সাধারণ রঙ্গালয়ের নাটকের গুণগুলোকে অক্ষুণ্ণ রেখে তার সঙ্গে থিয়েটারের আধুনিকতাকেও একত্র করতে সমর্থ হয়েছিলেন সৌমিত্রদা। ‘রাজা লিয়ার’ নাটকের ফাইল চিত্র।
সৌমিত্রদাকে যখন প্রথম দেখি, তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। সেই সময় তিনি সত্যজিৎ রায়ের নায়ক। ফলে একটা সম্ভ্রম তাঁর প্রতি ছিলই। পরে যখন তাঁকে থিয়েটারের মানুষ হিসেবে, অভিনেতা হিসেবে, পরিচালক হিসেবে দেখি, সেটা অন্য রকম ভাললাগায় পরিণতি পায়। আমরা যখন থিয়েটার করছি, তিনি তখন ফিল্ম করছেন। সেই সময়ে ফিল্মের মানুষরাও থিয়েটার দেখতে আসতেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, এমনকি উত্তমকুমারও নাটক দেখতেন। সৌমিত্রদাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। সেই সময়ে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি ঘিরে একটা বড় আড্ডা ছিল। অনেকেই সেখানে আসতেন। মৃণাল সেন, সৌমিত্রদাও যেতেন। আমার তখন বছর ২০ বয়স। আমিও যেতাম সেই আড্ডায়। সেখানেই তাঁর কাছাকাছি আসা।
মঞ্চের সৌমিত্র আমাকে বরাবরই বিস্মিত করেছেন। যে সময় আমরা থিয়েটার করতে আসি, তখন সাধারণ রঙ্গালয় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে বর্তমান। সেই সময়ে একটা ধারণা চালু ছিল। সেটা এই যে, সাধারণ রঙ্গালয়ের নাটক যেহেতু আম-দর্শকের জন্য, সেহেতু তার অভিনয় থেকে মঞ্চসজ্জা— সব কিছুতেই একটা চড়া ব্যাপার থাকবে। সৌমিত্রদা সেই ব্যাপারটা জানতেন। সেই সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার কারণে স্বাভাবিক অভিনয়ের ব্যাপারটার উপরেও গুরুত্ব দিতেন। সাধারণ রঙ্গালয়ের উচ্চকিত অভিনয় আর চলচ্চিত্রের অনুচ্চারিত অভিনয়— এই দুটো ব্যাপারকেই তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দুটোতেই তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘নামজীবন’-এ এই দুই ধারার আশ্চর্য সম্মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন সৌমিত্রদা। এখন যখন মরাঠি থিয়েটারের অভিনয় দেখি, তাঁদের অভিনয়ের অনুচ্চারণ আমাকে টানে। সৌমিত্রদার মধ্যে প্রথম থেকেই এই ব্যাপারটা ছিল। ‘নামজীবন’-এ এমন কিছু এলিমেন্ট রয়েছে, যা সাধারণ দর্শককে আকৃষ্ট করবে। সাধারণ মানুষ তা উপভোগ করবেন। আবার যাঁরা থিয়েটারের মধ্যে শিল্পসম্মত সূক্ষ্মতাকে খোঁজেন, তাঁরাও তৃপ্ত হবেন। তাঁর নাটকে একই সঙ্গে অভিনয়ের স্বাভাবিকত্ব আর মঞ্চ কম্পোজিশনের আধুনিকতা— এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটেছিল।
সমসাময়িক সাধারণ রঙ্গালয়ের উচ্চকিত অভিনয় থেকে সৌমিত্রদা নিজেকে আলাদা করতে পেরেছিলেন।
একটা ব্যাপার এই সঙ্গেই মনে রাখতে হবে যে, সমসাময়িক সাধারণ রঙ্গালয়ের উচ্চকিত অভিনয় থেকে সৌমিত্রদা নিজেকে আলাদা করতে পেরেছিলেন। হয়তো সচেতন ভাবেই তিনি এই পথটা বেছে নিয়েছিলেন। এটাই যে থিয়েটারের একমাত্র মার্গ, তা বলতে চাইছি না। কিন্তু এটা একটা সঠিক পথ, একটা বিশিষ্ট ধারা। তিনি এটাকে রপ্ত করতে পেরেছিলেন। এখানেই মঞ্চাভিনেতা-পরিচালক সৌমিত্রদার সার্থকতা, সাফল্য। এই ‘স্বাভাবিক’-এর মধ্যে থেকে শিল্প সৃজন খুব সহজ নয়। সিনেমায় তিনি পেশাদার হিসেবে কাজ করেছেন বেশি। অনেক ছবিতে কাহিনি-চিত্রনাট্য-চরিত্র স্বাভাবিকতার ধার ধারে না। মুম্বই ঘরানার মূলধারার অনেক অভিনেতা সেই ব্যাপারটাকে বিশ্বস্ত করে তুলতে পারেন। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে মনে হয় সৌমিত্রদার অসুবিধে হত।
আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চল্লিশ দিনের লড়াই শেষ একটু আগে
আরও পড়ুন: ‘অপু’ হতে অপেক্ষা করেছিলেন ৩ বছর, রেডিয়োর ঘোষক সৌমিত্রকে পছন্দই হয়নি পরিচালকের
এমন অনেক চরিত্রে সৌমিত্রদাকে অভিনয় করতে হয়েছে, যেখানে অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাস্য করে তুলতে হবে। সেই সব ক্ষেত্রে তাঁকে অনেক সময়েই অসহায় বলে মনে হয়েছে। কিন্তু ‘বিশ্বাস্য’ চরিত্রে সৌমিত্রদা আশ্চর্য রকমের সাবলীল। এখানেই মনে হয়, সত্যজিতের ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর কাজে এসেছিল। এই বিন্দু থেকে তাঁকে বিশ্লেষণ করা তেমন ভাবে হয়ে ওঠেনি। সেই বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।
সৌমিত্রদা মেকআপ তুলছেন। এমন সময়ে একজন দর্শক সেখানে এলেন। হাউ হাউ করে কাঁদছেন আর বলে যাচ্ছেন— “আপনার মতো মানুষের সঙ্গে কী ভাবে ওরা এমনটা করল!” এতটাই বিশ্বস্ত সেই চরিত্রায়ন। নীলকণ্ঠ নাটকের দৃশ্য। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সৌমিত্রদার ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকটির কথা। সেখানে সৌমিত্রদা এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করতেন, যে এক জমিদার বাড়িতে আশ্রিত। নিতান্ত ভালমানুষ। মিতবাক। একদিন এক আসরে জমিদারের মোসাহেবরা তাঁকে জোর করে মদ্যপান করিয়ে খোরাক করতে চায়। সে ফাঁদে পা দেয়। অনর্গল কথা বলে যেতে থাকে। নেশার ঝোঁকে সে এমন কিছু বলে ফেলে, যা বলা উচিত নয়। যা কেউ কোনও দিন বলেনি। একটা চরিত্রকে কীভাবে ডেভেলপ করতে হয়, ওই নাটকে সৌমিত্রদা দেখিয়েছিলেন। আমি বেশ কয়েক বার নাটকটা দেখেছি। মনে আছে একবার কোনও এক অফিসের কল শো-তে ‘নীলকণ্ঠ’ হয়েছিল। আমি যথারীতি নাটক দেখে গ্রিনরুমে গিয়েছি সৌমিত্রদার সঙ্গে দেখা করতে। সৌমিত্রদা তখন মেকআপ তুলছেন। এমন সময়ে একজন দর্শক সেখানে এলেন। তিনি হাউ হাউ করে কাঁদছেন আর সৌমিত্রদাকে একটা কথাই বার বার বলে যাচ্ছেন— “আপনার মতো মানুষের সঙ্গে কী ভাবে ওরা এমনটা করল!” এতটাই বিশ্বস্ত সেই চরিত্রায়ন। এই গুণ সকলের মধ্যে থাকে না। অভিনয়ে স্টাইলাইজেশন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু সেটা অনেক সময়েই অভিনেতার ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনে। সৌমিত্রদার ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি চরিত্রটাকে সঠিক ভাবে বার করে আনতে পারতেন।
আরও পড়ুন: আমার প্রথম নায়ক
আরও পড়ুন: উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি, কিন্তু বেলাশেষে তিনি সৌমিত্র
নাট্য পরিচালক হিসেবেও তিনি একেবারেই অন্যরকম। বিদেশে উঁচুমানের নাটক সাধারণ রঙ্গালয়েই অভিনীত হয়। ব্রেখট থেকে হ্যারল্ড পিন্টার বা সার্ত্রের নাটক সাধারণ মানুষ উপভোগ করেন। সৌমিত্রদা সেই ব্যাপারটাকে আমাদের এখানেও করতে পেরেছিলেন। এখানে যখন সাধারণ রঙ্গালয় পড়তির দিকে, অতি সস্তা চটকদারি দিয়ে নাটক হচ্ছে আর গ্রুপ থিয়েটারে আমরা অন্য কিছু করার চেষ্টা করছি, সেই সময়ে সৌমিত্রদা এই দুইয়ের এক সম্মিলন ঘটালেন। তিনি সাধারণ রঙ্গালয়ে বিশ্ব-নাটককে তুলে আনলেন। কারণ, তিনি দুটো ধারার সঙ্গেই পরিচিত। একদিকে তিনি শিশির ভাদুড়ির মতো মানুষের সঙ্গ করেছেন। অন্যদিকে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের একের পর এক ছবিতে কাজ করেছেন। এমন একটা সম্মিলন তিনি ঘটাতে পেরেছিলেন, যা সাধারণ দর্শক উপভোগ করবেন আবার প্রকৃত শিল্পভোক্তাও সেখানে বঞ্চিত হবেন না। ‘নামজীবন’ এর একটা আদর্শ উদাহরণ। সাধারণ রঙ্গালয়ের নাটকের গুণগুলোকে অক্ষুণ্ণ রেখে তার সঙ্গে থিয়েটারের আধুনিকতাকেও একত্র করতে সমর্থ হয়েছিলেন সৌমিত্রদা।
ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে দেখেছি, সারা জীবনে কখনও তিনি অস্বাভাবিকতার চর্চা করেননি। লেখক এবং রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
ব্যক্তিগত জীবনেও সৌমিত্রদা একই রকমের ‘স্বাভাবিক’ একজন মানুষ। তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে দেখেছি, সারা জীবনে কখনও তিনি অস্বাভাবিকতার চর্চা করেননি। তাঁর তো আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল। কিন্তু পাড়ায় আর পাঁচজনের মতোই ঘোরাফেরা করেছেন, দোকান-বাজার করেছেন। আমি ‘স্টার’— এই ভাবটা তাঁর মধ্যে কোনও দিনই দেখিনি। রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও এই স্বাভাবিকত্ব বরাবর বজায় থেকেছে। হয়তো চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তা সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ-অর্থনীতিকে অতিক্রম করে যায়নি। মঞ্চেও সহ-অভিনেতা যত নবীনই হোন, তিনি তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণই করেছেন। ওপর থেকে কথা বলার কোনও ব্যাপার তাঁর মধ্যে কখনও দেখিনি। পাশের বাড়ির বাসিন্দা হিসেবে একেবারেই সাবলীল তাঁর আচরণ। বারান্দা থেকে হাঁক দিয়ে ডাকলেন, “বিভাস, আজ সন্ধেবেলা বাড়ি আছ?” বাড়িতে প্রায়ই আড্ডা। আমি, অরুণ মুখোপাধ্যায় সেই সঙ্গে দেবশঙ্করের মতো অনেক পরের প্রজন্মের অভিনেতাও একই সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা...। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে সৌমিত্রদা কখনও নতুন কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন। তো কখনও ব্রেখট বা অন্য কারও নাটকের নতুন অনুবাদ পড়ে শোনাচ্ছেন। সৌমিত্রদার সঙ্গে বিদেশেও গিয়েছি। প্লেনের মধ্যেই কবিতা পড়ে শুনিয়েছেন। দাদা যদি বন্ধু হয়, ঠিক তেমনটাই ছিল আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক। আসলে সত্যিই তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের থিয়েটার জগতের বড়দা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy