বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে সুদীপ্তার কথা।
তখনও ‘সেলেব্রিটি’ কথাটা বহুল প্রচলিত নয়। ফলে, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নামের আগে সেই সময় ‘সেলেব্রিটি’ শব্দটা জুড়েছিল তাঁর কাজের নিরিখে। তখনকার দিনে তিনি আক্ষরিক অর্থেই তারকা পরিচালক ছিলেন। কেন? কারণ, তত দিনে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রয়াত পরিচালকের নাম বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে একাধিক স্বর্ণকমল পুরস্কারজয়ী পরিচালক নিজ গুণে জনপ্রিয়। সবাই এক ডাকে ওঁর নাম জানেন।
স্বভাবতই ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম ছবি ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এর সময় থেকেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমার চোখে তারকা পরিচালক। তখনও আমার ভিন্ন ধারার ছবির সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি। আমিও বুদ্ধদেববাবুর প্রচুর ছবি দেখে ফেলেছি, এমনটাও নয়। তাই কাজ করতে করতে পেরে বুঝেছিলাম, কেন সবাই বলেন তিনি সেলুলয়েডে ছবি আঁকেন! বুঝেছিলাম, এ রকম ভিন্ন ধারার ছবিও বানানো যায়। আমাদের ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন দক্ষিণের বেণুগোপাল। ওঁদের কথাবার্তা, আলোচনা কান পেতে শুনতাম। ২ জনের পাণ্ডিত্য মুগ্ধ করত আমায়।
বুদ্ধদেববাবু খুব ভোরে উঠে আকাশ দেখতেন। আকাশের অবস্থা দেখে ঠিক করতেন কোন দৃশ্যের শ্যুট করবেন। আকাশ নীল, ঝকঝকে হলে একটি দৃশ্যের শ্যুটিং। আকাশ মেঘলা হলে অন্য দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতেন। এ ভাবেই তিনি যেন ছবির আগাম কোরিওগ্রাফি করে নিতেন। ফলে, কাজটাও খুব সহজে হয়ে যেত। আজকের দিনে এই ধরনের ভাবনাচিন্তাই আর হয় না।
‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এ আমাদের দেড় মাসের আউটডোর শ্যুট ছিল। কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য নির্দিষ্ট তারিখ ছিল না। আমি, শ্রীলেখা সহ বাকিদের যা কাজ ছিল সেটা ৭ দিনেই হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের থেকে উনি ১ মাস সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। কারণ, রোজ ভোরে উনি আকাশ দেখে ঠিক করতেন সে দিন ছবির কোন অংশের কোন দৃশ্য নেওয়া হবে। সেই বুঝে আমরা তৈরি হতাম।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যদি মনে করতেন কোনও দৃশ্য একদম ভোরের আলোয় বা সিল্যুয়েটে নেবেন তা হলে সেটা তিনি ওই আলোতেই নিতেন। এক বার ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীতে ভোর সাড়ে ৩টের সময় কলটাইম দিলেন! পুরুলিয়ায় ওই ঠাণ্ডায় আমরা জমে যাচ্ছি। এ দিকে পরিচালকের নির্দেশ না মেনেও উপায় নেই। সবাই আড়াইটের সময় উঠে রূপসজ্জা করে সাড়ে চারটেতে লোকেশনে। গিয়ে দেখি, ক্রেন পাতা হয়ে গিয়েছে। শটটা কী? আমরা হেঁটে আসছি। সিল্যুয়েটে ওই একটি দৃশ্য নেওয়ার জন্য গোটা ইউনিটকে রাত আড়াইটের সময় তুলে দিয়েছিলেন তিনি।
বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা জানেন, এই ধরনের স্বাভাবিক দৃশ্য দিয়েই নিজের ছবি সাজাতেন তিনি। তার জন্য সময় দিতেন। হুড়োহুড়ি করে কোনও কাজ শেষ করতেন না। ওই জন্যেই ওঁর ছবিতে অসাধারণ দৃশ্যপট থাকত। আকাশ আলাদা করে ওঁর ছবিতে জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠত।
প্রথম ছবিতে আমি ভয়ে ভয়ে দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছি। দ্বিতীয় ছবি ‘কালপুরুষ’-এর সময় তুলনায় কিছুটা যেন সহজ হয়েছিলাম। কিন্তু ওই ছবিতে আমার সহ-অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী, রাহুল বোস! সামনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সুদীপ চট্টোপাধ্যায় শ্যুট করছেন। তাঁদের মাঝখানে আমি কথা বলব! আমি চুপ করে সবার কথা শুনতাম। আর শেখার চেষ্টা করতাম। শিখেছিও অনেক কিছু। তবে ওঁর কথা শুনে মনে হত আমার কাজ, ‘আমি’ মানুষটাকে উনি ভালবাসতেন, পছন্দ করতেন। আমার দুর্ভাগ্য, আর কাজ করা হল না ওঁর সঙ্গে।
আজ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কথা লিখতে বসে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে। ‘কালপুরুষ’-এর একটা দৃশ্যের কথা বলি। অনেক দূর থেকে মিঠুনদার হেঁটে আসার দৃশ্য। আমি সেই দৃশ্যে নেই। বাকিদের সঙ্গে আমিও সে দিন শ্যুটিং দেখছি। ওড়িশার কেন্দ্রাপাড়ার রাজবাড়িতে শ্যুট হচ্ছে। অনেক ওপরে ক্যামেরা। অনেকটা নীচ দিয়ে মিঠুনদা হেঁটে এসে বাড়িতে ঢুকবেন। ওই শট নিখুঁত করতে বুদ্ধদেববাবু মিঠুন চক্রবর্তীকে কম করে ৮-১০ বার হাঁটিয়েছিলেন! শেষে মিঠুনদাও বলে ফেলেছিলেন, ‘‘এক ভাবেই তো হেঁটে আসছি। আাবারও...!’’ পরিচালক কানেই তোলেনননি সে কথা। পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলে বুদ্ধদেববাবু কোনও তারকাকেও রেহাই দিতেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy