ছবির দৃশ্য
তপন সিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’য় যখন কাজ করার সুযোগ পাই, তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। ততদিনে ‘ছুটি’, ‘পরিণীতা’, ‘কমললতা’, ‘আপনজন’-এর মতো বেশ কয়েকটা ছবি করে ফেলেছি। তবে দিলীপ কুমার যে কত বড় নাম, তার আন্দাজ ওই বয়সেও ছিল। সেটে গিয়ে আলাপ হওয়ার পরে দেখলাম, তারকাসুলভ কোনও ব্যাপারই নেই ওঁর মধ্যে। হইহই করা, দারুণ মজার এক মানুষ, যিনি অন্যদের বুঝতেই দেন না, তিনি আসলে কত বড় স্টার! আমাকে উনি ডাকতেন ‘বেবি’ বলে, কারণ সেটে আমিই ছিলাম সবচেয়ে ছোট।
দিলীপ কুমারের প্রথম বাংলা ছবি ছিল ‘পাড়ি’। ‘সাগিনা...’-র সময়ে কলকাতায় এসে গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছিলেন উনি আর সায়রা বানু। কলকাতায় শুটিংয়ের পরে আমরা আউটডোরে গিয়েছিলাম তিনধারিয়া, গয়াবাড়ি বলে একটা জায়গায়, কার্শিয়ংয়ের কাছে। সে সময়ে সেটে সায়রা বানুর একটা তারকাসুলভ উপস্থিতি টের পেলেও দিলীপ কুমারের ক্ষেত্রে তা কখনওই মনে হত না।
গানের কোনও দৃশ্যে দিলীপসাবের অভিনয় ছিল দর্শনীয় বিষয়! যদি শটটা একটু দীর্ঘ হত, ওঁর লিপ দেওয়া গানের লাইনের আর মাথামুণ্ডু থাকত না! একটু পর থেকে শুধু গানের ছন্দ অনুযায়ী নড়াচড়া করে যেতেন, আর মুখে যা আসত তাই গাইতেন! ক্যামেরাকে এত ভাল চিট করতে পারতেন বলেই সেটা সম্ভব হত। জানতেন, কোন দিকে কতটা মুখ ঘোরালে ক্যামেরায় ধরা পড়বে না!
পরীক্ষা ছিল বলে প্যাকআপের পরে আমি পড়াশোনা করতাম। মাঝে মাঝেই ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে শোনা যেত দিলীপ কুমারের হাঁক, ‘বেবি, আর কত পড়বিস?’ শব্দের শেষে একটা করে ‘স’ লাগিয়ে দিয়ে বাংলা বলতেন উনি। একবার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে দেখি আমার মায়ের পাশে বসে কী একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন উনি। কাছে গিয়ে শুনি মাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘‘আন্টি বোলিয়ে, মাছের ঝোল আর ঝালে কী তফাত?’’ সেটে বাঙালি খাবার খেয়ে এই প্রশ্ন জেগেছিল ওঁর মনে।
‘সাগিনা মাহাতো’য় আমি ছিলাম লছমীর চরিত্রে। একটি দৃশ্যে জঙ্গলে শুয়ে থাকতে হয়েছিল আমায়, সেখানে ছিল লক্ষ লক্ষ শুঁয়োপোকা! শটের সময়ে দিলীপ কুমার ছুটে এসে আমাকে কোলে তুলে নিতেই ওঁর পায়েও অসংখ্য শুঁয়ো আটকে গিয়েছে! ঠান্ডায়, অত রাতে খুঁজে আনা হল ডুমুরের পাতা। শুঁয়ো ছাড়াতে ছাড়াতে দিলীপসাব বলছিলেন, ‘‘তপনদা, ইয়াহাঁ ইতনা কাঁটা ভি হ্যায়?’’ তপন সিংহ তখন আবার তাঁকে শুঁয়ো আর কাঁটার তফাত বোঝালেন!
বাংলোর লাইব্রেরিতে আমি প্রায়ই যেতাম। দিলীপ কুমারও যেতেন মাঝে মাঝে। একদিন উনি আমাকে বইয়ের একটা তাক দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তুই যদি একদিন এই একশোটা বইয়ের মধ্যে ১৫টাও পড়ে ফেলতে পারিস, ইউ উইল বি আ রিচ পার্সন।’’ কথাটা দারুণ লেগেছিল।
‘সাগিনা মাহাতো’য় দিলীপ কুমারের বিখ্যাত সংলাপ ‘এই তো জীবন কালীদা’ নিয়ে পরবর্তীকালে বেশ বিব্রত হতে হয়েছিল আমায়। আমার শ্বশুরমশাইয়ের নাম কালীপদ ভট্টাচার্য। বিয়ের পরে পাড়ার ছেলেরা বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে মজা করে ‘এই তো জীবন কালীদা’ বলে হেঁকে চলে যেত। সেই থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত এই সংলাপ আমার জীবনে প্রায় উহ্যই রয়ে গিয়েছে!
অনুলিখন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy