শ্যুটিং করতে গিয়ে দেখলাম সে রকম স্টার কিছু তো নয়! আমি বাচ্চা ছেলে আর উনি আমার ফেলুদা।
আমি তখন ১৪ আর আমার ফেলুদা আমার চেয়ে ২৫ বছরের বড়। অথচ ‘সোনার কেল্লা’য় তিনি আমার ‘দাদা’। তবে সৌমিত্রকাকুর চেহারাটাই এমন ছিল, যে মানসিক ভাবে ‘দাদা’ মানতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি তখন। আমি তোপসে করব শুনলাম। আর বুঝলাম সৌমিত্রকাকুর মতো ‘স্টার’-এর সঙ্গে আমায় অভিনয় করতে হবে। স্টার মানে কিন্তু আমার কাছে তখন উত্তমকুমার। ধরা যায় না তাঁকে।
শ্যুটিং করতে গিয়ে দেখলাম সে রকম স্টার কিছু তো নয়! আমি বাচ্চা ছেলে আর উনি আমার ফেলুদা। এক কথায় ডেকে নিলাম ‘সৌমিত্রকাকু’। পাশে তখন আবার সত্যজিৎজেঠু। তখন অবশ্য এ সব কিছুই বুঝিনি। এখন বুঝতে পারি, কারা সব ছিলেন তখন আমার সঙ্গে! জানতে পারলাম সৌমিত্রকাকুর ছেলে আর আমি একই বয়সী। সম্ভবত তাই উনি ছেলের মতোই স্নেহ করতেন আমায়। সেই কাকা-ভাইপো সম্পর্ক শেষদিন পর্যন্ত ছিল।
‘সোনার কেল্লা’-র ফ্লোরে দেখেছিলাম, ক্যামেরার বাইরে আমার সঙ্গে যেমন কথা বলছেন, ঠিক তেমনই ক্যামেরা অন হলেও এক ভাবেই কথা বলছেন! অবাক হলাম! এটাই অভিনয়? আমিও স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম। মনে আছে, মেক আপ করার সময় কিছু কথা হয়েছিল আমাদের মধ্যে—
আমি: (সৌমিত্রকাকুকে উইগ পরাতে দেখে) তোমার তো দারুণ চুল। উইগ কেন পরাচ্ছে?
সৌমিত্রকাকু: (হেসে) আরে এই উইগ পরলে বেশি ফেলুদা-ফেলুদা দেখতে লাগবে!
আমি (আমায় পাউডারও লাগাচ্ছে না দেখে): কই আমায় তো দিল না?
সৌমিত্রকাকু: তোপসের আবার উইগ লাগে নাকি? স্মার্ট অ্যাসিস্ট্যান্টরা মেক আপ করে না। মেকআপ করলে তুই আয়নায় তাকিয়ে থাকবি সারাক্ষণ। তোপসের চুল ঠিক আছে কি না দেখার দরকার নেই।
সোনার কেল্লার শ্যুটিংয়ের ফাঁকে। ফেলুদার সঙ্গে তোপসে
বুঝলাম, যে ভাবে কথা বলি, সে ভাবেই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে হবে। যে ভাবে থাকি, সে ভাবেই ক্যামেরার সামনে থাকতে হবে। ফেলুদার গাইডেন্সের শুরু সেখান থেকেই। যেমন, ‘‘এ দিকে ঘুরে দাঁড়া। আমারও সুবিধে হবে।’’
আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র, সংসার সীমান্ত ছেড়ে তিন ভুবনের পারে পাড়ি অপুর
আরও পড়ুন: সৌমিত্রকাকুকে মডেলের মতো বসিয়ে ছবি এঁকেছিলেন বাবা
নাহারগড় কেল্লায় শ্যুট হচ্ছে। ভিড়ে ভিড়াক্কার। জয়পুরে ওখানেই কেল্লার উপর থেকে ডক্টর হাজরাকে নীচে ফেলে দেওয়া হবে। আমরা দড়ি দিয়ে লোক আটকাচ্ছিলাম। আমার আর ফেলুদার শ্যুটিং ছিল না সে দিন। ও মা! দেখি সৌমিত্রকাকুও দড়ি ধরে লোক সামলাচ্ছেন! ভাবা যায়? তখন কিন্তু উনি খ্যাতির শীর্ষে। শ্যুটিং নেই। কিন্তু সৌমিত্রকাকু লোকেশনে। মেক আপ ভ্যানে এখনকার অভিনেতাদের মতো বসে আছেন, এমন নয়! উত্তমকুমার সম্পর্কে জানতে চাইলেই বলতেন, “এই তোদের এক কথা! ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো যেন আমাদের লড়াই! জানিস, উত্তমবাবু অসম্ভব স্নেহ করতেন আমায়। আমি যে কত কী পেয়েছি ওঁর থেকে। তুই যেমন ফ্যান, আমিও তেমনই উত্তমকুমারের ফ্যান!” খুব সহজ করে কথা বলতেন। শ্যুটিং ফ্লোরে যেমন আগে থেকে বলে নিতেন কী ভাবে সংলাপ বলব। ফ্লোরে যাওয়ার আগে জেঠু (সত্যজিৎ রায়) বলতেন, “ সব ঠিক আছে তো?” আমরা দু’জনেই মাথা নাড়তাম। ফেলুদা আর তোপসে তখন রেডি শট দেওয়ার জন্য। তোপসে জানে ফেলুদা কখন কী ভাবে তাকাবে। আর তোপসে তখন ঠিক কী সংলাপ বলবে। সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে আদানপ্রদানটাই সেরকম হয়ে গিয়েছিল। একদিন ফ্লোরে যেমন আমায় বলেছিলেন, “ফেলুদার আসল শক্তি তার মগজাস্ত্র । তাই অভিনয়ের যা কিছু, চোখ দিয়ে বোঝাতে হবে।” খুব রেগে যেতেন ‘কলটাইম’-এর চেয়ে কেউ দেরি করলে। এখন যদিও এই সময়ে না আসার বিষয়টা বদলেছে। ‘পোস্ত’ ছবিতে অভিনয় করেছিলাম ওঁর সঙ্গে। ৯টায় কলটাইম। আমি ৯টা ১৫ মিনিটে ঢুকলাম। সৌমিত্রকাকু বেশ কড়া গলাতেই বললেন, “আমাদের তো ৯টায় কলটাইম। দেরি করা একদম ঠিক নয়।” আমার বয়স তখন কিন্তু ৫৮। আর উনি হয়ত ৮২। কিন্তু উনি তো ফেলুদা। সে হিসেবে উনি ওটা বলতেই পারেন। আমি কিছু মনে করিনি। ওঁর কাছ থেকেই বুঝেছি নিয়মানুবর্তিতা কতটা জরুরি।
একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল ‘সোনার কেল্লা’ ছবির শ্যুটে। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কেল্লার ভিতরে ৭৫টা শট নেওয়া হয়। এটা সত্যজিৎ রায় বলেই সম্ভব হয়েছিল। অত তাড়াহুড়োর কারণ, সৌমিত্রকাকুকে কলকাতা ফিরে নাটকের শো করতে হবে। উনি দুপুর ২টোয় গাড়ি নিয়ে জয়সলমির থেকে জোধপুর গেলেন। সেখান থেকে রাতে ট্রেনে দিল্লি। আবার দিল্লি থেকে সকালের ফ্লাইট ধরে কলকাতা। নাটককে কতটা ভালবাসলে একজন মানুষ সারাদিন শ্যুট করে তার পর একেবারে অন্য একটা শহরে নাটকের শো করতে দৌড়োয়। কোনও দিন রংবাজি দেখাননি। আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আমি এই পারব না, সেই পারব না! এ সব দেখিনি কোনও দিন।
জয়বাবা ফেলুনাথ-এর শ্যুটিং। বারাণসীতে ফেলুদা, লালমোহন, অর্জুন এবং তোপসে। সঙ্গে সত্যজিৎ।
বেশ কিছু দিন আগে ‘দাদাগিরি’-তে গেলাম একসঙ্গে। সেখানেও আমায় বলছিলেন, “কী হবে যদি প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারি?” বললাম, “ফেলুদা প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে সে প্রশ্নই ভুল!” শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। আসলে ফেলুদা বাঙালির এমন একজন আইকন, যিনি কোনও ভুল করতে পারেন না। এই ভাবনা আমার মতে খুব সুখকর এবং নির্মল। আমরা তো জানি, এই সৌমিত্রকাকু ওরফে ফেলুদার ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি বুদ্ধি!’ সত্যিই ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর কোনও দৃশ্যই ভোলার মতো নয়। অথচ ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ বই পড়লে ছবির ওই মেজাজটা কিন্তু পাওয়া যাবে না। বইয়ে মগনলালের ছেলে শয়তান সিং। সে রুকুর বন্ধু। ওখানে ভাবনাটাই আলাদা।
আরও পড়ুন: আমার প্রথম নায়ক, লিখলেন শর্মিলা ঠাকুর
১৯৭৩ সাল। ‘সোনার কেল্লা’ রিলিজ করল। আমি তখন রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে থাকি। বসুশ্রীতে ‘সোনার কেল্লা’ চলছে। আমার বাড়ির কাছেই। প্রায় রোজই দেখতে যেতাম ‘হাউসফুল’ হল কি না। রোজ যেতে যেতে বসুশ্রীর মালিক মন্টু বসুর সঙ্গে আলাপ হল। ওঁকে বলে হল-এ ঢুকে রোজই ‘সোনার কেল্লা’ দেখে আসতাম। এ ভাবে মাসের পর মাস ‘সোনার কেল্লা’ দেখেছি। এখন টেলিভিশনে হলেই কেউ না কেউ টেক্সট করে। তৎক্ষণাৎ টিভি খুলে দেখতে শুরু করি।
সোনার কেল্লার শুটিং চলছে। ফেলুদা, জটায়ু ও তোপসে।
জুলাই মাসের ৪ তারিখে একটা ওয়েবিনারে দেখা হল সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে । দিব্য তরতাজা! বললেন, “কী রে, খাওয়াদাওয়া আর কিছু পাঠাচ্ছিস না!” বললাম, “তোমার শরীর খারাপ।’’ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “আমি একদম ঠিক আছি। মাংস ছাড়া যা ইচ্ছে পাঠাস।” কথামতো যে দিন আমার খাবার পাঠানোর কথা, সে দিন ফোন করে বললাম, “কাকু, আজ সূর্যগ্রহণ। তুমি কি খাবে? খাবার পাঠাবো?” পরিচিত গলায় ফেলুদা-ধমক এল, “খাদ্যগ্রহণের আবার সূর্যগ্রহণ কী!” কয়েক বছর আগে বেনারসে ‘আরোহণ’ ছবির জন্য শ্যুট করতে গিয়েছি। উনি হোটেলের ঘরে রাতে একা থাকতে চাইছিলেন না। আমি সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে ছিলাম সেই রাতে।
হাসপাতালের ঘরে কত রাত একা একা কাটিয়ে চলে গেল ফেলুদা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy