‘জওয়ান’ ছবিতে শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত।
রাতের অন্ধকার। দেবীর মূর্তির দিকে এগিয়ে আসছে এক ছায়ামূর্তি। আলো-আঁধারিতে ছায়াশরীর স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ জড়ানো। দমকা হাওয়ায় একটু একটু করে তা খুলে যেতেই বোঝা গেল বলিউডের ‘বাদশা’ এখনও ‘জ়িন্দা হ্যায়’।
আট মাস পর আবার বড় পর্দায় শাহরুখ খান। ‘পাঠান’-এর পর আবার একটি অ্যাকশন ঘরানার ছবি নিয়ে। বৃহস্পতিবার প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি ভাষার পাশাপাশি তামিল এবং তেলুগু ভাষায় মুক্তি পেল শাহরুখের ‘প্যান ইন্ডিয়ান’ ছবি ‘জওয়ান’। এই ছবির হাত ধরেই বলিপাড়ায় তামিল পরিচালক অ্যাটলির আত্মপ্রকাশ। সঙ্গে আবার দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির অভিনেত্রী নয়নতারা এবং তামিল অভিনেতা বিজয় সেতুপতি। ক্যামিয়ো চরিত্রে রয়েছেন বলি অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। সব মিলিয়ে কেমন হল বলিউডের সঙ্গে দক্ষিণের মেলবন্ধন? আট মাস আগে শাহরুখ যেমন ‘পাঠান’ ঝড় তুলেছিলেন, সেই ঝড় কি ‘জওয়ান’কে উড়িয়ে নিয়ে গেল, না কি এ বার শাহরুখ রীতিমতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন?
ঘড়িতে তখন ঘণ্টার কাঁটা ৫টার ঘরে পৌঁছেছে। ভোরের আলো তখনও ভাল মতো ফোটেনি। কিন্তু সিনেমা হলের ভিতর যেন অন্য হাওয়া বইছে। শাহরুখ অনুরাগীদের গলা ফাটানো চিৎকারে কান পাতা দায়। সাতসকালেও যখন হাউসফুল, তখন দর্শকের এই ছবি ঘিরে, শাহরুখকে ঘিরে কী পরিমাণ প্রত্যাশা রয়েছে তার আঁচ পাওয়া যায় বইকি! সকলের মনে একই প্রশ্ন, শাহরুখের ‘জওয়ান’ হিট হবে তো?
‘জওয়ান’-এর মূল কাহিনি দু’টি আলাদা সময়ের প্রেক্ষাপটকে ঘিরে। বিক্রম রাঠৌর এবং আজাদের জীবনের কাহিনি। তাদের পাওয়া-না পাওয়ার, হারজিতের গল্পকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলে ‘জওয়ান’। ছবি শুরু হতে না হতেই অ্যাটলি যেন তাঁর নিজস্বতার প্রমাণ দিলেন। প্রতিটি ফ্রেমে তাঁর হাতের ছোঁয়া রয়েছে, ফুটে উঠেছে দক্ষিণী ছাপও। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিরুদ্ধ রবিচন্দ্রের অসাধারণ আবহসঙ্গীত বা বিজিএম। ‘জওয়ান’-এর সূচনাপর্ব থেকেই ক্যামেরার কাজ, ধীর গতির অ্যাকশন দৃশ্য, আলো-আঁধারির খেলা, বিজিএম— সব যেন এক নিমেষে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। উচ্চবিত্তের সঙ্গে নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের পার্থক্য থেকে শুরু করে নানা ধরনের সামাজিক বার্তাও ফুটে উঠেছে ‘জওয়ান’-এ।
সিদ্ধার্থ আনন্দের পরিচালনায় ‘পাঠান’-এর সঙ্গে যদি অ্যাকশন সিকোয়েন্সের তুলনা টানা যায়, তবে ‘জওয়ান’ সে ক্ষেত্রে হাজার ধাপ এগিয়ে। ছবিতে বিক্রম এবং আজাদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরুখ। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে কখনও কেশহীন অবস্থায়, কখনও বয়স্কের সাজে পর্দায় ধরা দিয়েছেন অভিনেতা। প্রতিটি ‘লুক’-এই শাহরুখ অনবদ্য। কখনও শাহরুখের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন নয়নতারা, কখনও বা দীপিকা। কিন্তু অ্যাকশন ঘরানার ছবিতে চরিত্রদের এই প্রেমালাপ ‘জওয়ান’-এর ছন্দে তাল কাটেনি। দক্ষিণী অভিনেত্রী হিসাবে বলিউডে প্রথম কাজ করলেন নয়নতারা। অভিনয়ের ক্ষেত্রে ভাষাগত পার্থক্যের জন্য কোনও রকম জড়তা লক্ষ করা যায়নি তাঁর মধ্যে। বরং তাঁর সাবলীল অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়।
খলনায়কের চরিত্রে যথাযথ বিজয় সেতুপতি। দক্ষিণী অভিনেতা হিসাবে বলিউডে প্রথম কাজ হলেও এর আগে হিন্দি ভাষায় অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে বিজয়কে। চলতি বছরে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় ওয়েব সিরিজ় ‘ফরজ়ি’। এই সিরিজ়ে অভিনয় করেছিলেন বিজয়। অভিনেতা হিসাবে তিনি যে প্রথম সারির, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু হিন্দি ভাষায় তিনি তেমন সড়গড় ছিলেন না বলে তা ধরা পড়েছিল ক্যামেরায়। ‘ফরজ়ি’তে বিজয়ের মধ্যে যে জড়তা দেখা গিয়েছিল, তা ‘জওয়ান’-এ কোথায় যেন উবে গিয়েছে। এই ছবিতে খলনায়কের চরিত্রে বিজয়ের মতো অভিনয় করেছেন বিজয়। তবে ছবির প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে যেন নিজেকে মেলে ধরলেন বিজয়।
ক্যামিয়ো চরিত্রে দীপিকা অভিনয় করেছেন ঠিকই, কিন্তু পর্দায় তিনি সময় মন্দ পাননি। সেই সময়ের মধ্যেই জোরদার অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। বাকি পড়ে রইল মহিলাবাহিনী। যা নিয়ে এত তোড়জোড়, সেই মহিলাবাহিনীতে অভিনয় করেছেন প্রিয়মণি, সানিয়া মলহোত্র, সঞ্জিতা ভট্টাচার্য, লেহর খান-সহ আরও অনেকে। পার্শ্বচরিত্র হলেও তাঁদের সকলের চরিত্র সমান গুরুত্বপূর্ণ।
ভরপুর অ্যাকশন, জোরদার সংলাপ, হাস্যরসের ছিটেফোঁটা, রোম্যান্স— সব মিলিয়ে এই ছবিতে বিরিয়ানির মশলা ভরপুর। পরিচালক অ্যাটলি রেঁধেছেনও পাকা রাঁধুনির মতো। প্রায় তিন ঘণ্টার দীর্ঘ ছবি হলেও এক মুহূর্তের জন্যও লয়চ্যুত হয়নি ‘জওয়ান’। পরতে পরতে টানটান উত্তেজনা তৈরি করতে ওস্তাদ অ্যাটলি। ‘থেড়ি’, ‘মার্শাল’, ‘বিগিল’ ছবিতেও তিনি নিজের এই ছাপ ফেলেছিলেন। অনিরুদ্ধও তাঁর ম্যাজিক দু’হাতে ঢেলেছেন ‘জওয়ান’-এ। ছবি মুক্তির আগে দর্শকের একাংশ দাবি করেছিলেন, প্রথম ঝলকেই ছবির সব চমক প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। তা হলে সিনেমার জন্য আর থাকল কী? কিন্তু যেখানে পরিচালক অ্যাটলি এবং অভিনেতা শাহরুখ, সেখানে চমকের অনুপস্থিতি থাকবে, তা কী করে হয়! ‘জওয়ান’-এ কয়েকটি চরিত্রকে খুব যত্নে লুকিয়ে রেখেছেন অ্যাটলি যা দর্শকের কাছে ‘সারপ্রাইজ়’ই বটে।
রান্না ভাল করতে গিয়ে কি তাহলে কোথাও গড়বড় করেননি অ্যাটলি? নুনটা মনে হল একটু কম হয়ে গিয়েছিল ‘জওয়ান’-এ। কারণ, ছবিতে টুকরো টুকরো গল্পগুলি আমাদের অজানা নয়। এর আগে অন্য কোনও সিনেমায়, অন্য কোনও ওয়েব সিরিজ়ে এই গল্পগুলি একাধিক বার দেখানো হয়েছে। কিন্তু সব শেষে পরিবেশনেই বাজিমাত করেছেন অ্যাটলি। সাজিয়েগুছিয়ে এত যত্ন নিয়ে প্রতিটি গল্প যে ভাবে তিনি জোড়া লাগিয়েছেন, তা প্রশংসাযোগ্য। পুরনো গল্পগুলিকে নতুন মোড়কে দেখতে মন্দ লাগবে না। সে দিক থেকেও ‘পাঠান’কে টপকে গিয়েছে শাহরুখের ‘জওয়ান’। শেষ পাতে অ্যাটলি একটা কথাই বললেন, ‘‘নায়ক নেহি, খলনায়ক হুঁ মে’’। কিন্তু কেন? তার জবাব দর্শককে দেবে ‘জওয়ান’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy