Satyajit Ray Birth Centenary: A Homage to the Maestro dgtl
Satyajit ray
বিজ্ঞাপনের কাজ থেকে প্রচ্ছদ শিল্পী, নিঃস্ব হতে বসেছিলেন ‘পথের পাঁচালী’র জন্য
ঠাকুরদাদার শূন্য কাজের ঘর থেকে একটি কাঠের বাক্স পেয়েছিল ছেলেটি। সেখানে থাকত ঠাকুরদাদার রং, তুলি আর তেলরঙের কাজে ব্যবহারের জন্য লিনসিড অয়েলের শিশি। উত্তরাধিকারের সেই ধারা পরবর্তী কালে প্রজন্মজয়ী হয়েছিল বালকের হাত ধরেই। ১০০, গড়পার রোডের বাড়ি থেকে।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ০২ মে ২০২০ ০১:১৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৮
ঠাকুরদাদার শূন্য কাজের ঘর থেকে একটি কাঠের বাক্স পেয়েছিল ছেলেটি। সেখানে থাকত ঠাকুরদাদার রং, তুলি আর তেলরঙের কাজে ব্যবহারের জন্য লিনসিড অয়েলের শিশি। উত্তরাধিকারের সেই ধারা পরবর্তী কালে প্রজন্মজয়ী হয়েছিল বালকের হাত ধরেই। ১০০, গড়পার রোডের বাড়ি থেকে।
০২২৮
এই গড়পার রোডের বাড়িতেই তাঁর জন্ম, ১৯২১-এর ২ মে। মায়ের আদরের সেই ‘মানিক’-এর ভালনাম প্রথমে যা রাখা হয়েছিল, পছন্দ হয়নি নবজাতকের বাবার। পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ হয় ‘সত্যজিৎ’।
০৩২৮
তিনি যখন মাত্র আড়াই বছরের, থেমে গেলে ‘আবোলতাবোল’ স্রষ্টার কলম। বাবা হিসেবে নয়, ‘সুকুমার রায়’-কে তিনিও পেয়েছিলেন সাদা পৃষ্ঠায় কালো অক্ষরে, তাঁর কাজের মধ্যে দিয়েই। তাঁর শৈশব আবর্তিত হয়েছিল মা সুপ্রভা রায়কে ঘিরে।
০৪২৮
গড়পার-বকুলতলা-বিশপ লেফ্রয় রোড ছাড়িয়ে তিনি বিশ্বজনীন হয়েছেন। কিন্তু শৈশব তাঁর পিছু ছাড়েনি। গড়পার রোডের ছাপাখানার পুরনো ব্লক, ছোটবেলায় খেলার সঙ্গী ছেদিলালের ফানুস, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গরমের দুপুরে ঢোকা আলোয় উল্টোদিকের দেওয়ালে ম্যাজিক সিনেমা—শৈশবের খণ্ডচিত্রকে ক্যানভাসে ঢেলে তিনি আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন জীবনকে।
০৫২৮
প্রথমে গড়পার, তারপর বকুলবাগানে সোনামামার বাড়ি। মাঝে মাঝে ছুটিতে মায়ের সঙ্গে দার্জিলিঙের কাঞ্চনজঙ্ঘা অথবা তুতো ভাইবোনদের সঙ্গে হাজারিবাগে ছিন্নমস্তার মন্দিরে ঘুরতে যাওয়া। কাটছিল শৈশব। বড় পরিবারের সুগৃহিণী, পরিপাটি ইংরেজি আর বাংলা হস্তাক্ষরের মা-ই হয়তো পরে দেখা দিয়েছিলেন পর্দার সর্বজয়া রূপে।
০৬২৮
মায়ের মুখে আর্থার কোনান ডয়েলের ‘ব্রাজিলিয়ান ক্যাট’-এর বাংলা অনুবাদ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল একাকি শৈশবকে। পরে ‘ব্রাজিলের কালো বাঘ’-কে বাংলায় তিনিও ফিরিয়ে দেন পরবর্তী অসংখ্য প্রজন্মের শৈশবকে।
০৭২৮
স্কুলে প্রথম পা রেখেছিলেন ন’বছর বয়সে। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল-প্রেসিডেন্সি কলেজের চৌকাঠ পার হওয়ার পর মায়ের ইচ্ছেয় শান্তিনিকেতন। কিন্তু কলকাতার জীবন ছেড়ে বোলপুরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না সত্যজিতের। তবু শান্তিনিকেতনের দিনগুলিই তাঁর অন্তর্চক্ষুতে দৃষ্টিদান করেছিল। পরে নিজেই বলেছিলেন সত্যজিৎ।
০৮২৮
ছবি আঁকতে বরাবরই ভাল পারতেন। স্কুলের আঁকার শিক্ষকের এই প্রিয়পাত্র সেভাবে প্রথাগত আঁকা শেখেননি। কিন্তু শান্তিনিকেতনে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের হাতেই শিল্পীজীবনের নান্দীমুখ হয় তাঁর। ‘দ্য ইনার আই’ ছিল গুরুর প্রতি শিষ্যের কৃতজ্ঞতার স্মারক।
০৯২৮
১৯৪৩ সালে প্রথম চাকরি, নামী ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। ভিস্যুয়ালাইজার হিসেবে বেতন ছিল আশি টাকা। কিন্তু জনঅরণ্যে নিছক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গত ধরা চাকরি তাঁর ছিল না-পসন্দ।
১০২৮
তবুও সৃষ্টিশীলতা আর উপার্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চাকরি করেছিলেন বেশ কয়েক বছর। তাঁর জীবনে নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল সিগনেট প্রেসের চাকরি। সেখানে কাজ ছিল বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার।
১১২৮
সত্যজিতের হাতেই রূপ পায় জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ এবং ‘রূপসী বাংলা’-র চিত্রণ। এঁকেছিলেন জিম করবেটের ‘ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন’ এবং জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’-র বাংলা সংস্করণের প্রচ্ছদও। আর এঁকেছিলেন ‘চাঁদের পাহাড়’ ও ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বইয়ের প্রচ্ছদ।
১২২৮
‘আম আঁটির ভেঁপু’ ছিল কিশোর সংস্করণ। সত্যজিৎ স্কেচ করতে করতে ভাবলেন তিনি মূল উপন্যাসটি পড়বেন। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের নতুন যুগ। সত্যজিৎ পড়লেন। এবং ঠিক করলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মূল উপন্যাস নিয়ে ছবি বানাবেন।
১৩২৮
চিত্রনাট্য লিখলেন। পাওয়া গেল কুশীলবদের। কিন্তু মা লক্ষ্মী বড় নির্দয়। ছবির শুটিং কিছুটা হয়। আবার বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। নিজের সঞ্চিত অর্থ, স্ত্রী বিজয়ার অলঙ্কার সব বিপন্ন। তাতেও সমাধান হয় না অর্থসঙ্কটের। শেষে পাশে দাঁড়ালেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।
১৪২৮
শুধু নিশ্চিন্দিপুরের অভাবী দুই ভাইবোন নয়। কাশবনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে রেলগাড়ি দেখল গোটা বাংলা, তথা সারা ভারত, এবং সারা বিশ্ব। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পেল ‘পথের পাঁচালী’।
১৫২৮
তবে এই পাঁচালীপাঠের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল আরও আগে। জঁ রেনোয়া-র সহকারী হিসেবে কাজ করার সময় তাঁকে নিজের পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ। রেনায়োর উৎসাহের পাশাপাশি অনুঘটক ছিল ১৯৪৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বাইসিকল থিফ’।
১৬২৮
ভিক্টোরিয়ো দ্য সিকা-র এই ছবি দেখেই পরিচালক হওয়ার স্বপ্নের বীজ আরও ঊর্বর হয়েছিল। যদিও সেই বীজ বপন হয়েছিল গড়পারের শৈশবের দুপুরে দেওয়ালে ফুটে ওঠা আলো-আঁধারির বায়োস্কোপ আর খেলনা স্টিরিয়োস্কোপে।
১৭২৮
‘পথের পাঁচালী’-র পরে ‘অপরাজিত’, ‘পরশ পাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, ‘তিন কন্যা’—একের পর এক অলঙ্কারে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সাজিয়ে তোলেন সত্যজিৎ।
১৮২৮
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শতবর্ষ উপলক্ষে পরিচালনা করেছিলেন ‘তিন কন্যা’। সে বছরই মুক্তি পেয়েছিল তাঁর তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’। তাঁর একাকী শৈশব যেন মিলেমিশে গিয়েছিল জীবনস্মৃতির সেই শিশুর সঙ্গেও। আবার ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার’ সেই পাহাড়ি শিশুর গানে কি কোথাও মিশে ছিল মায়ের সঙ্গে ছোট্ট মানিকের প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আনন্দ?
১৯২৮
ছয়ের দশকে আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল সত্যজিতের জীবনে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায় তিনি এ বার হাল ধরলেন ‘সন্দেশ’-এর। যে পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সুকুমার রায়ের মৃ্ত্যুর কয়েক বছর পরেই। আবার নতুন করে তা প্রকাশিত হতে শুরু করল।
২০২৮
কিন্তু পত্রিকা শুরু করলে তো লিখতে হবে। লেখার লোকের অভাবে এবং কিছুটা ব্যয়সঙ্কোচ করতে এ বার সত্যজিৎ কলম ধরলেন শিশু ও কিশোর পাঠক-পাঠিকাদের জন্য। একে একে এল অদ্বিতীয় চরিত্ররা।
২১২৮
রজনী সেন রোডের প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর ফেলুদা। তার খুড়তুতো ভাই তোপসে। রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ লেখক জটায়ু, গিরিডির প্রোফেসর শঙ্কু। এল ভবঘুরে তারিণীখুড়ো। সেইসঙ্গে এল টিপু, সদানন্দ থেকে ফটিকচাঁদ, তার হারুণ দা-সহ আরও কত চরিত্র। শৈশবকে বুঁদ করে রাখতে।
২২২৮
ফেলুভক্তদের অনেকের মতে, ফেলুদা আসলে স্বয়ং সত্যজিৎই। দু’জনেই শৈশবে পিতৃহীন। কলমের সৃষ্টি পালিত হয়েছে তাঁর কাকার বাড়িতে। স্রষ্টা বড় হয়েছেন মামার বাড়িতে। তবে তাঁর জীবনেও ছোটকাকার গভীর প্রভাব ছিল।
২৩২৮
লেখালেখি শুরু হওয়ার পরে সত্যজিতের ক্যামেরা আর কলম মিশে যেতে থাকে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর শুটিংয়ে রাজস্থান গিয়ে জন্ম নেয় ‘সোনার কেল্লা’র প্লট। ‘অপরাজিত’-র কাশী-ই আবার ক্যাপ্টেন স্পার্কের কল্পনাকে অতলান্তিকে ভেসে যাওয়ার ঠিকানা। ছোটবেলায় হাজারিবাগের ছুটির দিনগুলোই ফেলুদার ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’।
২৪২৮
ফেলুদার মতো সত্যজিৎও ভালবাসতেন কলকাতাকে। তাঁর ‘মহানগর’-এর মূল চরিত্র কল্লোল্লিনী কলকাতাই। তবে শুধু চারুলতার সম্পর্কের টানাপড়েনে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি দর্শককে নিয়ে গিয়েছেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ দেখাতে।
২৫২৮
রবীন্দ্রনাথ-তারাশঙ্কর-বিভূতিভষণের পাশাপাশি তাঁর ছবির উপজীব্য হয়েছে পরশুরাম, প্রেমেন্দ্র মিত্রর কাহিনি। সেলুলয়েডবন্দি হয়েছে সমকালীন সাহিত্যের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলম। ছবির পাশাপাশি সমৃদ্ধ তাঁর তথ্যচিত্রের সম্ভার। ‘সুকুমার রায়’, ‘বালা’, ‘সিকিম’—কালজয়ী পরিচয় প্রত্যেকের পাশেই।
২৬২৮
হাসপাতালের রোগশয্যায় অস্কার পুরস্কার হাতে এই দীর্ঘদেহীর জন্যই হাজারো দুর্ধর্ষ দুশমনের ভিড়েও আমাদের সরবতে কল্পনার বিষ মেশাতে পারে না মগনলাল মেঘরাজ। সে সরবত সবুজ হরিপদবাবুর চালানো অ্যাম্বাসাডরের মতোই। লেজিয়ঁ দ্য নর সম্মানে সম্মানিত এই বাঙালির জন্যই হীরকরাজাকে খানখান করার স্বপ্ন দেখতে পারে উদয়ন পণ্ডিতরা। অরিন্দমরা টেবিল চাপড়ে বলতে পারে, " আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ!"
২৭২৮
আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে অসুস্থ বাবার সঙ্গে গিরিডিতে চেঞ্জে গিয়েছিল এক বালক। বাড়ির চাকরের সঙ্গে উশ্রীর ধারে খেলছিল সেই শিশু। খেলনা কাঠের খোন্তা দিয়ে বালি খুঁড়তেই বেরিয়ে এসেছিল জল। বৃদ্ধ বয়সেও সেদিনের সেই বালকের মনে ছিল, এক দেহাতি তরুণী সেই জলে হাত ধুয়ে গিয়েছিলেন।
২৮২৮
আমরাও সেই দেহাতি তরুণীর মতোই। কিংবদন্তির রেখে যাওয়া মহাসাগরের শাখা-প্রশাখায় বার বার ডুব দিয়েও তাঁর সৃষ্টির নতুনত্ব আমাদের কাছে আগন্তুক হয়েই রয়ে যায়। শুধু মাঝে শতবর্ষের সময় বোধহয় চলে যায় বিরিঞ্চিবাবার দেখানো হিসেবে।
ঋণস্বীকার: ‘যখন ছোট ছিলাম’:সত্যজিৎ রায়, ‘আমাদের কথা’: বিজয়া রায়