Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Soumitra Chatterjee

আক্ষেপ থাকল, সৌমিত্রকে কাজে লাগাতে পারিনি

সৌমিত্রকে নিয়ে কোনও আলোচনা আমি সত্যজিৎ রায়কে বাদ রেখে করতে পারি না।

লেন্স: সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সঙ্কেত’ ছবির শুটিংয়ে। ফাইল চিত্র

লেন্স: সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সঙ্কেত’ ছবির শুটিংয়ে। ফাইল চিত্র

শ্যাম বেনেগাল
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২০ ০৪:১৩
Share: Save:

আমার তো প্রবল ইচ্ছা ছিলই, শশীও (কপূর) এক কথায় রাজি। ১৯৮০ সালের কথা। শশীর প্রযোজনায় আমার ‘কলযুগ’ ছবিটির কাস্টিং নিয়ে কথাবার্তা চলছে। রেখাকে বাছা হয়ে গিয়েছে। তাঁর বিপরীতে ধরম রাজ নামের চরিত্রটির জন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের পছন্দ। সৌমিত্রকে যোগাযোগ করা হল। সে সময় ও খুবই ব্যস্ত তারকা। তার মধ্যেই অডিশন দিতে মুম্বই এল। কিন্তু বাদ সাধল উচ্চারণ। চরিত্রটি ঠেট হিন্দিতে কথা বলে। আর সৌমিত্রর উচ্চারণে বাঙালি ছাপ! ডাবিং করিয়ে হয়তো করানো যেত কিন্তু সেটা করতে মন চাইল না। আর একটা উপায় ছিল, কিছু দিন হিন্দি ওয়ার্কশপ করিয়ে ওই উচ্চারণের সঙ্গে ওঁকে সড়গড় করিয়ে নেওয়া। কিন্তু সৌমিত্র তথন এতটাই ব্যস্ত যে সেই সময়টা বের করা ওর পক্ষে কার্যত ছিল অসম্ভব। ফলে রাজ বব্বরকে নিতে হল। আজও আমার আফসোস রয়ে গিয়েছে যে সৌমিত্রর মতো অসামান্য অভিনেতাকে কাজে লাগাতে পারিনি। আমার ধারণা, শশীর মনেও এই আফসোস ছিল।


আরও পড়ুন: নাটক নিয়ে ওঁর সঙ্গে আর কথা হবে না

সৌমিত্রকে নিয়ে কোনও আলোচনা আমি সত্যজিৎ রায়কে বাদ রেখে করতে পারি না। ওঁদের দু’জনের সম্পর্ক আমি নিজে চোখে দেখেছি। কখনও নিশ্চিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারিনি এই সম্পর্কের রসায়ন ঠিক কী। কখনও মনে হয়েছে সৌমিত্র মানিকদার অল্টার ইগো। অথবা ওঁরা দুই ভাই। নাকি পিতা ও পুত্র ? কিন্তু তা যা-ই হয়ে থাক, আমার মতে সত্যজিতের ছবিতে নিজের সেরাটুকু দিয়ে গিয়েছে সৌমিত্র। তা সে নরসিং-ই হোক বা অপু, সন্দীপই হোক বা ফেলুদা। ওর প্রতিভা বহুমুখী। আমার নতুন করে বলার কিছু নেই। অভিনয়ের এমন কোনও দরজা নেই যা খুলে সৌমিত্র ভিতরে প্রবেশ করেনি। আমি শুনেছি, যাত্রাতেও ও সমান স্বচ্ছন্দ ছিল। যাত্রার মাধ্যমে সরাসরি মানুষের সঙ্গে সংযোগ করতে গেলে যে প্রবল প্রাণশক্তি এবং দক্ষতা লাগে, তা ওর ছিল পূর্ণ মাত্রায়। থিয়েটার করে গিয়েছে নিয়মিত। ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়, পঞ্চাশের দশক থেকে এই কাল পর্যন্ত ও একটানা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কাজ করে গিয়েছে, মাঝে কোনও ব্রেক ছাড়াই। আমার চেনাজানা এমন উদাহরণ তো আর একটিও মনে পড়ছে না। অভিনয় জগতের এক জন সার্থক অলরাউন্ডার ছিল সৌমিত্র।

আরও পড়ুন: নাটক নিয়ে ওঁর সঙ্গে আর কথা হবে না

ওর অভিনীত সেরা চরিত্র যদি বাছতে বসি, তবে আমার পক্ষপাত থাকবে অপুর প্রতি। কিশোরী বধূ শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে ওর অনবদ্য কাজ এক জন্মে ভোলার নয়। কলকাতায় এসে নিজের জায়গা খুঁজে নেওয়ার সেই লড়াই, দু’চোখে স্বপ্ন মাখা এক যুবকের। অপুর সংসার আমি দেখেছি বহু দিন আগে। আর দেখার প্রয়োজন হয়নি, কারণ, প্রতিটি শট আমার মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে।

মানিকদাকে নিয়ে তথ্যচিত্র তোলার সময়ে কাছ থেকে দেখেছি সৌমিত্রকে। ওর কাজ, ওর নিষ্ঠা ও শ্রমকে। তখন ঘরে বাইরের শ্যুটিং চলছিল। আমাকে মুগ্ধ করত ওর সাদাসিধে আচরণ। সিনেমার গ্ল্যামারের ধারে কাছে না থাকা চঞ্চল, সৃষ্টিশীল মানুষ হয়েই থেকেছে বরাবর। অথচ এটা তো ঠিকই যে একজন বড় অভিনেতার পাশাপাশি সৌমিত্র ছিল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বৃহৎ তারকাও। কলকাতায় গেলে আমি এক সময়ে গ্র্যান্ড হোটেলে উঠতাম। ওকে ফোন করতাম, কখন দেখা করতে যেতে পারি জানার জন্য। বরাবরই জবাব এসেছে, ‘তোমায় আসতে হবে না আমি পৌঁছে যাচ্ছি।‘ এই আচরণ, উষ্ণতা ভোলার নয়।

আর কখনও ফোন করা হবে না ওকে। আর দেখা হবে না আমাদের।

অনুলিখন: অগ্নি রায়

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy