সঙ্গীত জগতের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন প্রসেন, সিধু, রাঘব চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
শিল্পী চন্দ্রমৌলি বিশ্বাসের মৃত্যুতে স্তব্ধ বাংলার সঙ্গীত মহল। তাঁর খবর ছড়াতেই রবিবার রাতে সঙ্গীতশিল্পীদের সমাজমাধ্যমের পাতায় ভেসে ওঠে তাঁর ছবি। চন্দ্রমৌলি কতটা প্রতিভাবান ছিলেন তার ফিরিস্তি দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন অনেকে। নিমেষেই যেন জাতীয় স্তরে পরিচিতি পেয়ে যান ‘ফসিল্স’ ব্যান্ডের প্রাক্তন বেসিস্ট। অনেক গানেই তাঁর ষন্ত্রানুষঙ্গের পরিচিতি। কিন্তু নেপথ্যের আসলে মানুষটা কে, কেউ জানার চেষ্টা করেননি এত দিন! তাঁদের সমাজমাধ্যমের পাতাতেও আজ চন্দ্রমৌলির স্মৃতি। যেন মরেই প্রমাণ করলেন এত দিন বেঁচেই ছিলেন!
রবিবার বিকেলে মধ্য কলকাতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে চন্দ্রমৌলির ঝুলন্ত দেহ। উঠে আসছে নানা কথা। পাওয়া গিয়েছে সুইসাইড নোটও। প্রাথমিক ভাবে ধারণা অবসাদে ভুগছিলেন শিল্পী। তবে কী কারণে অবসাদ, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট পরিচিতি না-পাওয়া এবং ক্রমশ হারিয়ে যাওয়াই কি আত্মহত্যায় প্ররোচনা জুগিয়েছে? এমন নানা সম্ভাবনার কথা উঠে আসছে মানুষের আলোচনায়। প্রশ্ন উঠছে, বাংলা সঙ্গীত জগতের স্থিতিশীলতা নিয়ে। কোন অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন শিল্পীরা? এক দিকে দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরের শিল্পীরা এসে অনুষ্ঠান করছেন কলকাতার বুকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিকিয়ে যাচ্ছে সেই অনুষ্ঠানের টিকিট। কিন্তু কোথায় বাংলার শিল্পীরা? নির্দিষ্ট কয়েক জন ছাড়া কোথায়ই বা সেই শিল্পীদের মঞ্চের অনুষ্ঠান? পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হয়ে ওঠা মানেই কি বিরাট ঝুঁকি নেওয়া?
বাংলা ব্যান্ড বলতেই উঠে আসে ‘ফসিল্স’, ‘ক্যাকটাস’, ‘চন্দ্রবিন্দু’ ও ‘ভূমি’র নাম। কিন্তু নতুন করে কোনও বাংলা ব্যান্ড কেন পরিচিতি তৈরি করতে পারছে না? চন্দ্রমৌলির মৃত্যুর খবর পেয়েই সমাজমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন বাংলা ব্যান্ড ‘ক্যাকটাস’-এর সিধু। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “নতুন ব্যান্ড উঠে আসছে না। এর পিছনে অসংখ্য কারণ রয়েছে। আসলে সঙ্গীত জগতের কোনও ‘ইন্ডাস্ট্রি’ নেই। চলচ্চিত্র জগতে কিন্তু ‘ইন্ডাস্ট্রি’ রয়েছে। আমাদের জগতে তো কোনও প্রযোজকই নেই। ছবির গানের ক্ষেত্রে প্রযোজক রয়েছেন। কিন্তু ছবির বাইরে অর্থাৎ স্বাধীন গানবাজনার ক্ষেত্রে প্রযোজক কোথায়? আর প্রযোজক না থাকলে সেই গানের প্রচারও নেই। প্রযোজক ও শিল্পীর টাকা উঠিয়ে আনার তো একটা পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু সেই কাঠামোটাই নেই। বেতার মাধ্যমে তো আমাদের গান এখন বাজানোই হয় না। একটা সময়ে বাংলা গান বাজানো হত। সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যেত বহু গান। ‘নীল নির্জনে’, ‘নীল রং ছিল ভীষণ প্রিয়’ অথবা ‘ওর’ম তাকিয়ো না’র মতো গান খুব সহজেই মানুষ শুনতে পেত।” তা হলে এখন বেতার মাধ্যমে ব্রাত্য বাংলা গান? উত্তরে সিধু বলেন, “আমরা এই প্রশ্ন করলে বলা হয়, মুম্বইয়ের অফিস থেকেই স্থির করে দেওয়া হয়, কী কী গান বাজানো হবে। তাই কী ভাবে মানুষ শুনতে পাবে, নতুন কী কী গান তৈরি হচ্ছে। শোনার পরে তো শ্রোতারা বলবেন, নতুন গান ভাল না কি খারাপ লাগছে।”
রাঘব চট্টোপাধ্যায় যদিও মনে করেন, বর্তমানে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে চাহিদার থেকে জোগান বেশি। একটা সময়ে সঙ্গীতশিল্পী থেকে পরিচিতি পেতে অনেকগুলো পথ পেরিয়ে আসতে হত। সেই পদ্ধতিতে বদল হয়েছে। গায়কের কথায়, “আসলে এখন সঙ্গীতের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়ার বিষয়টা লটারি জেতার মতো হয়ে গিয়েছে। কোন গান মানুষ শুনবে, তা আগে থেকে বোঝার কোনও উপায় নেই। হতেই পারে, খুব ভাল করে গান বা কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখেছেন, তাঁর হাতে হয়তো কোনও কাজই নেই। অন্য দিকে কারও প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও একটা গান গেয়েই জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছেন। এর কোনও বাঁধা নিয়ম আর নেই। সমাজমাধ্যমের মতো খোলা জায়গায় মানুষ ইচ্ছে মতো গান বেঁধে পোস্ট করছে। আগে বহু পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হত। আগে বিশ্বভারতীর অন্তর্ভুক্ত না হলে কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারত না। এই নিয়মগুলো আর নেই। গানের কোম্পানির কাছে নিজেকে প্রমাণ করলে তবেই গান রেকর্ড করার সুযোগ পাওয়া যেত। পরিস্থিতি এখন অদ্ভুত। কেউ কাজ পাচ্ছেন। কেউ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কাজ পাচ্ছেন না। সেখান থেকে অবসাদ ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে মানুষের মধ্যে। কেউ ক্ষোভপ্রকাশ করছে। কেউ নিজের মধ্যেই গুমরে থাকছে।”
নিজের অতীত মনে করেই রাঘব বলেন, “একটা সময় কত কিছু পেরোতে হয়েছে। রেকর্ডিং সংস্থার অফিসে গিয়ে একের পর এক গান শুনিয়ে, তবে একটা অ্যালবাম করার সুযোগ পেয়েছি। একটা বড় অনুষ্ঠানে ১০ মিনিটে দু’টি গান গেয়ে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ধাপে ধাপে এগোতে হত তখন। সে সব এখন কোথায়?”
এই প্রজন্মের পরিচিত বাংলা ব্যান্ড ‘তালপাতার সেপাই’-এর মতে ঝুঁকি নিয়েই সঙ্গীত জগতে টিকে থাকতে হয়। তাই হতাশ হওয়ার আশঙ্কা থাকেই। ব্যান্ডের শিল্পী প্রীতম দাস বলেছেন, “গান বা অভিনয়ের জগতে কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই। করোনা অতিমারির সময়ও কিন্তু সবার আগে মঞ্চের শিল্পীদের উপরই প্রভাব পড়েছিল। যে কোনও বিপর্যয় বা পরিস্থিতির পরিবর্তনে এই জগতের উপর ঝড়ঝাপটা সবার আগে আসে। এটা আমাদের মেনে নিয়েই এগোতে হবে।”
ইউটিউব মাধ্যমে নিজেদের গানের জন্য জনপ্রিয় ‘তালপাতার সেপাই’। কিন্তু মঞ্চের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কি সেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেন? না কি শ্রোতাদের থেকে আসে হিন্দি নাচের গান গাওয়ার অনুরোধ? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইভেন্ট ম্যানেজারের কথায়, “যাঁরা আগে থেকে যথেষ্ট খ্যাতনামী, তাঁরা কিছু অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চটুল গান গাওয়ার অনুরোধ আসে তাঁদের কাছে। অনুষ্ঠান পাওয়ার তাগিদে সেই অনুরোধ রাখতেও হয় শিল্পীদের। যার ফলে স্বাধীন শিল্পী বা স্বাধীন বাংলা ব্যান্ডের গান সুযোগ কমছে।” যদিও ‘তালপাতার সেপাই’-এর প্রীতমের উত্তর, “আমরা খুব যে ঘন ঘন মঞ্চে অনুষ্ঠান করি, তা নয়। কিন্তু গত কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমাদের নিজের গান গাওয়ার অনুরোধই এসেছে কেবল। যা খুবই ভাল লেগেছে। কিন্তু নিজেদের গান গেয়ে এটুকু পরিচিতি পেতেই অনেকটা সময় লেগে গিয়েছে। তাই আর্থিক ভাবে নিশ্চয়তার অভাব তো রয়েছেই। সেখান থেকে খারাপ লাগাও তৈরি হচ্ছে।”
আরও একটি খারাপ লাগার বিষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন এই প্রজন্মের আর এক শিল্পী দেবদীপ মুখোপাধ্যায়। যে কোনও ব্যান্ডে অথবা শিল্পীর সঙ্গে থাকা বাদ্যযন্ত্রশিল্পীদের যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হয় না বলে মত তাঁর। দেবদীপ বলেছেন, “একটা বিষয় লক্ষ করছি। লোকে এখনও অনুষ্ঠানে গেলে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার হ্যান্ডস ক’জন?’ গিটারবাদক, ড্রামার, বেসিস্ট— এই নামগুলি ব্যবহার করা হয় না। আসলে অধিকাংশ ব্যান্ডেই একজন মানুষই কথা বলেন। খুব কম ব্যান্ডই রয়েছে ‘চন্দ্রবিন্দু’র মতো। যেখানে প্রত্যেকে নিজের মতো করে সঙ্গীতের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষকেও জানতে হবে, সঙ্গীতশিল্পীদের কী বলে সম্বোধন করতে হয়। শিল্পীরা শুধু খুশি করার জন্য গান বাঁধেন না। মঞ্চে গান গাইতে উঠে অদ্ভুত অনুরোধ আমার কাছেও এসেছে। কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামের রক্তদান শিবিরে গান গাইতে ওঠার পরে হয়তো ‘টুনির মা’-র মতো গান গাওয়ার অনুরোধ এসেছে। সেটা কী ভাবে সামাল দিতে হয় আমরা জানি।”
সঙ্গীতে জগতে যথাযথ কৃতিত্ব না পাওয়া নিয়ে দেবদীপের মত, “বাংলা ইন্ডাস্ট্রি কিছু দিচ্ছে না, এই ক্ষোভ পুষে রাখতে পারি না। অজস্র শিল্পী রয়েছেন। সেখানে আমার একার কিছু কেন হচ্ছে না, তা নিয়ে কত বলব। আমি রাজা হতে চাই না। সহাবস্থান প্রয়োজন।”
একাধিক সফল গান রয়েছে প্রসেনের। তবে মঞ্চের অনু্ষ্ঠানে সেই ভাবে দেখা যায় না শিল্পীকে। যদিও কোনও আক্ষেপ বা হতাশা নেই বলে দাবি তাঁর। তিনি বলেছেন, “আমার কোনও হতাশা নেই। আমার চার পাশে আমি এত গুণী ও প্রতিভাবান মানুষদের দেখি। তাঁদের দেখে মনে হয়, আমি যেটুকু পেয়েছি, সেটাই অনেক। আর আমি নিজের অনুষ্ঠান নিজেই তৈরি করি। জানি সমমনস্ক মানুষ পেয়ে যাব।”
শুধুই কি শ্রোতার কাছে পরিচিতি না পাওয়ার কারণে হতাশা? না কি নিজের চারপাশের সঙ্গীত মহলেই রয়েছে অবসাদ তৈরি হওয়ার বীজ! দীর্ঘ দিন একই ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াও কি অবসাদের কারণ হতে পারে না? এই প্রসঙ্গে সিধুর মত, “ব্যান্ডের জগতে ‘ক্যাকটাস’-এর মধ্যে সবচেয়ে ভাঙাগড়া লেগে থেকেছে। এমন বহু শিল্পী রয়েছেন যাঁরা আমাদের দলে ছিলেন। তাই মনে হয় না ব্যান্ডের ভাঙাগড়া নিয়ে অবসাদগ্রস্ত হতে পারেন কোনও শিল্পী। হয়তো খারাপ লাগা তৈরি হয়েছে, কেউ কেউ সঙ্গীতই ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু অবসাদ জাঁকিয়ে বসেছে, এমন হয়নি।”
‘ফসিল্স’-এর সঙ্গে টানা ১৮ বছর যুক্ত ছিলেন চন্দ্রমৌলি। তবে বর্তমানে তিনি ‘গোলক’ নামে এক ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। সেই ব্যান্ডের গান নাকি সেই ভাবে সাড়া না ফেলতে পারায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন শিল্পী। ব্যান্ডের আর এক সদস্য মহুল চক্রবর্তীই প্রথম স্থানীয় থানায় খবর দিয়েছিলেন রবিবার। তিনিই জানিয়েছেন চন্দ্রমৌলির হতাশার কথা। মহুলের কথায়, “এখন প্রশ্ন উঠছে ওঁর হতাশা নিয়ে। হতাশা তো বটেই। গত এক বছরে নতুন ব্যান্ড ‘গোলক’-এর কাজ শুরু হয়েছিল। চন্দ্রদা চেয়েছিলেন, প্রথমে অ্যালবাম প্রকাশ করতে। তার পর মঞ্চ। আসলে আমরা স্বাধীন ভাবে কাজ করি। আমাদের প্রযোজক নেই যে তেমন প্রচার করতাম। তা ছাড়া, এটা তো সত্যি যে সেই আগের মতো পরিস্থিতিও আর নেই। আগে ব্যান্ডগুলো যে ভাবে দাপিয়ে অনুষ্ঠান করত, এখন বড় ব্যান্ডগুলিও তা পারছে না। আমরা তো সবে শুরু করেছিলাম। সে সব কথা চন্দ্রদাকে বোঝানোর চেষ্টাও করছিলাম। আমরা আলোচনা করে স্থির করেছিলাম, যা-ই হয়ে যাক আমরা কাজ করে যাব। কিন্তু চন্দ্রদার মনে যে কী চলছিল, কে জানে! আর আমাদের দেশে এমনই হয়। শিল্পী বেঁচে থাকতে কদর পান না। যখন আমাদের গানের অ্যালবাম প্রকাশ পেল, তখন কেউ একটি বাক্যেও শুভেচ্ছা জানালেন না। মানুষটার মৃত্যুর পর উঠে এল নানা কথা। এর থেকে বড় হতাশা একজন শিল্পীর কাছে আর কী হতে পারে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy