সলিল চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষের প্রাক্কালে অন্তরা চৌধুরীর স্মৃতিচারণ। ছবি: সংগৃহীত।
বাবা ছিলেন মাটির মানুষ। সকলের সঙ্গে খুব সহজে মিশে যেতে পারতেন। ছোট থেকে বড়, যে কোনও বয়সের মানুষের সঙ্গেই অনায়াসে কথা বলতেন। বাড়িতে তো নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা হত। রাজনীতি বা অন্য কোনও বুদ্ধিদীপ্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময়ে সলিল চৌধুরীর অন্য রূপ। কিন্তু বাড়িতে তিনি শুধু আমাদের বাবা। নিজের হাতে রান্না করে কত খাইয়েছেন। মনে আছে, বাবা প্রায়ই ‘ফ্রুট সালাড’ বানিয়ে খাওয়াতেন আমাদের। রাতে ভূতের গল্প শোনাতেন। আবার স্টুডিয়োয় সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ নিয়ে খুব কড়া ছিলেন। কাজের ক্ষেত্রে বাবা জানতেন, ঠিক কী চান। সেটা যত ক্ষণ না পেতেন, কাজ থামাতেন না। খুব ধৈর্যও ছিল বাবার।
আমাদের গোটা জীবন জুড়ে রয়েছেন বাবা। বাবার স্পর্শটা আমার আজও অনুভবে রয়ে গিয়েছে। জ্বর হলে বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। সেই স্পর্শটা আমি আজও পাই। প্রথম গানের রেকর্ডিং-এর স্মৃতিও পরিষ্কার। বাবার কোলে বসে ছোটবেলায় গানের রেকর্ডিং করতাম। নিয়ম হয়ে গিয়েছিল এটা। প্রত্যেক রেকর্ডিং-এর সময় বাবাকে বলতাম, “কোলে, বাবা।” আর একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর বাবা বলতেন, “এখন তো তুই বড় হয়ে গিয়েছিস। আর কি পারি!” বাবার সঙ্গে কত মিষ্টি স্মৃতি রয়েছে এমন! আমার আর আমার বোন সঞ্চারীর মধ্যে রেষারেষি হত, কে বাবার কোলে বসবে। আমি বড়। সঞ্চারীর জন্মের পরে ওকে বাবা বেশি কোলে নিতেন। সেটা দেখে আবার আমার হিংসেও হত।
ছোটবেলা বেশ আনন্দে ও মজায় কাটলেও গানের বিষয়ে কিন্তু বাবার কিছু কড়া নির্দেশ ছিল। গাইতে হলে গান নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সব ধরনের গান শুনতে বলতেন বাবা। আর বলতেন, ভাল শিল্পী হতে গেলে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সঙ্গীতও শিখতে হবে। শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতাম। পিয়ানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম স্যাম ইঞ্জিনিয়রের কাছে। দুটো দিক শিখেছি বলেই, কোন গানে কোন কর্ডের ব্যবহার হতে পারে, কী ধরনের হারমনি সম্ভব সেটা বুঝতে পারি। আর মায়ের কাছে শিখেছিলাম গানের অভিব্যক্তি। গান গাওয়ার সময়, কোন জায়গায় দম নিতে হবে, কী ভাব থাকবে, সে সব মায়ের থেকে শিখেছিলাম।
বাবা চাইতেন, আমি যেন শুধু গায়িকা না হই। আমি যেন সুরস্রষ্টা হই। আর সেটার জন্য গানের হারমনি, কর্ড এগুলো বোঝা দরকার। তার জন্য পাশ্চাত্যের সঙ্গীত বোঝা দরকার। আমি গিটারও বাজাতাম। বাবার পরামর্শে পিয়ানো বাজানো শুরু করি। বর্তমানে চেষ্টা করছি নিজের গান তৈরি করার।
‘এমন সঘন বরষায়’ আমার গাওয়া প্রথম বড়দের গান। দেশ রাগের উপর ছিল সেই গান। বাবা অসাধারণ সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন গানের। বেহালার এমন ব্যবহার করেছিলেন, মনে হচ্ছিল সত্যিই বর্ষা আসছে। রেকর্ডিং-এর সময় বাবা হঠাৎ ডেকে বলেছিলেন, “মানু তুমি খুব ভাল গাইছ। কিন্তু গানের কোনও কথা আমি বুঝতে পারছি না। তোমার গানের অভিব্যক্তি এত বেশি, কথাগুলো অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে। মুখটা খুলে গাও।” খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন বাবা। বকুনি নয় কিন্তু। বাবা সব সময় বুঝিয়ে বলতেন।
বাবা যে কোনও আড্ডায় আসর জমাতে পারতেন। একটা হুইস্কির বোতলে দেশলাই জ্বালিয়ে ঢুকিয়ে দিতেন বাবা, তার পরেই ছিপি আটকে দিতেন। আর আমাদের বলতেন, “ওই দেখ, কেমন ভূতকে আটকে দিলাম বোতলে। তোরা ভয় পাস না।” খুব রসিকতাও করতেন বাবা। মনে আছে, বাবা একটা একক অনুষ্ঠানে কিবোর্ডে সানাই বাজিয়েছিলেন। বাবা সেটা নিয়ে বলেছিলেন, “কিন্তু আমি বিসমিল্লা হতে পারলাম না। উনিশমিল্লা হলাম।”
নিজের জন্মদিন নিয়ে বাবার তেমন কোনও উত্তেজনা ছিল না। মা জন্মদিন পালন করা শুরু করেছিলেন। পায়েস বানাতেন। বাবা লোকজন ভালবাসতেন। জন্মদিনে শিল্পীরা আসতেন, গানবাজনা করতেন। আমরা তখন রডন স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতাম। হৈমন্তীদি, সুবীর সেন, বনশ্রীপিসি, নির্মলাপিসি, দ্বিজেনকাকা, শিবাজীদা, অরুন্ধতীদি আরও অনেকে আসতেন। অনেক খাওয়াদাওয়া হত। বাবা নিজের হাতে মাংস রান্না করতেন। তবে এই আসরগুলোতে আমাকে গান করতে বা পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতে হত। আমি বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এই বোধহয় বাবা গান গাইতে বলবেন।
বাবা নিজে বাজার করতেও ভালবাসতেন। একসঙ্গে অনেকটা বাজার করে আনতেন। বাবা এক বার দোসা বানানোতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এমন বহু ঘটনা ছিল। আসলে বাবা থাকা মানেই বাড়িটা গমগম করত। খুব প্রাণবন্ত ছিলেন। তাই প্রতি মুহূর্তে আজও বাবাকে অনুভব করি। বাবার গান শুনলে, তাঁকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। বাবা কিন্তু অঙ্ক ও বিজ্ঞানেও খুব ভাল ছিলেন। এই বিষয়গুলি বাবার কাছেই পড়তাম। তবে শেষের দিকে বাবা আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। রোজ বিকেলে কত আড্ডা দিতাম বাবার সঙ্গে।
বাবা একটা কথা আমাদের সব সময় বলতেন, “ভাল শিল্পী হতে গেলে ভাল মানুষ হতে হবে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবে না। এগুলোর ঊর্ধ্বে উঠতে শেখ। কিছু কাজ করার জন্য তুমি এসেছ।”
তাই আজ মনে হয়, আমি জন্মেছি বাবার কাজগুলো সংরক্ষণ করার জন্য। মা চলে গিয়েছেন। আমি চলে গেলে বাবার কাজগুলো হারিয়ে যাবে। আগামী বছর বাবার জন্মশতবর্ষ। তাই উদ্যোগী হয়ে সলিল চৌধুরী বার্থ সেন্টেনারি সোসাইটি গড়ে তুলেছি। আগামী দশ বছরের মধ্যে বাবাকে নিয়ে একটা মিউজ়িয়াম করতে চাই। সেখানে বাবার গান, লেখা, কলম, চশমা সব রাখব । পরের প্রজন্মও যেন বাবাকে পায়। আমি বুঝেছি একটা বিষয়। শুধু ছোটদের গান গাওয়ার জন্য আমি জন্মাইনি। বাবার এই কাজগুলো সংরক্ষণ করার জন্যই আমার জন্ম। আমার জীবনের সাধনাই বাবার গান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy