‘গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা’ নিয়েই জল্পনা।
ভোটের মুখে গভীর চিন্তায় টলিপাড়ার একাংশ। কারণ, সেই অংশকে নিয়ে আগামী দিনে ‘গভীর ভাবে ভাবা’র একটি চিঠি পৌঁছেছে টলিউডের শিল্পী এবং কলাকুশলীদের কাছে। চিঠি পাঠিয়েছেন স্বরূপ বিশ্বাস এবং অপর্ণা ঘটক। এঁদের মধ্যে প্রথমজন রাজ্যের মন্ত্রী তথা টালিগঞ্জের বিদায়ী বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের ভাই। যিনি শিল্পীদের সংগঠন ফেডারেশনকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন।
ঘটনার সূত্রপাত সেই ‘ফেডারেশন’-কে কালিমালিপ্ত করার প্রতিবাদে রবিবার ‘ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস্ অ্যান্ড ওয়ার্কার্স্ অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ আয়োজিত এক মৌনীমিছিল নিয়ে। সূত্রের খবর, সেই মিছিল এবং জমায়েতে উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল না। কারণ, সে দিন টলিপাড়ায় কোথাও শ্যুটিং চলছিল। আবার কোনও পরিচালক বোলপুরে গিয়েছিলেন ছবির কাজে।
সম্প্রতি হাওড়ার এক জনসভায় বিজেপি-র ভবানীপুর কেন্দ্রের প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষ দাবি করেছিলেন, টলিউডে ‘মাফিয়ারাজ’ চলছে। তারই প্রতিবাদে রবিবার ওই প্রতিবাদী মৌনীমিছিল করা হয়। ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ এবং সম্পাদক অপর্ণা একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, চড়া রোদ মাথায় করে মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সামিল হন টালিগঞ্জের বেশির ভাগ কলাকুশলী। তাঁদের প্রত্যেককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানিয়েছে ফেডারেশন।
বিবৃতির শেষের কয়েকটি লাইন প্রণিধানযোগ্য। যেখানে বলা হয়েছে, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, যে সমস্ত স্বনামধন্য কলাকুশলীরা যেমন পরিচালক, চিত্রশিল্পী, ক্যামেরা পার্সন, রূপটান শিল্পী প্রমুখেরা আজকের এই ঐতিহাসিক মিছিলে যোগদান করলেন না, ফেডারেশনের অপমানের বিরোধিতা করলেন না, আগামী দিনে ফেডারেশন তাদের নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করবে’।
এই ‘গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা’ নিয়েই জল্পনা। এর অর্থ কী?
রুদ্রনীলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই প্রতিবাদ মিছিল। সোমবার তিনি বললেন, ‘‘ইন্ডাস্ট্রিতে মাফিয়ারাজ চলছে। যার ফল ভুগছেন অসংখ্য কলাকুশলী। প্রতিভার এখানে কোনও জায়গা নেই। ফেডারেশনের সমর্থন থাকলে, সংগঠনের কার্ড থাকলেই এখানে কাজ করতে পারেন যে কেউ। নয়তো নয়।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘রবিবারের মিছিলে যাঁরা সামিল হয়েছেন, তাঁরা ফেডারেশনের ভয়ে ভীত। স্রেফ রুজিরুটির তাগিদে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। এ কথা অনেকেই আমাকে আগেও জানিয়েছেন। এ বারেও বলেছেন।’’ রুদ্রনীলের প্রশ্ন, ‘‘কেন এই ভয় কাজ করবে সকলের মনে? এই মনোভাব কাজের পরিবেশ নষ্ট করে দেয়।’’
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছিলেন পরিচালক সঙ্ঘমিত্রা চৌধুরীও। তাঁর কথায়, ‘‘রুদ্রনীল ঘোষ একেবারেই কলাকুশলীদের মাফিয়া বলেননি। বলেছেন মন্ত্রী স্বরূপ বিশ্বাস এবং ফেডারেশন সভাপতি অরূপ বিশ্বাসকে।’’ প্রত্যাশিত ভাবেই রুদ্রনীলের ওই অভিযোগকে সমর্থন জানিয়েছিলেন টালিগঞ্জ বিধানসভায় অরূপের বিরুদ্ধে বিজেপি-র প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। এর পরেই স্বরূপের সমর্থনে রবিবার মৌনীমিছিল হয়। সঙ্ঘমিত্রা ওই মিছিলে যোগ দেননি। পাশাপাশি তাঁর ক্ষোভ, ‘‘মিছিল বার করাটা বড় কথা নয়। খারাপ লেগেছে, ভয় দেখিয়ে জোর করে মিছিলে লোকজনকে সামিল করা।’’ তিনি সাফ বলেছেন, ‘‘কাজ চলে যাবে, কার্ড নিয়ে নেওয়া হবে, আগামী দিনে কাজ পাবে না! এই ভয় দেখিয়ে অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। টলিউডে এই মুহূর্তে বহু পরিচালক, কলাকুশলীর হাতে কাজ নেই। তারকারা সে জন্যই দলে দলে যোগ দিচ্ছেন রাজনীতিতে। তার উপর এ ভাবে যদি হুমকি, ধমকি দেওয়া হয়, তা হলে ফল আরও ভয়ঙ্কর হবে।’’
অভিনেত্রী তথা বিজেপি নেত্রী রূপাঞ্জনার কথায়, “এ সব কী হচ্ছে? ‘ভেবে দেখা’ বলতে কী বোঝাচ্ছে ফেডারেশন? আরও পরিষ্কার করুক!” এই ‘ভেবে দেখা’ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেশবিন্যাস শিল্পীও। তিনি জানান, তাঁর শ্যুটিং ছিল রবিবার। তাই জমায়েতে যেতে পারেননি। সে কথা তিনি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন সংগঠনকে। তাঁর মতে, ‘‘লোকের বলার মুখ আর চলার পথ কোনও দিনই বন্ধ করা সম্ভব নয়। কে কী বলল তা নিয়ে মিছিল না ডেকে যা বলছে তা মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।’’
‘গভীর ভাবে ভেবে দেখা’ কি আসলে ভবিষ্যতের জন্য প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি? আনন্দবাজার ডিজিটালের প্রশ্ন শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন অপর্ণা। প্রথমে জানতে চান, সদস্যদের জন্য দেওয়া বিবৃতি কী করে আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে পৌঁছয়? সংবাদমাধ্যমের কি আদৌ প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে এ বিষয়ে? পরে তিনি বলেন, ‘‘সংগঠন সমস্ত সদস্যের দায়িত্ব নিয়ে চলছে। সেই সংগঠন এবং সদস্যরা মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত। তাই রবিবার দুপুরে নিজের ইচ্ছায় পথে নেমেছিলেন কলাকুশলীরা। যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁদের দায় থেকে যায় সংগঠনকে প্রকৃত কারণ জানানোর। সেই কথাই বিবৃতিতে বলা হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘কেউ যদি সংগঠনের সঙ্গে সহমত না হন, সেটাও নির্ভয়ে জানাতে পারেন।”
‘ভয় দেখিয়ে মিছিল করানো’-র অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপও। তাঁর দাবি, ‘‘সকলেই প্রশংসা করেছেন। কেউ কোনও বিরোধিতা করেননি। তার পরেও যদি কেউ কিছু বলে থাকেন, তা হলে বলব, এক দল ঘাম ঝরিয়ে মিছিলে হাঁটবেন আর এক দল বাড়িতে বসে আরাম করে বিরোধিতা করবেন— এই মানসিকতা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, এই লড়াইটা কিন্তু সকলের।’’
স্বরূপের মন্তব্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন ‘আর্টিস্ট ফোরাম’-এর সদস্য এবং অভিনেতা কৌশিক সেন। তাঁর কথায়, ‘‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বার বার অস্বস্তিতে ফেলছেন স্বরূপ বিশ্বাস। এ ধরনের মন্তব্য তাঁর নিজের ভাবমূর্তিতেও আঘাত করছে।” বিধানসভা নির্বাচনে কেবল বিজেপি-কেই প্রতিহত করতে চান কৌশিক। কারণ, তাঁর মতে, তৃণমূলের থেকে অনেক বেশি ক্ষতিকর গেরুয়া শিবির। কিন্তু পাশাপাশিই বললেন, ‘‘আগেও স্বরূপ বিশ্বাসের কিছু মন্তব্য ঘিরে সমালোচনা হয়েছে। আমার পরামর্শ, যদি তৃণমূল ফের ক্ষমতায় আসে, স্বরূপ বিশ্বাসকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা উচিত মুখ্যমন্ত্রীর।’’
অভিনেতা শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন। কারণ, তিনি ওই বিবৃতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ‘আর্টিস্ট ফোরাম’-এর সদস্য। কিন্তু ফেডারেশনের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ বা নিয়মাবলী সম্পর্কে জানা নেই। বলা হয়েছে, ‘ভাবনা চিন্তা করা হবে’। আদৌ কী হবে? তাঁদের সিদ্ধান্ত না জেনে কিছু বলা উচিত না। তা হলে সেটা কল্পনা করে মতামত পেশ করা হয়ে যাবে।’’
‘প্রথমা কাদম্বিনী’ এবং ‘ত্রিনয়নী’ ধারাবাহিকের পরিচালক স্বর্ণেন্দু সমাদ্দারও ওই বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে রবিবার তাঁর শরীর ভাল ছিল না বলে মিছিলে থাকতে পারেননি। ‘খড়কুটো’ ধারাবাহিকের অভিনেতা কৌশিক রায় অবশ্য বললেন, “এটা আক্রমণাত্মক রাজনীতি। টলিপাড়ায় এই নীতির বিরোধিতা করার জন্যই আমি বিজেপি-তে যোগ দিই। আমার দল এটাকেই দূর করার চেষ্টা করছে। কোনও শিল্পী না আসতে পারলে তাঁর অনুপস্থিতির কারণটা একটু জেনে নেওয়া দরকার। নতুন প্রজন্ম কিন্তু এ ধরনের রাজনীতি মেনে নেবে না।” করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ওই জমায়েতে থাকতে পারেননি লেখক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, প্রযোজক শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
ওই মৌনীমিছিল এবং জমায়েত নিয়ে কিছুই জানতেন না পরিচালক অরিন্দম শীল। তবে ‘ভেবে দেখা’ নিয়ে তিনি বিস্মিত। তাঁর কথায়, “জমায়েত নিয়ে আমি কিছুই জানতাম না। তবে অনুপস্থিতির জন্য এই ধরনের হুমকিতে অবাক হচ্ছি!’’ তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর টলিউডের যাবতীয় কাজকর্ম তদারকির ‘দায়িত্বে’ অরূপ-স্বরূপ। কিন্তু গত বছর আর্টিস্ট ফোরাম এবং প্রযোজক সংগঠনের মধ্যে বিরোধে স্বরূপের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। নবান্নে আর্টিস্ট ফোরাম এবং টেকনিশিয়ানদের বৈঠক চলাকালীন তাঁর আচরণে ক্ষুব্ধ হন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। তার পরে দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল যুব সংগঠনের সভাপতির পদ থেকে স্বরূপকে সরিয়ে দেন তিনি। স্বরূপ অবশ্য ‘গভীর ভাবে’ ভাবা থেকে বিরত থাকেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy