Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
sushant singh rajput

হাতের লেখার ধরনই বুঝিয়ে দিয়েছিল সুশান্তের মনের উথালপাথাল

সেই ভালবাসার ছায়াপথ ধরে বিষণ্ণতার মেঘ ঢুকে পড়ল কী ভাবে?  সেই সুলুকও রয়েছে তাঁর হাতের লেখাতেই। বলছেন মোহন বসু।

অর্পিতা রায়চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০২০ ১৮:০৫
Share: Save:

তাড়া করে বেড়াচ্ছিল অস্থিরতা। ক্রমশই ছোট করে নিয়েছিলেন নিজের চারপাশের বৃত্ত। ঘরবন্দি অবস্থাকেই মনে করছিলেন নিরাপদ আশ্রয়। হাতের লেখা বিশ্লেষণ করে সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মানসিক অবস্থার এই ভঙ্গুর খণ্ডচিত্রই ধরা পড়ছে। দাবি গ্রাফোলজিস্ট মোহন বসুর। কলকাতার ইনস্টিটিউট অব গ্রাফোলিজর ডিরেক্টর এই হস্তাক্ষর বিশারদের কথায়, হাতের লেখার ধরন বিশ্লেষণ করলে ধরে ফেলা যায় কারও মনের অলিগলির খবর।

প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মনের অলিন্দ কী করে কানাগলিতে পরিণত হয়েছিল, তার হদিশ রয়েছে প্রয়াত অভিনেতার হাতের লেখাতেই। মানসিক চাপে যে এই তারকা ধ্বস্ত ছিলেন, তা ধরা পড়েছে সেখানে। অভিমত, গ্রাফোলজি নিয়ে গত সাতাশ বছর ধরে চর্চা করে আসা মোহন বসুর।

বর্তমানে হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে গ্রাফোলজির প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট থেকে সাধারণ উৎসাহী। কেউ কাজের প্রয়োজনে, কেউ আবার নিছক উৎসাহের বশে জানতে চান হস্তাক্ষর বিজ্ঞান নিয়ে। কিন্তু সত্যি কি গ্রাফোলজি পারে মানুষের মনের ছবি তুলে ধরতে? একাধিক বইয়ের লেখক মোহন বসু বললেন, হাতের লেখা হল মানুষের মনের আয়না। সেখানে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। মূলত পাশ্চাত্য ধারণার এই প্রশিক্ষণ এখন এ দেশেও চূড়ান্ত জনপ্রিয় অপরাধবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। ফরাসি ও জার্মান, দু’ দেশের ঘরানায় বিভক্ত গ্রাফোলজি।

গ্রাফোলজিস্ট মোহনের মতে, আরও পাঁচজনের মতো সুশান্তের ক্ষেত্রেও তাঁর অবচেতন মনের আয়না হয়ে উঠেছিল হস্তাক্ষর। দৃশ্যত সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত হাতের লেখা। কিন্তু তার মাঝেই লুকিয়ে আছে আবেগ ও অনুভূতির চাপানউতোর। আমাদের চোখে ধরা না পড়লেও সেই সূক্ষ্মতা ধরা পড়তে বাধ্য গ্রাফোলজিস্টের দক্ষ নজরে।

আরও পড়ুন: ‘ইন্ডাস্ট্রি আত্মসমীক্ষা করুক’, সুশান্তের মৃত্যুতে এ বার তোপ মনোজ বাজপেয়ীর

সুশান্তের ক্ষেত্রেও তাঁর অবচেতন মনের আয়না হয়ে উঠেছিল হস্তাক্ষর, ছবি:সোশ্যাল মিডিয়া

সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ দেওয়া মোহন বসুর বিশ্লেষণ বলছে, বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে সুশান্তের মতো ব্যক্তিত্ব বিরল। একই সঙ্গে কল্পনাপ্রবণ ও উচ্চাকাঙক্ষী সুশান্তের মানসিকতায় দুর্নীতির লেশমাত্র নেই। এই কল্পনাপ্রবণতা এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাই সুশান্তের মানসিকতার নিগড়। সময়ের সঙ্গে সেখানে কোনও পরিবর্তন হয়নি। তবে তার সঙ্গে সুশান্ত নিজেকে করে তুলেছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। কল্পনাপ্রবণতার পাশাপাশি প্রযুক্তির প্রতি তাঁর একটা ভালবাসা বরাবর রয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই দানা বেঁধেছিল মহাকাশের প্রতি আগ্রহ। লাইট সাউন্ড ক্যামেরার দুনিয়ার কঠোর ইঁদুরদৌড়েও সে ভালবাসায় ভাটা পড়েনি। রাতভর তিনি চোখ রাখতেন আকাশজুড়ে গ্রহ-তারা-ছায়াপথের সংসারে।

কিন্তু সেই ভালবাসার ছায়াপথ ধরে বিষণ্ণতার মেঘ ঢুকে পড়ল কী ভাবে? সেই সুলুকও রয়েছে তাঁর হাতের লেখাতেই। বলছেন মোহন বসু। তাঁর কথায়, ‘‘সময় ও মানসিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় ব্যক্তিবিশেষের হাতের লেখা। পাল্টে গিয়েছিল সুশান্তের হাতের লেখাও। ইদানীং তাঁর লেখা প্রতিটি শব্দের মধ্যে দূরত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ তিনি আরও বেশি চুজি হয়ে পড়েছিলেন। ক্রমশ আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্ত।’’ এই মানসিক প্রবৃত্তিই মানুষকে সচেতন করে দেয় তাঁর কাছের লোক বাছাই করার বিষয়ে। এবং সেই প্রবণতা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল মেধাবী সুশান্তের সঙ্গে। হাসিখুশি হলেও তিনি সবার সঙ্গে সমানভাবে বা সহজে মিশতে পারতেন না। মানসিকতার সেই দিকই হয়তো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিতে মিলেমিশে কাজ করার ক্ষেত্রে।

ইন্ডাস্ট্রিতে স্বজনপোষণই নাকি সুশান্তকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। এই অভিযোগকে একতরফা ভাবে দেখতে নারাজ গ্রাফোলজিস্ট মোহন। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। তাই তার জিনগত প্রবণতার মধ্যেই পড়ে সঙ্ঘবদ্ধতা। অস্বীকার করে লাভ নেই, সব মানুষের মধ্যেই এই প্রবণতা আছে কমবেশি। প্রত্যেক জায়গায় একটি নির্দিষ্ট কাঠামো আছে। আমাদের সেই কাঠামোয় মানিয়ে নিতে হয়। কারও কারও কাছে এই কাজ খুব সহজ। কিন্তু অনেকেই পারেন না পূর্বনির্ধারিত কোনও নির্দিষ্ট কাঠামোয় নিজেকে মানিয়ে তুলতে। তাঁরাই হয়ে যান সেই কাঠামোয় বিসদৃশ।’’

আরও পড়ুন: ঝগড়া সত্ত্বেও শুধু হেমন্তের জন্য ফিল্মিস্তান স্টুডিও-য় গান গেয়েছিলেন লতা

মোহনের মতে, অসংখ্য সৃষ্টিশীল মানুষের মতো সুশান্ত সিংহ রাজপুতও পড়েন এই দ্বিতীয় দলে। তাঁরা নিজেদের কাজে সেরা। কিন্তু কোনও নিয়মানুবর্তী কাঠামোয় নিজেকে মানিয়ে তুলতে অপারগ। ফলে গভীর প্রতিভার অধিকারী হয়েও তাঁদের হারিয়ে যেতে হয়।

অবসাদগ্রস্ত মনের এই গভীর নিম্নচাপের পূর্বাভাস ছিল সুশান্তের হাতের লেখাতেই, ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া

সুশান্ত কিন্তু প্রথম থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে পা রাখেননি। বরং, মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তাঁর মধ্যে যথেষ্ট ছিল। এবং ইন্ডাস্ট্রি ও দর্শকমহলে তাঁর গুণমুগ্ধের অভাব ছিল না। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক জটিল পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। ফলে তাঁর মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছিল। মেধাবী ছাত্রজীবনের উচ্চাশা বজায় ছিল অভিনেতা হওয়ার পরেও। ফলে শ্রেষ্ঠত্বের ধাপে পা রাখতে না পারার হতাশাও ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে।

এই মানসিক অবস্থা যে কোনও কারণে তৈরি হতে পারে। বিবাহবিচ্ছেদ, প্রিয়জনের মৃত্যু, আর্থিক সঙ্কট বা বর্তমান পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে না পারা। এ রকম যে কোনও কারণে ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারেন যে কেউ। ফলে অবসাদগ্রস্ত মন জুড়ে থাকে উদ্বেগ। ইচ্ছে করে নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখতে। মানসিক পরাজয়ের চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা মাথাচাড়া দেয়।

হস্তাক্ষর বিশেষজ্ঞ মোহনবাবুর মতে, পাশাপাশি দেখা দেয় চরিত্রের চরম বৈপরীত্য। তিনি যা নন, সেটাই হয়ে যান। সম্প্রতি সুশান্ত সিংহ রাজপুতও তাঁর ক্রোধ সংবরণের সীমা হারিয়ে ফেলতেন এই মানসিক অবস্থার শিকার হয়েই। না চাইলেও স্বভাবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল যখন তখন রাগের বিস্ফোরণ এবং বদমেজাজ। সেই প্রবণতার কোনও রেশও কি ছিল তাঁর হাতের লেখায়?

ছিল, জানাচ্ছেন মোহন বসু। তাঁর কথায়, ‘‘সুশান্ত সব সময় কাগজের উপর পেন্সিল বা কলম খুব চেপে ধরে লিখতেন। যাঁরা এ ভাবে লেখেন, তাঁরা মারাত্মক আবেগপ্রবণ হন। যে কোনও মানসিক আঘাতে চরম প্রভাবিত হন। ভুলতে পারেন না সামান্যতম মানসিক আঘাত। মনের কোণের সেই ক্ষত পরে প্রভাবিত করে মানসিকতা।’’

এই পরিস্থিতিতে চরিত্রের শক্তিই দেখা দেয় দুর্বলতা হয়ে। এই মানসিক অবস্থায় আবেগ এবং ক্রোধ, দু’টিই বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। মনের আবহাওয়াও পাল্টে যায় খুব দ্রুত। হয়তো এখন মনের আকাশ পরিষ্কার। পরমুহূর্তেই তা ছেয়ে গেল মনখারাপের কালো মেঘে। সেই কালো মেঘ কেটে গিয়ে আর দেখাই যায় না ঝলমলে সূর্যের হাসিমুখ।

অবসাদগ্রস্ত মনের এই গভীর নিম্নচাপের পূর্বাভাস ছিল সুশান্তের হাতের লেখাতেই। শুধু ছিল না আসন্ন দুর্যোগের হাত থেকে তাঁকে হুঁশিয়ার করার জন্য শক্ত হাতে হাল ধরে থাকা কোনও কাছের কান্ডারি।

তবে মোহন বসুর সতর্কবাণী, মৃত্যুর আগে সুশান্তের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল, তা জানার জন্য সুইসাইড নোট ছিল সেরা উপায়। কিন্তু সেটা পাওয়া যায়নি। ফলে তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন, নাকি এর পিছনে লুকিয়ে আছে আরও কোনও ষড়যন্ত্র, তার নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই যায়। সাম্প্রতিক হস্তাক্ষর দিয়েই খুঁজতে হয়েছে তাঁর মনের অস্থির আকাশকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Sushant Singh Rajput সুশান্ত সিংহ রাজপুত Sushant Singh Rajput Death Graphology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy