গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ
মৃত্যুর সামনে তিনি দাঁড়াতে পারতেন না। মায়ের মৃত্যুর দিনেও মায়ের পা জড়িয়ে ছিলেন। মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারেননি। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছিল কোনও মৃতদেহের সামনে যেন তিনি না যান। তবুও গিয়েছিলেন তিনি। লতা মঙ্গেশকর। কিশোরকুমারের মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁর বাড়িতে।
তার পর? প্রেশার তিনশো বাই একশো।
অত্যন্ত স্পর্শকাতর মন। সরস্বতীর আলো! মৃত্যুকে সহ্য হবে কেন তাঁর?
নাহ্, শুধুই সরস্বতী নয়। ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মরাঠি পরিবারে যখন লতা জন্মগ্রহণ করেন, তখন থেকেই মঙ্গেশকর পরিবারে লক্ষ্মী অচঞ্চলা। তাঁর বাবা তো তাঁকে লক্ষ্মী বলেই ডাকতেন। বাবার নাম দীননাথ মঙ্গেশকর। নাট্য অভিনেতা ও গায়ক ছিলেন।
লতাকে প্রথম হেমা বলে ডাকা হত। আগের নাম হেমা থাকলেও, বাবার ‘ভাব বন্ধন’ নাটকের ‘লতিকা’র চরিত্রে প্রভাবিত হয়ে হেমার নাম বদল করে রাখা হয় লতা। যে নাম পরে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। ভারতরত্ন হয়েছেন। জীবিত অবস্থাতেই তাঁর নামে পুরস্কার দেওয়া হত।
মুম্বইয়ের পেডার রোডের বাড়িতে, তিনটে ল্যান্ডলাইনের উপর ভিত্তি করেই বিশ্বসাথে যোগ রেখে গেছেন তিনি। ভারতের সুরসম্রাজ্ঞী!
কাজটাকেই নিজের ধ্যানজ্ঞান রেখেছিলেন। যে কাজ গান গাওয়া। তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘মহল’-এর ‘আয়েগা আনেওয়ালার’ও তো সত্তর বছর পেরিয়ে গেল। গানের বাইরে কোনও কিছুতে জড়াননি তিনি। ছোটবেলা থেকেই জীবনযুদ্ধ। অর্থের তাগিদেই ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছিল। ‘ফিল্মে অভিনয় তেরো বছর বয়সে। ওই মেকআপ আলো লোকজন গ্ল্যামার একদম ভাল লাগেনি আমার! তাই আর অভিনয় করার কথা ভাবিনি’— পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে অভিনয় প্রসঙ্গ এলে এ কথাই বলেছেন লতা মঙ্গেশকর।
জীবনে প্রথম যখন বাবার সঙ্গে মঞ্চে উঠেছিলেন তখন বয়স মাত্র নয়। বার বার বলেছেন, ‘বহুত তকলিফ উঠায়ি হ্যয় ম্যয়নে।’
পরে জীবনের মধ্যগগনে অবশ্য বুঝেছিলেন— মধ্যবিত্ত পরিবারের স্ট্রাগল তাঁকে লতা মঙ্গেশকর তৈরি করেছে। মাটি থেকে উঠে আসা আর মাটির সঙ্গে লেগে থাকা তারারাই সত্যিকারের আর্টিস্ট বলে মনে করতেন তিনি। তাঁর কাছে যেমন ছিল সচিন তেন্ডুলকর বা অমিতাভ বচ্চন। আকাশ ছুঁয়েও যাঁরা মাটির কাছে থাকেন। লতাজির কথায় ‘একদম সিম্পল’।
ছোট বেলা থেকেই লতা মঙ্গেশকরের অন্ধ ভক্ত সচিন তেন্ডুলকর। দেশে-বিদেশে সব সময়ই তাঁর সঙ্গী লতাজির গান। তাই নিজের বাড়ির মিউজিক রুমের জন্য লতা মঙ্গেশকরের ব্যবহার করা কোনও জিনিস চেয়েছিলেন মাস্টার ব্লাস্টার। সচিনের ইচ্ছা মতো, নিজের হাতের লেখা দু’টো গান মাস্টার ব্লাস্টারের হাতে তুলে দেন লতা।
বাবার নাটক লেখা, বাড়িতে গানের ক্লাস, লোকজন— এই সব দেখতে দেখতে তৈরি হয়েছেন লতা। প্রথম দিন স্কুলে গিয়েই অন্য বাচ্চাদের গান শিখিয়েছিলেন। সেই কারণে শিক্ষকের কাছে বকা খাওয়ায়, পরের দিন থেকে স্কুল যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
ইতিমধ্যে বাবার একটা নট্টকোম্পানি ছিল সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা চলে আসেন পুণেতে। বাবাই ছিলেন পরিবারের বটবৃক্ষ। হঠাৎ সেই বাবা চলে গেলেন। লতা মাত্র তেরো। আছে আশা, ঊষা, মিনা আর হৃদয়নাথ। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
পয়সাও সংসারে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ল। কাজে মনপ্রাণ বসিয়ে দিলেন লতা। নাহ্, শোক আগলে বসে থাকেননি। মাঠে নামলেন লড়াই করতে। সাহায্য পেলেন বিনায়ক দামোদর কর্নাটকির, যিনি ছিলেন ‘নবযুগ চিত্রপট’ ফিল্ম কোম্পানির মালিক।
১৯৪২-এ মরাঠি ছবি ‘কিতী হসাল’-এ প্রথম গান রেকর্ড করেন লতা। ১৯৪৫-এ ‘নবযুগ চিত্রপট’ মুম্বই পাড়ি দেয়। লতাজির প্রথম উপার্জন ছিল ২৫ টাকা। প্রথম বার মঞ্চে গাওয়ার জন্য লতা ওই ২৫ টাকা পান।
এ বার লতা আসছেন আরব সাগরের পাড়ে তাঁর সুরের আসন নিয়ে। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে আরম্ভ করেন উস্তাদ আমন আলি খানের কাছে। বিনায়কের মৃত্যুর পর গুলাম হায়দার লতার দায়িত্ব নেন। তিনি লতাকে আলাপ করিয়ে দেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শশধর মুখোপাধ্যায় লতার গলার স্বর শুনে বলেছিলেন, ‘বড্ড সরু গলা’। কিন্তু হায়দার জানতেন, এমন এক দিন আসবে যখন সবাই এই লতার পায়ে পড়ে থাকবে গান রেকর্ডিং এর জন্য।
হায়দারের ‘মজবুর’ ছবিতে ১৯৪৮-এ গান রেকর্ড করেন লতা। এর পর আরও সুযোগ এলেও, তখনও সঙ্গে ছিল সমালোচনা। বলা হত নুরজাহানকে নকল করেন লতা। দিলীপ কুমার লতার উর্দু অ্যাকসেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন! লতা জানতেন সমালোচনা শুনতে। উর্দু শিখতে আরম্ভ করেন তিনি। অবশেষে ১৯৪৯-এ হিট হয় ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। সেখান থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
পঞ্চাশের দশক থেকে আজ পর্যন্ত, বিশ্ব সংগীতের জমি লতার কণ্ঠকে জড়িয়ে আছে। অনিল বিশ্বাস থেকে শচীন দেববর্মণ, খৈয়াম, নৌসদ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কল্যাণজি-আনন্দজি, রামচন্দ্রমের মতো অগুনতি পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন লতা। তাঁর কণ্ঠ মাধুরীর নেশা ছড়াতে থাকে দেশময়, বিশ্বময়। শুধু হিন্দি ছবির গান নয়। গীত-গজল-ভজন-‘অ্যায় মেরে ওয়াতেন কে লোগো’-র মতো দেশাত্মবোধক গানে ভারতকে মনখারাপে ভিজিয়ে রাখেন তিনি। ষাটের দশকে লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের ঘরানায় লতার সুরবিহার দেশ রাগ কালকে ছাপিয়ে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সাতশো গান রেকর্ড করেন লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের সঙ্গে। শোনা যায় লতাকে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টাও হয়েছিল। তিন মাস অসুস্থ ছিলেন তিনি। তাঁর গলার রোম্যান্টিকতা আজও ভারতীয় রোম্যান্সের শেষ কথা।
যতীন মিশ্রর বই ‘লতা সুর গাথা’তে লতাজি বলেছেন, “প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি, আর ভীষণ খিদে পেত আমার। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকত। নানা রকম খাবার পাওয়া যেত কি না, সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে। সারা দিনে এক কাপ চা আর দু-চারটে বিস্কুট খেয়েই কেটে যেত। এমনও দিন গেছে, যে দিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারা ক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত— যে ভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।”
১৯৬৩ সাল। ভারত-চিন যুদ্ধে লিপ্ত। জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তাঁর এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বয়ং। কণ্ঠ দিয়ে জাতিকে এক করে দিতে পারতেন তিনি! কার্গিলের যুদ্ধেও সেনাদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে বেজেছিল লতার সেই গান। আজও ভারতের মতো ভিন্ন ভিন্ন ভাষার রাষ্ট্রে ২৬ জানুয়ারি মানে লতার এই গান!
১৯৭৮ সাল। ভারতের নাইটেঙ্গলকে নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন স্বয়ং রাজ কপূর। তাঁর মেয়ে ঋতু নন্দার বইতে উল্লেখ আছে সেই ঘটনার। লতা অভিনয় করেননি। গান গেয়েছিলেন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। শুধু হিন্দি নয়, আরও পঁয়ত্রিশটা ভাষায় অন্তত হাজার খানেক গান রেকর্ড করেছেন লতা। অভিনয়ের লোভ তাঁকে কাবু করতে পারেনি।
১৯৭৫ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস-এ ছ’হাজার মানুষের সামনে লতা মঙ্গেশকরকে প্রথম নিয়ে আসেন মুকেশ। লতার উপর মোহন দেওরা আর রচনা শাহ-র রচনা থেকে জানা যায়— খালি পায়ে, সাদা বেগুনি পাড়ের সাধারণ শাড়ি আর নিজের হাতে লেখা গানের কাগজ নিয়ে মঞ্চে এসেছিলেন লতা। যেন এক সাধারণ মেয়ে! ততো দিনে হিন্দি ছবির তাবড় নায়িকাদের লিপে তাঁর গান। রেডিও, টেলিভিশনে ঝরে পড়ছে মুক্তদানার মতো সুর। মান্না দে বলেছেন, “যে যত ভালই গাক। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন। ওর মতো কেউ গাইতে পারবে না।” ‘মান্নাদা’র সঙ্গে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, মঙ্গেশকর পরিবার মান্না দে-কে বড় দাদার মতো মানতেন।
নব্বইয়ের দশকে সিনেমার ক্যানভাস বদলালেও লতা রইলেন স্বমহিমায়। নদিম-শ্রবণ থেকে এ আর রহমান, তার আগে আর ডি বর্মণ— কেউ বাদ দেওয়ার স্পর্ধা দেখাননি লতাকে। প্রখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পীকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান অফিসার দে লা লিজিয়ঁ দ্য ’নর প্রদান করেছিল সে দেশের সরকার।
কী এমন ধাতুতে তৈরি তিনি যে অসুস্থ হওয়ার আগের দিনও গান করেছেন?
রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর লতার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। উনি বলতেন, “লতা গলার ব্যাপারে এত পারফেকশনিস্ট যে, ভালবাসলেও আইসক্রিম ছুঁয়ে দেখে না।” জানা যায়, ভরপেট খাওয়া বা আইসক্রিম কোনওটাই গলার জন্য খেতেন না লতা। শোনা যায় রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সঙ্গে গভীর বন্ধুতার সুবাদেই লতা এত ক্রিকেটপাগল হয়ে উঠেছিলেন।
বাংলা ছিল তাঁর ভালবাসার জায়গা। কিশোরকুমার আর হেমন্তদা ছিলেন তাঁর রাখি ভাইয়া। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে যাবতীয় গসিপ উড়িয়ে দিয়েছিলেন সুর সম্রাজ্ঞী। হেমন্ত কন্যা রাণুকে নিজের হাতে সাধ খাইয়েছিলেন। বাংলায় বিবেকানন্দকে নিয়ে গান রেকর্ড করার প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর। সরস্বতীর ইচ্ছেও বুঝি আটকে রাখে সময়! তা হলে কী পরজন্ম?
সলিল চৌধুরীর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন “সলিলদা যোগ্যতা অনুযায়ী কিছুই পেল না।”
ভারতের সর্বকালের সেরা এই গায়িকা নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই ভালবাসতেন। পা অবধি লম্বা চুল! পা অবধি বিনুনি! হঠাৎ-ই কেউ দেখে ফেলতেন বাড়ি গেলে। খোঁপা, ঘোমটা, শাড়ি... আমিকে আগলে রাখার আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর মধ্যে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “অমিতাভ বচ্চন বা সচিনকে কি চিৎকার করে বলতে হয় আমি অমিতাভ! আমি সচিন! আমায় দেখ!?”
অনেকেই জানেন না, ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন তিনি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বার বার যখন ‘আনন্দ ঘন’ নামের কাউকে ডাকা হচ্ছিল, ডকুমেন্ট বলছিল তিনি এখানে উপস্থিত, কিন্তু কেউ পুরস্কার নিতে উঠছিল না স্টেজে। অবশেষে লতা উঠে পুরস্কার নেন। মারাঠি চলচ্চিত্রের রহস্যময় সঙ্গীত পরিচালক আনন্দ ঘন-র রহস্য এ ভাবেই সবার সামনে আসে।
এক অখণ্ডধার রাগের আলাপ ধুন— এ সবের দেশ নেই। ভাষা নেই। তা বয়ে চলে কালের যাত্রায়। এই যাত্রার নাম লতা মঙ্গেশকর। নীরব আত্মার বিপ্লব। বিশ্ব সংগীতের সব জাতি তাঁর কাছে ঋণী। তিনিই পারেন শিল্প, দর্শন, চিত্রকলা, সিনেমা, নাটক, কবিতাকে তাঁর সুরে জাগিয়ে দিতে। এই ঋণ চুকিয়ে দেওয়ার নয়। যে সময়ে তিনি এসেছিলেন সেই সময়ের সমগ্র মানব সভ্যতা তাঁর ঋণ নত হয়ে স্বীকার করছে!
লতা মঙ্গেশকর। এক নীরব আত্মা। সরস্বতী।
সরস্বতীর সৎকার হয় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy