Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
— ১৯৩১-২০২২ —
suchitra sen

Sandhya Mukherjee: আকাশের অস্তরাগে

সুচিত্রা সেন ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি যেন রূপকথাতুল্য। সেই ছোঁয়া পেয়েছেন মুনমুন সেনও

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:৪৯
Share: Save:

গীতশ্রী তখন রোগশয্যায়। সুচিত্রা-কন্যা মুনমুন সেনের মনে আশঙ্কার মেঘ। বলছিলেন, “মায়ের গানের সঙ্গে জুড়ে ওঁর কণ্ঠ। ওঁর স্নেহের আঁচ বরাবর পেয়েছি। ওঁকে অন্য চোখে দেখেছি। যোগাযোগ কমে এলেও মনের এই বাঁধনটা থেকেই গিয়েছে...”

বাঙালির সঙ্গেও তাঁর এমনই অব্যক্ত ভালবাসার বন্ধন। ভারতে, কণ্ঠের দেবত্বের নিরিখে একমাত্র গীতশ্রীই হয়তো লতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতেন। ‘বোল পপিহে’ গানটা শুনুন। অবিশ্বাস্য ডুয়েটে লতা ও সন্ধ্যা, মধুবালা ও শ্যামার লিপে। তখন শচীন দেব বর্মণের আগ্রহে সন্ধ্যা বম্বেতে কাজ করছেন। মীনাকুমারীর লিপেও ভারী খুলছিল সন্ধ্যার স্বরতন্ত্র। লতা-গীতা-সন্ধ্যা ত্রয়ীকে নিয়ে শচীনকর্তার কত স্বপ্ন। তাঁকে খানিক কষ্ট দিয়ে দু’বছরেই বাংলায় ফিরে এসেছিলেন গীতশ্রী। শুধুই ইতিহাস নয়, রূপকথা গড়তে।

এই রাজ্য তখন বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগের ক্ষত বুকে ধুঁকছে। সাদা-কালো ছবিগুলি কল্পরাজ্য গড়ে তুলে এই যন্ত্রণায় মায়ার পালক বুলিয়ে দিল। শুরু হল বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ। মহানায়ক হিসাবে উত্তমকুমারের ভাবমূর্তি গড়তে সহায় হল উদাত্ত হেমন্ত কণ্ঠ। আর সুচিত্রার আবেদন অলৌকিক পর্যায়ে পৌঁছে দিল সন্ধ্যার কারুকার্যশোভিত কণ্ঠ ও জায়গা চিনে তাঁর অলঙ্কার ভরে দেওয়ার ক্ষমতা।

আরতি মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাবের আগে গীতশ্রী প্রায় একাই নায়িকার স্বর। সুপ্রিয়া, সাবিত্রী, অঞ্জনা, সন্ধ্যা, তনুজা, অপর্ণা, রাখি, দেবশ্রীকেও কণ্ঠ দিয়েছেন। তবু, সন্ধ্যাকণ্ঠ যেন কী ভাবে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে। ‘এই পথ যদি না’-র ‘লাল্লালালাল্লালা’ অংশটুকু তো বহু লোকে সুচিত্রার গাওয়া বলেই জানে। কোন অনুভবে এমন একাত্ম দু’জন?

সুচিত্রার কণ্ঠে সন্ধ্যার প্রথম গান ‘অগ্নিপরীক্ষা’-য়। তার পর ছয় দশকের হৃদয়ের সম্পর্ক। গত ডিসেম্বরে, আনন্দবাজারকে জীবনের শেষ সাঙ্গীতিক সাক্ষাৎকারে গীতশ্রী বলেছিলেন, “সুচিত্রা, আমার গান চোখের ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে এমন ফুটিয়ে তুলত— অপূর্ব সমন্বয়! ‘কমললতা’-র ‘নয়ন মোহন শ্যাম’ গানটি রেকর্ডিংয়ের আগে সুচিত্রা বলে গেল কী এক্সপ্রেশন দেবে। বাড়িতে বার বার গানটা শুনত। নিবিড় ভাবে অনুভব করে লিপ দিত। ওর ডায়লগের পর যখন আমার গানটা আসত, মনে হত দু’টি কণ্ঠস্বর মিশে গিয়েছে। গলার মিল, এক্সপ্রেশনের মিল— কমপ্লিট আইডেন্টিফিকেশন। অভিনয় আর গান একাকার। সেইটাই মানুষের মনে রেখাপাত করে গিয়েছে।”

আসলে, লঘু গানে তাঁর এই আকাশছোঁয়ার নেপথ্যে রয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অসীম শক্তি। তাঁর গুরুমশায় বাবা বড়ে গোলাম আলি খান বলেছিলেন “বেটা তিন ভাগ শুননা, এক ভাগ গানা”। আজীবন অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন। ধ্রুপদী গান আর লঘুসঙ্গীত একসঙ্গে গাননি, যখন যেটায় থেকেছেন, একশো ভাগ উজাড় করেছেন। হারমোনিয়ামে বসে স্বর্গ নামিয়েছেন পৃথিবীতে, সভয় পিছিয়ে এসেছেন অন্য শিল্পীরা। এর পর আর গাওয়া যায় না। তিনি সরল হেসে বলেছেন, ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’? ও তো রাধাকান্ত নন্দীর তবলার কারিগরি!

মাম্পসে কম বয়সেই সন্ধ্যার এক কান নষ্ট। তবুও সঙ্গীতেন্দ্রিয়ের ক্ষয় নেই! জীবন্ত কিংবদন্তি হয়েছেন, তবুও প্রচারের আলো বা গ্ল্যামারের ছটা তাঁকে সঙ্গীতসাধনা থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি।

জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন, আধ্যাত্মিকতার প্রতি অমোঘ টান, সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে আলাদা পৃথিবী তৈরি করে থাকা— এই সব বৈশিষ্ট্যে মিসেস সেনকেই কেন মনে পড়ে? আপাতদৃষ্টিতে সন্ধ্যা-সুচিত্রাকে ভিন্্মেরুর মনে হলেও যেন অন্তর্ব্যক্তিত্বের কোনও বিন্দুতে তাঁদের মুখোমুখি দেখা হয়ে যায়। অন্তরের জগতেরই তো প্রতিফলন শিল্পে— এক জনের অভিনয়ে, অন্য জনের গানে। সেই সংযোগের ফল হয় মহাজাগতিক। গানের ইন্দ্রধনু ওঠে সন্ধ্যার স্বরে, তার আবেশ ছড়িয়ে যায় সুচিত্রার মুক্তোঝরা হাসিতে। অন্য ব্রহ্মাণ্ডের ঝিকিমিকি তারা হয়ে দেখা দেন সুচিত্রা, সেই আকাশেই ঘুমঘুম চাঁদ হয়ে সুরের রেণুতে মাধবী রাত এঁকে যান সন্ধ্যা। সন্ধ্যার সরল জীবনের অন্তরালে যে কতখানি অনুভবের ঘূর্ণি, তার প্রমাণ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’। গীতিকার শ্যামল গুপ্তের এই গানের অনুপ্রেরণা স্ত্রী সন্ধ্যাই! তাঁর কণ্ঠে রোম্যান্সের বিস্ফোরণ তো হবেই!

সন্ধ্যা-সুচিত্রার মধ্যে বাস্তবে শ্রদ্ধা-মমতার সম্পর্কের রং ছিটকে পড়েছে সাদা কালো সেই গানের দিনে, তাই তো ‘মমতা’-র মিনিট তিনেকের ঠুমরিতেও এমন অবিচ্ছেদ্য হয়ে অনন্তকাল বেঁচে সুচিত্রা-সন্ধ্যা। গীতশ্রী আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, স্টুডিয়োতে তাঁকে শুটিং দেখতে ডাকতেন সুচিত্রা বা শুনতে আসতেন তাঁর রেকর্ডিং। লক্ষ্মীপুজোয় তাঁর বাড়ি এসেছেন সুচিত্রা, আবার মুনমুনের বিয়ের দিন সকালে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছেন সন্ধ্যা— কত আদর-ভালবাসা দুই সখীতে! সন্ধ্যা মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়েছেন, সুচিত্রা তখন অন্তরালবাসিনী। তবু বান্ধবীকে গাড়িতে তুলে দিতে বাইরে রাস্তায় চলে এসেছেন! সন্ধ্যার স্মৃতিতে আছে, মুনমুন চিরকুট লিখছেন, ‘যবে থেকে মাকে সুচিত্রা সেন বলে জেনেছি, সন্ধ্যামাসি তবে থেকে তোমাকেও চিনি।’ কী সহজ-সরল স্নেহটান দু’জনের, দুই পরিবারে। বোধহয় এই নির্মল সারল্যের সম্পদেই এত কঠিন কাজ অবলীলায় করে গেলেন মহানায়িকা ও মহাগায়িকা।

মুনমুন সেনের প্রথম বাংলা ছবি ‘রাজবধূ’তেও সন্ধ্যার ছোঁয়া লেগে ‘আজ রং খেলাতো’-য়। মুনমুন বললেন, “কিছু দিন আগেও এক অনুষ্ঠানে তাঁর অটোগ্রাফ চাইলাম।” তিনি অবাক! বিহ্বল মুনমুনের কথায়, “মাস খানেক মতো আগে ওঁকে ফোন করলাম। মনটা খুব খারাপ ছিল। ওঁকে বললাম, ‘মায়ের গানগুলো শুনছিলাম, আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল।’ মায়ের মতো উনিও তো খুব চুপচাপ থাকতেন, যেন পৃথিবীটা থেকেই আলাদা। উনিই আমাকে বললেন, ‘তুমি গান শোনাও না একটু?’ বললাম, ‘আমি তো গান গাই না!’ তখন কোনও সিনেমার গান নয়, উনি চার-ছ’লাইন রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনালেন। কী আশ্চর্য! নব্বই বছরের মানুষটা একটুও আটকালেন না কোত্থাও, গলাটা এতটুকুও ভাঙল না! খাঁটি সঙ্গীতের স্পর্শ। বাড়িতে তো গান করতেন নিশ্চয়ই, কিন্তু বাইরের লোকের মধ্যে কি আমিই তাঁর গান শেষ শুনলাম?”

সমাপ্তি-সঙ্গীতটি কি তবে মহানায়িকা-কন্যার জন্যই রাখা ছিল! এ কি শুধুই ভালবাসা না কি সেই সুচিত্রা-সন্ধ্যার দৈব মেলবন্ধনেরই শেষ সিলমোহর? যার ফলে পৃথিবীটা স্বপ্নেরই দেশ হয়?

অন্য বিষয়গুলি:

suchitra sen Sandhya Mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy