ ছবির নায়িকা দেবলীনা। ‘অপালা’ নামক এক মধ্যবিত্ত মহিলা। এই রোজকার জীবনের দৈনন্দিন বঞ্চনা আর মানিয়ে নেওয়া থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। তার মুক্তি কোনও মানুষের মধ্যে লুকিয়ে নেই। লুকিয়ে আছে তার নিজের মতন বাঁচার মধ্যে। সিনেমার শুরুতে তরুণ মজুমদারের ছবি ‘পলাতক’-এর গানের দুটো পংক্তি তাই ধার করেছিলাম—
"আহা রে! বিধি গো তোর লীলা বোঝা দায়/ যে উড়িয়া বেড়ায় তারে পুরিস খাঁচায়/ সে যে উড়ে যায়, উড়ে যায়, উড়ে যায়, যায় যায় যায়....."
ReplyForward
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy