‘রাস’ ছবিতে দেবলীনা কুমার, অনসূয়া মজুমদার ও বিক্রম চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়ি। স্থানীয়রা নাম দিয়েছে ‘খাঁচা বাড়ি’। কেন? কেউ জানে না। তবে স্থান মাহাত্ম্যে বাড়িটি বিখ্যাত। ভবানীপুরের ছোট্ট আঙিনা এক কালে হয়তো গমগম করত যৌথ পরিবারের সদস্যদের জন্য। এখন নিঝুম। আলপনা আঁকা লাল সিঁড়ি ছাড়িয়ে দালানে ওঠা যায়। দালান ঘিরে ঘর। সে সব পেরিয়ে অন্দরমহলে পা রাখার জন্য উঁচু ধাপের সিঁড়ি। তিন তলার উপরে ছাদ। তার উপরে খোলা আকাশ। পৌষের শেষে হিম ঝরে পড়ছে সেখানে।
পায়ে পায়ে সেখানে যেতেই কানে এল অস্ফুট কান্না! কেউ কি ফোঁপাচ্ছে? ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে ও কে?
আবছা অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই বোঝা গেল, বাড়ির পোশাকে এক পুরুষ দাঁড়িয়ে। তিনিই চোখ মুছছেন! হঠাৎ সেই পুরুষ মুখ ফেরাতেই চমক, অভিনেতা বিক্রম চট্টোপাধ্যায়! কান্নায় মুখচোখ লালচে। রুমালে ঘনঘন নাকচোখ মুছছেন। তাঁর গা ঘেঁষে এক বয়স্ক নারী, অনুসূয়া মজুমদার। আলো আরও জোরালো হতেই দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার সব। দূরে চেয়ারে বসে মনিটরে চোখ তথাগত মুখোপাধ্যায়ের। হাতে মাইক। ছাদ জুড়ে সিঁড়ি পাতা। সেখানে ক্যামেরা চলছে। অনসূয়া বিক্রমের গালে হাত ছুঁয়ে আদর করতেই ‘কাট কাট’ চিৎকার।
ঘরোয়া ভঙ্গিতে আগামী ছবি ‘রাস’-এ যৌথ পরিবারের গল্প বলছেন পরিচালক-অভিনেতা তথাগত। তারই শুটিং ‘খাঁচা বাড়ি’তে। বিক্রম-অনসূয়ার সঙ্গী ছবির নায়িকা দেবলীনা কুমার, পর্দায় বিক্রমের দাদা অর্ণ মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস রায়-সহ অনেকেই। সেই সেটে হাজির আনন্দবাজার অনলাইন।
নানা ভঙ্গিতে একাধিক টেক। এক প্রস্থ শটের পর ছোট্ট বিরতি। এত কান্না কেন? বিক্রমের কথায়, “ঠাম্মির সঙ্গে নাতির দৃশ্য। ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ একটি দৃশ্য। নাতি বিশেষ কারণে তার জমানো ব্যথা ঠাম্মিকে উজাড় করে দিচ্ছে। চোখে তো জল আসবেই।” আটপৌরে করে পরা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে একই কথা শোনা গেল অনসূয়ার গলায়। তিনি বললেন, “ঠাম্মি এখানে শুধুই ঠাম্মি নন, নাতিবাবুর বন্ধু। যে নাতি প্রবাসী। যাকে তিনি আটকে রাখতে চান।” নাতি কি ঠাম্মির টানে থেকে যাবে? “বললে সব ফাঁস, আপাতত এটুকুই”, পাশে রাখা চেয়ারে বসতে বসতে হাসিমাখা জবাব এল।
নুড্লসে মজে তিনি...!
নায়ক ছাদে। ভীষণ আবেগতাড়িত। এমন পরিস্থিতিতে তার পাশে নায়িকাকেই মানায়। তিনি কোথায়? খোঁজ পড়তেই জানা গেল, তিনি তৈরি হয়ে দোতলার নির্দিষ্ট ঘরে বসে। দৃশ্য আসেনি বলে তিনি আসেননি। ঘরের অন্দরে পা রাখতেই চোখ টানল আয়না আর আয়নার সামনে বসে থাকা মানুষটি। লাল-কালোয় বোনা খেসের শাড়ি। পাড় ঠিক করতে করতেই খুব চেনা হাসি। চোখে চওড়া কাজল। বিনুনি, ছোট্ট টিপ আর ন্যুড লিপস্টিকে সেজে ওঠা দেবলীনা কুমার। চুলে চিরুনি বোলাতে বোলাতে প্রশ্ন করলেন, “কেমন দেখাচ্ছে?” প্রশংসা শুনে বললেন, “সবাই বলেন, আমায় নাকি অল্প সাজে বেশি ভাল লাগে। আমারও তাই...”। ছবিতে তিনি ‘সোমনাথ’ ওরফে বিক্রমের ‘রাই’। গ্রামের গেছো মেয়ে। স্কুলের দিদিমণি! জলকাদা মাড়িয়ে স্কুল গিয়ে পড়ুয়াদের পড়ান। “জানেন, বাস্তবেও তো আমি শিক্ষিকা। একদিন শুটিংয়ে বাচ্চাদের এত জোরে বকে ফেলেছি, ওরা থতমত! আমারও কী অস্বস্তি। ভুলেই গিয়েছি অভিনয় করছি...”, শুটিং করতে গিয়ে কাদায় আছাড়ও খেয়েছেন। তখন অবশ্য ম্যাগিতেই মজে তিনি।
সোমনাথের প্রেমিকা? আবাল্য বান্ধবী। নিজের গণ্ডির মধ্যে থাকতেই ভালবাসে। নিজের উন্নতির বদলে গ্রামের উন্নতির স্বপ্ন দেখে সে। সেই স্বপ্নই শেষে সোমনাথের পায়ে বেড়ি পরাবে। বিক্রমের বিপরীতে এই প্রথম... কথা থামিয়ে কলকলিয়ে উঠলেন, “তার আগে থেকেই ভাল বন্ধু। আড্ডা দিই, পার্টি করি। অসুবিধে হচ্ছে না।” তা ছাড়াও, পরিচালক টানা মহড়া দিয়ে তার পর শুটিং শুরু করেছেন। যার ফলে, পার্ট মুখস্থ হয়ে গিয়েছে দেবলীনার। আর ‘রাই’ নাকি তাঁরই ছায়া! তাঁরই মতো হাসিখুশি, মিশুকে কিন্তু উচ্চকিত নয়। তাই আলাদা করে অভিনয় করতেই হচ্ছে না। এখানে না হয় কচিকাচা পড়ুয়া। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাজে ডক্টর দেবলীনা পড়াতে গেলে তরুণ ছাত্ররা কী বলবেন? জোরে হাসির সঙ্গে দাবি, “যেতাম তো। নইলে শুরুতে পড়ুয়ারা বুঝতে পারত না, কে দিদিমণি আর কে পড়ুয়া!” তার পরেই ফাঁস করলেন, রাতভর অন্তাক্ষরী হবে ছাদে...
আমি তো বড় দাদা...
অর্ণ মুখোপাধ্যায়। সেটে ডাক পড়েনি তাঁরও। তিনি অন্য একটি ঘরে, ইজিচেয়ারে। পাঞ্জাবি-পাজামা, গায়ে সাদা কাশ্মীরী শাল। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। ঘরে পা রাখতেই টানটান হয়ে বসলেন। ছবিতে আপনি কেমন? “সোমনাথের বড় দাদা। সবেতেই আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। ভাইকে ধরে রাখতে চায়। যৌথ পরিবারের বড় ছেলে যেমন হয়।” চাপদাড়িতে হাত হাত বোলাতে বোলাতে জানালেন, তিনি যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। এখনও সেই পরিবার অটুট। এই ছবি সেই স্মৃতি মনে পড়াবে বলেই অভিনয়ে রাজি হয়েছেন। “বলতে পারেন, অনেকটা পরিচালক তরুণ মজুমদারের ঘরানার ছবি। ওই ধারার ছবি আমার খুব প্রিয়।” তা হলে ‘অথৈ’-এর মতো ছবি পরিচালনা কেন? মৃদু হেসে অর্ণ বললেন, “সবে তো একটা মাত্র পরিচালনা করব। আগামী সব ধারার ছবি বানানোরই ইচ্ছে রয়েছে।”
সমাজের, মানুষের মূল্যবোধ ক্ষয়িষ্ণু... সে সব ফিরিয়ে দিতে হবে তো!!
এই দায়বদ্ধতা থেকেই তথাগতর ‘রাস’ ছবি। সম্ভবত গরমে মুক্তি পাবে। আমি সেই সমাজে ফিরব যেখানে অনুভূতি, সহানুভূতির কদর ছিল। সকলে সমাজমাধ্যমে ডুবে থাকত না। এক অদ্ভুত শান্তি, স্নিগ্ধতা, বিরাজ করত। প্রজন্ম এগোবে না? “অবশ্যই এগোবে। কিন্তু সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে নয়। পরিবার, সম্পর্ককে তুচ্ছ না করে।” বিক্রম নাকি আপনার ‘ব্লু আইড’? এই নিয়ে তিনটি ছবি আপনাদের। “খুব ভাল বন্ধু। খুব ভাল বোঝাপড়া। জোর খাটাতে পারি। বিক্রমও পারে। আমার অনুভূতির সঙ্গে ওর অনুভূতি মিলে যায়। তাই ওর আমার এক সঙ্গে কাজের সংখ্যাও বাড়ছে।”
বলতে বলতেই পরের শটের প্রস্তুতি। ছাদে টিফিন খাওয়ার বিরতি। সকলের হাতে হাতে মস্ত রোল ঘুরছে। বিক্রম নায়ক, সে সব এড়িয়ে স্যুপেই খুশি। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। বিয়ে করছেন নাকি? লাজুক হেসে বললেন, “এই পোশাক মানেই বিয়ে! পাড়ার অনুষ্ঠানের দৃশ্যগ্রহণ হবে এর পর। তার জন্যই এই সাজ।” রাতে নাকি অন্তাক্ষরী খেলবেন আপনারা? তেমনই দৃশ্যগ্রহণ হবে, জানালেন তিনি। পরিচালক বলছিলেন, তিনি অল্পবয়সে এই ধরনের খেলায় অংশ নিতেন। পছন্দের নারীকে এই সুযোগে মনের কথা জানানোরও চেষ্টা করতেন। “সে তো আমিও করেছি”, বিক্রম উৎসাহ নিয়ে বললেন। এখন হয় আর এ সব? “শুটিং ফেলে গানের লড়াই?” বিস্মিত প্রশ্ন এ বার নায়কের কণ্ঠে।
রাত ঘন হচ্ছে। ছাদের আলসের ও পারে নীল ক্রোমা টাঙানো। নীলাকাশ বোঝাতে। মাথার উপরে চাঁদ আর রোহিনী নক্ষত্র খুব কাছাকাছি। ছাদে কাছাকাছি নায়ক-নায়িকা। আজ রাতে রাই মান করলে সোমনাথ মান ভাঙাবে? খিলখিল করে হেসে ফেলে দেবলীনার দাবি, “তথাদা সকলের আগে দৌড়ে এসে মান ভাঙাবে, হলফ করে বলছি।” একটু থেমে জানালেন, পিছনে পিছনে হয়তো বিক্রম...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy