Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Soumitra Chatterjee

কেমন ছিলেন ফেলুদা সৌমিত্র, লিখলেন ‘ফেলুদা আবির’

ফেলুদা সৌমিত্রকে দেখে যাঁর বড় হয়ে ওঠা, সেই তিনি ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে কী করলেন? সন্দীপ রায়ের ‘বাদশাহী আংটি’র ফেলুদা লিখলেন সত্যজিতের ফেলুদাকে নিয়ে।ফেলুদা বলতেই সৌমিত্রজেঠু। বেণুদাও বার বার বলেছে, ‘‘আমি ফেলুদা হিসেবে অনেক বেশি ছবি করেছি। কিন্তু আমার ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।’’

ফেলুদা মানেই আমার কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

ফেলুদা মানেই আমার কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

আবির চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ১৪:১৫
Share: Save:

যখন নিজেও ভাবিনি হিরো হব, সেই বয়স থেকে ‘ফেলুদা’ আমার হিরো। আর ফেলুদা মানেই আমার কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অনেকেই আমার ফেলুদা চরিত্র করা নিয়ে নানা কথা বলেন। তবে আমি ফেলুদা করেছি সেটা আর মনে রাখতে চাই না। আমার কাছে এক এবং একমাত্র ফেলুদা সৌমিত্রজেঠুই।

এই তো এই লকডাউনেও ‘সোনার কেল্লা’ দেখলাম। কতবার দেখেছি? জানি না। মনেও করতে পারি না। একবার কোনও এক সংস্থার উদ্যোগে বড় পর্দায় ‘সোনার কেল্লা’ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। উফ! সে যা অভিজ্ঞতা। এখনও ভাবলে শিউরে উঠি। চারিদিকের অশান্ত পরিবেশ, ঝড়ঝাপ্টার মাঝে ‘সোনার কেল্লা’ যেন শরৎকালের হাসি। এই ছবি এমনই।

সেই ফেলুদা সিরিজে একদিন আমার ডাক পড়ল! আমি ফেলুদা! তখন বাবুদা ( সন্দীপ রায়) আমার সহায়। বাবুদা স্রষ্টার ফেলুদাও হতে দেখেছেন। সেই ভরসায় চাপা টেনশন নিয়ে পাড়ি দিলাম লখনউ নগরী। ওখানে পা দিয়েই বেশ একটা ফেলুদা-ফেলুদা মেজাজ চলে এল। আমার মতো করে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সৌমিত্রজেঠু বা বেণুদার (সব্যসাচী চক্রবর্তী) কথা মনে আনিনি অভিনয়ের সময়। মনে হয়নি যে, ফোন করে সৌমিত্রজেঠুকে কিছু জিজ্ঞেস করি। আসলে ওঁর থেকে ফেলুদা করার জন্য টিপস্ নিয়ে ফেলুদা করা যায় না। ফেলুদা হয়ে ওঠা যায় শুধু।

সৌমিত্রজেঠুর কাছ থেকে টিপস্ নিয়ে ফেলুদা করা যায় না। ছবি ‘বাদশাহী আংটি’ থেকে।

খেয়াল করে দেখেছি, সত্যজিৎ রায় যখন প্রথম স্কেচ করছেন ফেলুদার, সেখানে যেন লেখক সত্যজিতের আদলেই ফেলুদা তৈরি হয়েছে। আবার সৌমিত্রজেঠু যখন থেকে ফেলুদা করতে শুরু করলেন, তখন সেই স্কেচে তাঁর চেহারাই বেরিয়ে এল। বাঙালির আজীবনের স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করে দিল সেই ফেলুদা! পাঞ্জাবির সঙ্গে ডেনিম বা প্যান্ট! উফফ! মেয়েদের আর কী করে দোষ দিই! এখনও দেখি আমার চেয়ে কম বয়সের মেয়েরা ওঁর প্রেমে পাগল। আর উনি যখন ঠোঁটের কোণে আলগা একটা হাসি ছড়িয়ে দেন, ওটা পুরো কিলার! আমরা পিছনে বসে হাসতে থাকি। আর বলি, গেল গেল! এ তো পুরো ছুরি চালিয়ে দিল!

আরও পড়ুন: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চল্লিশ দিনের লড়াই শেষ রবিবার দুপুরে

ওঁর মতো হাঁটতে খুব কম লোককে দেখেছি। কাঁধটা অদ্ভুত উচিয়ে হাঁটা। চেষ্টা করেছিলাম ব্যোমকেশে হাল্কা নকল করার। কিছুটা পেরেছি। ফেলুদার (সৌমিত্রজেঠু) রেলা, কাউকে কেয়ার করি না ভাব অথচ নম্র আত্মবিশ্বাস। সব মিলিয়ে আমাদের কাছে ফেলুদা বলতেই সৌমিত্রজেঠু। বেণুদাও বার বার বলেছে, ‘‘আমি ফেলুদা হিসেবে অনেক বেশি ছবি করেছি। কিন্তু আমার ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।’’

তিনি ‘লোকাল’ হয়েও ‘গ্লোবাল’। ‘সোনার কেল্লা’র দৃশ্য।

ফেলুদা পারে না এমন কিছু নেই। অথচ সে প্রচণ্ড বিনয়ী। তুখড় স্মার্ট। কিন্তু অহঙ্কারী নয়। ঠিক যেমন সৌমিত্রজেঠু। যে লোকটা বাংলা ভাষা ছাড়া কোনও দিন সে ভাবে ছবি করেনি, বিশ্বের মানুষের কাছেও তাঁর কী সমাদর! ফেলুদাও যেমন কলকাতার বাইরে যায় না। কিন্তু কলকাতার বাইরে তিনি যখন তদন্ত করতে যান, দেখা যায় সেখানকার পুলিশ অফিসারও ফেলুদার ভক্ত। তিনি ফেলুদার তদন্তের কথা শুনেছেন। পড়েছেন। এই যে বাঙালি রুচি-শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বরাবর এগিয়ে রেখেছে, বাঙালির সেই বুদ্ধিমত্তার আইকন তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যিনি ‘লোকাল’ হয়েও ‘গ্লোবাল’।

ফেলুদা বেশ একটা ‘দাদা স্থানীয়’ ব্যাপার। ছোটবেলায় সবাই মনে মনে তোপসে হয়েছি আমরা। তখন মনে হত, যদি আমারও একটা ফেলুদা থাকতো। শেখার জিনিস ফেলুদা। জানার বিষয় ফেলুদা। সৌমিত্রজেঠুর সঙ্গে কোথাও দেখা হওয়া মানেই ছিল নানা বিষয় সম্পর্কে জানা, গল্প করা। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ফেলুদা মগনলাল মেঘরাজের বাড়িতে জটায়ু লালমোহন গাঙ্গুলির অপমানিত হওয়ার ঘটনার পর দশাশ্বমেধ ঘাটের সিঁড়িতে বসে বলেছিল, ‘‘হয় আমি এর বদলা নেব। নয় গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব!’’ বন্ধুর প্রতি কত ভালবাসা থাকলে এটা প্রকাশ্যে বলা যায়! সৌমিত্রজেঠুও তেমনই। ইন্ডাস্ট্রির যে কোনও সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়েছেন বরাবর। ফেলুদার থেকে ওঁকে তাই কিছুতেই আলাদা করতে পারি না।

এক ফ্লোরে যখন কাজ করেছি, ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কী করছে? কী করছে না? কোথায় থামল?... মুক্তির অপেক্ষায় থাকা স্বল্পদৈর্ঘের ছবি ’৭২ ঘণ্টা’র দৃশ্য।

অতনু ঘোষের একটা ১৭ মিনিটের শর্ট ফিল্মে আমি আর সৌমিত্রজেঠু কাজ করেছি। গল্পের নাম ‘রিয়্যালিটি শো’। অপেক্ষা করে আছি, কবে সকলে ওই ছোট ছবিটা দেখবে! এক ফ্লোরে যখন কাজ করেছি, তখন সত্যি বলতে কি, লোকটার দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কী করছে? কী করছে না? কোথায় থামল? ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল সিগারেট খাওয়ার। সৌমিত্রজেঠু বললেন, “অনেক দিন তো খাই না।’’ কিন্তু সিগারেট নিয়ে যা খেললেন, আমি স্রেফ হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম! এ সব দেখে শেখা যায় না। এগুলো স্রেফ নিজের মধ্যে নিয়ে নিতে হয়। ওঁর উচ্চারণে দেখি একই শব্দ তার অর্থ বদলাতে বদলাতে যায়। আর এত হ্যান্ডসাম একটা লোক! কী বলব! আমি তো তাকিয়েই থাকি।

আরও পড়ুন: আমার প্রথম নায়ক

একটা পার্টির কথা খুব মনে পড়ছে। হোটেলের বাইরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন সৌমিত্রজেঠু। মুহূর্তে অবাঙালি লোকজন ওঁকে ছেঁকে ধরে ছবি তুলতে শুরু করল। দেখে মনে হয়েছিল, অভিনেতা স্টার হয়। সুপারস্টার হয়। কিন্তু লেজেন্ডদের জন্ম হয়। উনি তাই। কিংবদন্তি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy