২২ গজ থেকে ছোট পর্দা, কিংবা বিজ্ঞাপনী ছবি— সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জৌলুস সর্বত্র। পাতিলেবু হলুদ রঙের টি শার্ট আর ডেনিমে সেই জৌলুস যেন ঠিকরে পড়েছে! বেহালায় নিজের অফিসে বসে নিচু গলায় কথা শুরু করে ‘প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক’, ‘সঞ্চালক’-এর খোলস খুলে ফেললেন নিজেই! আনন্দবাজার ডট কমের সামনে এ কোন ‘মহারাজ’!
প্রশ্ন: দিলীপ ঘোষ বিয়ের বয়স বাড়িয়ে ৬১ করে দিলেন। পুরুষদের জন্য সুখবর?
সৌরভ: (মৃদু হেসে), মন্দ কী? দিলীপবাবু যদি ভাল থাকেন, ভালই তো। নবদম্পতিকে আমার অভিনন্দন। খুব কাটুক ওঁদের বিবাহিত জীবন।
প্রশ্ন: সারা বাংলা এই একজনের বিয়ে নিয়ে মত্ত! আমির খানের মতো তারকা পিছিয়ে গেলেন...
সৌরভ: আমির খান তাঁর ভাবনা-চিন্তা থেকে যা ভাল মনে করেছেন সেটাই করেছেন। যুগ বদলাচ্ছে।
প্রশ্ন: এত বদল ভাল লাগে? না কি ক্লান্ত লাগে কখনও?
সৌরভ: পরিবর্তন ছাড়া জীবজগৎ অসম্পূর্ণ। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই হবে আপনাকে। যখন যেমন তখন তেমন। নইলে আপনার অস্তিত্ত্ব থাকবে না। আমিও তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি। এটাই তো চলা। জীবন থেমে থাকে না।
প্রশ্ন: সে জন্যই কি ২২ গজ থেকে অভিনয়ে...
সৌরভ: অভিনয়ে বলবেন না। আমি অভিনয় করতে পারি না। সঞ্চালনায় এসেছি। বিজ্ঞাপনী ছবিতে কাজ করি, এই পর্যন্ত।
প্রশ্ন: নীরজ পাণ্ডের ‘খাকি ২’-এর প্রচার ছবিতে আপনি তো অভিনয়-ই করলেন!
সৌরভ: ও, ওটা? (ফের হেসে ফেলে) ওই কাজটি করে ভাল লেগেছে। বিশেষ কোনও মানুষকে মনে করে রাগে চিৎকার করে ওঠা... (আবার হাসি)।
প্রশ্ন: আপনাকে ‘ফেলুদা’র ভূমিকায় অভিনয়ের জন্যও অনেক বার অনুরোধ জানানো হয়েছিল...
সৌরভ: হ্যাঁ হয়েছিল। কিন্তু অভিনয় আমার দ্বারা হবে না। অভিনয় করবও না। তাই রাজি হইনি। রিয়্যালিটি শো ‘দাদাগিরি’-র সঞ্চালনা করতে গিয়েই যা বেগ পেতে হয়েছে!
প্রশ্ন: ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক কি সেই প্রথম থমকেছিলেন?
সৌরভ: প্রথম সিজ়ন সঞ্চালনার পর ধরেই নিয়েছিলাম, পরের সিজ়নে আর ডাকবে না। যাচ্ছেতাই করেছি। তখন মা বলেছিলেন, চেষ্টার বিকল্প কিছু নেই। ধীরে ধীরে আমারও মনে হল, চেষ্টা করেই দেখি না, পারি কি না! ওই যে বললাম, মানুষকে সারা ক্ষণ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। দেখতে দেখতে ১০টা সিজ়ন পেরিয়ে এলাম।
প্রশ্ন: টেলিপাড়া বলছে, ১০ বছরের গাঁটছড়া নাকি খুলতে চলেছে? সৌরভ এ বার স্টার জলসায়?
সৌরভ: হ্যাঁ, একসঙ্গে দুটো রিয়্যালিটি শো স্টার জলসায় আসছে। নতুন রূপে ‘দাদাগিরি’ আর ‘বিগ বস্’। ‘দাদাগিরি’ নামটি হয়তো বদলাবে। এই দুটো অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করব। একদম নতুন রূপে দর্শকদের কাছে আসছি।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: জি বাংলার সঙ্গে বিচ্ছেদ কেন? গুঞ্জন, প্রচুর পারিশ্রমিক পাচ্ছেন...
সৌরভ: নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে আমায়। আমি সেটা গ্রহণ করেছি। নতুন নতুন কাজ, নতুন কিছু করার নেশা সারা ক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই কারণেই নতুন চ্যানেলে নতুন রূপে।
প্রশ্ন: পারিশ্রমিকের অঙ্ক সৌরভকে টানে না?
সৌরভ: আমায় কাজ টানে। কাজ করলে তো উপার্জন হবেই। শুধুই উপার্জন আমার লক্ষ্য নয়। একটা উদাহরণ দিই। দর্শক ‘দাদাগিরি’ দেখতে ভালবাসেন। আমায় ভালবাসেন। আমায় দেখতে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা টেলিভিশনে চোখ রাখেন। এটা কম পাওনা নয়! আমার সঞ্চালনায় একটা অনুষ্ঠান রেটিং চার্টে ভাল ফল করে। যা দেখে পরিচালক, দলের বাকিদের মুখ আনন্দে ঝলমলিয়ে ওঠে। এ সব যখন দেখি, পারিশ্রমিকের কথা মনেই থাকে না।
প্রশ্ন: আপনি এত টাকা নিয়েই বা কী করবেন!
সৌরভ: এখন আর টাকার নেশায় কোনও কাজ করি না। কাজের নেশায় কাজ করে যাই। আরও ভাল কী করতে পারি— এই ভাবনা আমায় দৌড় করায়। এখনও কাজের খিদে কমেনি। যত দিন এই খিদে থাকবে, কাজ করেই যাব। তা ছাড়া, যে দিন ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলাম সে দিন কি জানতাম, শহরে আমার চারটে বাড়ি থাকবে? চলার পথে যখন যা এসেছে করার চেষ্টা করেছি। যেখানে সফল হয়েছি সেখানে ফল পেয়েছি।
প্রশ্ন: একমাত্র কন্যা সানার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত...
সৌরভ: উপার্জনের জন্য সানাকে চাকরি করতে পাঠাইনি তো! ওকে কেন পাঠিয়েছি জানেন?
প্রশ্ন: কেন?
সৌরভ: নিয়মানুবর্তিতা শেখাব বলে। চাকরি করা মানে ঊর্ধবতন কর্তৃপক্ষ, সহকর্মীদের সঙ্গে মানিয়ে চলা। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা। সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, ঘুমোতে যাওয়া। ঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া করা। নিজেকে নিজের দায়িত্বে সামলে চলা। এখানে থাকলে রাত ১টা-২টোয় ঘুমোত। সকাল হত বেলা ১টায়।

রাজনীতিতে আসবেন সৌরভ? ছবি: আনন্দবাজার ডট কম।
প্রশ্ন: পেশা দুনিয়ায় টিকে থাকার রাজনীতিটাও শিখতে হবে...
সৌরভ: রাজনীতি করে বেশি দিন টেকা যায় না। আপনার কাজ আপনার যোগ্যতার মাপকাঠি। যাঁরা ভাবেন, কাজ না করে কেবল ‘পলিটিক্স’ করে পেশা দুনিয়ায় টিকে যাবেন— খুব ভুল ভাবেন। কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। আপনাকে কেউ আটকাতে পারবে না।
প্রশ্ন: মেয়ে যখন নিজের উপার্জন থেকে কিছু কিনে দেয়?
সৌরভ: (এত ক্ষণে মন খুলে হাসলেন) দেয় তো! খুব ভাল লাগে।
প্রশ্ন: সানার বিয়ে নিয়ে ভাবছেন? মেয়ে প্রেম করছে নাকি?
সৌরভ: এখনই বিয়ে নিয়ে কী ভাবব! প্রেম করছে কি না জানি না। করলেও আমায় অন্তত এখনও কিছু জানায়নি। সে রকম যদি কিছু হয় তখন ভেবে দেখব।
প্রশ্ন: কী কী গুণ থাকলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জামাই হওয়া যাবে?
সৌরভ: (হাসতে হাসতে জবাব) ও বাবা! এত কিছু তো ভাবিইনি! সত্যিই এ সব কিছুই ভাবিনি।
প্রশ্ন: আপনাদের দাম্পত্যে আসি? বিয়ের ২৮ বছর পরেও সৌরভ-ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের দাম্পত্য অটুট। কী ভাবে?
সৌরভ: আমরা খুব সহজ জীবনযাপন করি। আর পাঁচ জন বাঙালি যে ভাবে ঘর-সংসার করেন। মাথা ঠান্ডা রাখি। ব্যস্ততার চোটে রাগ করার ফুরসতও পাই না। অন্য দিকে, ডোনাও খুবই শান্ত। খুব ধৈর্য ওর। ঠান্ডা মাথার মেয়ে। ভীষণ ভাল। ফলে, আমাদের সে রকম কোনও সমস্যা হয় না।
প্রশ্ন: ধরুন, বিরাট কোহলির মতো আপনার স্ত্রী নায়িকা। তিনি যদি অনুষ্কা শর্মার মতো অভিনয় না ছাড়তেন, তা হলে কি বেশি চ্যালেঞ্জিং হত?
সৌরভ: নায়িকা বৌ মানেই বিচ্ছেদ, আর সাধারণ ঘরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে বিচ্ছেদ হবে না— এ কথা কে বলেছে? তা হলে তো ঘরে ঘরে এত বিচ্ছেদ হত না! রোজ কত বিয়ে ভাঙে। প্রত্যেকের স্ত্রী-ই কি নায়িকা? এটা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া। সেটা সঠিক থাকলেই সব ঠিক। তা ছাড়া, তারকাদের বিচ্ছেদ নিয়ে কত ভুয়ো খবর রটে জানেন?
প্রশ্ন: যেমন?
সৌরভ: যেমন, বীরেন্দ্র সহবাগ। স্বামী-স্ত্রীতে দিব্যি আছেন। কোনও বিচ্ছেদ হয়নি। অকারণ ওঁদের বিচ্ছেদের খবর লিখে সংবাদমাধ্যম সাড়া ফেলে দিল।
প্রশ্ন: রাজ্যের শাসক এবং বিরোধী দল— উভয়ের সঙ্গে আপনার সুসম্পর্ক। পারস্পরিক বোঝাপড়া? না কি সৌরভ রাজনীতিতে আসবেন?
সৌরভ: আমি পাবলিক ফিগার। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নই। তাই আমার সমস্ত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক। কোনও দিন রাজনীতি করিনি, কোনও দিন রাজনীতিতে আসবও না। বিশ্বাস করুন, রাজনীতি নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অন্যদের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও আসেন। কিছু বিষয় নিয়ে হয়তো আলোচনা করেন। একসঙ্গে বসে কথা বলতে বলতে বা কোনও অনুষ্ঠানে গেলে ছবি ওঠে। সেই ছবি ছাপা হলেই আমার রাজনীতিতে যোগদান নিয়ে কাগজে কাগজে ছাপা হয়। চর্চা বাড়ে।
প্রশ্ন: সারা ক্ষণ লোকজনের এই যে ভিড়, ছবি তুলতে চাওয়া— এই হইহই ব্যাপারটা যদি না থাকে! ভয় হয়?
সৌরভ: ভয় আমি কাউকে পাই না, কিছুতেই পাই না। ভয় পাওয়ার মতো কোনও কাজ করিনি তো! কেন ভয় পেতে যাব? জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার ভয় বলছেন? গেলে যাবে। সে কি আমি আটকাতে পারব? কখনও জোর করে কিছু আটকানো যায়? এ সব নিয়ে, এত কিছু নিয়ে ভাবিই না। কী কী কাজ করতে পারলাম, কতটা দিয়ে যেতে পারলাম— সে সব নিয়ে ভাবি। যতই সারা বিশ্ব ঘুরি, দিনের শেষে আমি আদ্যোপান্ত বাঙালি। এটুকু কথা দিতে পারি, যত দিন বাঁচব বাঙালিদের জন্য কিছু না কিছু করেই যাব।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আবার সিএবি সভাপতি? ছবি: আনন্দবাজার ডট কম।
প্রশ্ন: স্কুল, স্টেডিয়াম তৈরির কাজ এগোল?
সৌরভ: কই আর এগোল! সময় কই? ৪৮টি বিজ্ঞাপনী সংস্থার মুখ। আইপিএল রয়েছে। দুটো রিয়্যালিটি শো-এর সঞ্চালনা। সেপ্টেম্বরে সিএবি-র প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচন। এ বছর সভাপতি পদে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছি। এর পর হাতে আর সময় থাকে? প্রচুর পরিশ্রম করি। এই সব কাজ সানা করবে। ওকে সে ভাবেই তৈরি করে দেব। সানাকেও তো কিছু করতে হবে।
প্রশ্ন: সৌরভ এখনও যে দিন বিরিয়ানি খান পরের দিন বেশি করে শরীরচর্চা করেন?
সৌরভ: (মাথা দুলিয়ে) না না, এখন আর বিরিয়ানি খাই না। বয়স বেড়ে গিয়েছে। সানার জন্মদিনে শুধু বিরিয়ানি খাই। আর ওয়র্ক আউট তো রোজই করি।
প্রশ্ন: পরজন্মে বিশ্বাসী?
সৌরভ: একটুও না। একটাই জন্ম, এক জন্মেই সব সেরে যেতে হবে (হাসি)। তবু যদি আবার জন্মাই তবে...
প্রশ্ন: তবে?
সৌরভ: আবার ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে জন্মাব। আবার দেশ-বিদেশে খেলতে যাব। সারা ক্ষণ খেলা নিয়ে ডুবে থাকব। এখন যেমন থাকি।
প্রশ্ন: পরের জন্মে কাকে বিয়ে করবেন?
সৌরভ: (চেয়ারের গায়ে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে) ভাবিনি, উত্তর জানা নেই। ভেবে দেখি।
বলেই হাসিমুখে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক। অফিস ছেড়ে পা বাড়ালেন বাড়ির পথে...