Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Celebrity Interview

‘মা’ ঋতুপর্ণা, ‘কোচ’ চিরঞ্জিৎ, সামনে দাবার বোর্ড! তাঁদের সংলাপ শুনল আনন্দবাজার অনলাইন

‘দাবাড়ু’ সূর্যশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের লড়াকু জীবন নিয়ে ছবি। তার কথা বলতে বসে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীর আড্ডায় উঠে এল বাংলা ছবির সঙ্কট থেকে মধ্যবিত্ত জীব‌নের গল্প।

Rituparna Sengupta and Chiranjit Chattopadhyay giving interview on the film “DABARU” based on famous chess player Suryashekhar Ganguly

‘দাবাড়ু’ ছবি নিয়ে আড্ডায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৪ ১২:৫৩
Share: Save:

গ্রীষ্মের দাবদাহে দাবার বোর্ডের সামনে বসে চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। চোখে ভেসে আসছে এক মায়াময় দৃশ্য। রূপটান ছাড়াই স্বচ্ছ পেলব ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের মুখ। জলের ধার বেয়ে গাছের পাতার ফাঁকে ধরা পড়ল সেই মুখ। এক বার চোখ তুলে তাকালেন ঋতু। তার পরে চলে গেলেন! ব্যস...

আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ওই চাহনির গল্পেই প্রথমে মশগুল চিরঞ্জিৎ। পাশে সলাজ ঋতুপর্ণা।

প্রশ্ন: আপনি তো দেখছি, ঋতুপর্ণার ওই চাহনিতে আজও আটকে আছেন?

চিরঞ্জিৎ: আমার ছবি ‘বসতির মেয়ে রাধা’ ছবির দৃশ্য আজও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখি। রূপটান ছাড়া ঋতুকে আরও উজ্জ্বল লাগে আমার। ওই চাহনিতেই তো আমি ফিদা!

ঋতুপর্ণা: আমার আর চিরঞ্জিৎদার জুটি কিন্তু বক্স অফিসে খুব সাফল্য পেয়েছিল। ‘নাগিন কন্যা’, ‘নিষ্পাপ আসামী’, ‘বসতির মেয়ে রাধা’, ‘সংসার সংগ্রাম’।

প্রশ্ন: এখন এই জুটি আর তেমন দেখা যায় না কেন?

চিরঞ্জিৎ: আমি খুব বেছে বেছে কাজ করি। আর এ বার তো দেখবেন, ‘দাবাড়ু’তে...

প্রশ্ন: দু'জনের দীর্ঘ দিনের আলাপ। কতটা বদল দেখলেন একে অপরের মধ্যে?

চিরঞ্জিৎ: সে দিনই বুম্বার (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে ঋতুর একটা গানের দৃশ্য দেখছিলাম। চমকে গেলাম! কী সরু কোমর ছিল ওর!

ঋতুপর্ণা: আমি ওকে দীপক চক্রবর্তী থেকে চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী হওয়ার পুরো সময়টা দেখেছি। এক দিকে ‘অ্যাকশন হিরো’...

চিরঞ্জিৎ: ‘অ্যাকশন হিরো’র ভাবনাটা কিন্তু বহু দিন আগে বাংলা ছবিতে আমিই নিয়ে আসি।

ঋতুপর্ণা: হ্যাঁ। ওর ‘প্রতিদান’ ছবিতে দেখেছি আমরা। তবে শুধু অভিনয় নয়। পরিচালনা। প্রযোজনা। গায়ক। রাজনীতিবিদ। ছবি আঁকা। গবেষণা। সব দিক দিয়ে দীপকদা নিজের বৃত্ত বাড়িয়ে চলেছেন। অন্য দিকে ‘সুপারস্টার’ তো বটেই।

প্রশ্ন: এখন যদি বলি, বাংলা ছবির বৃত্ত ছোট হয়ে আসছে, ওই ‘অ্যাকশন’ নির্ভর ছবি না করার জন্য...

চিরঞ্জিৎ: সে তো কুড়ি বছর আগে থেকে আমি বলেই আসছি। সবাই এই কারণে আমায় ছি-ছি করত। তার মানে তো এই নয় যে, আমি অন্য ধারার ছবির বিরোধী। তবে আমি তো মৃণাল-ঋত্বিক-সত্যজিৎকে দেখেছি। তাঁরাও ছবি করছেন, আবার অন্য দিকে উত্তম-সুচিত্রার ছবি হচ্ছে। দু’ধারাই সমান্তরাল ভাবে চলেছে। কিন্তু তার পরবর্তী কালে দেখলাম, একটা ভুল মতবাদ তৈরি হল। বলা হতে লাগল, স্বপন সাহা, অঞ্জন চৌধুরী বাজে বাংলা ছবি তৈরি করে। সেই সময় নতুন যারা বাংলা ছবি করতে এল, তারা ধরে নিল বাংলা ছবি স্বপন-অঞ্জনের হাতেই শেষ! এরা ভাবল, মানিকদার মতো পুরস্কার পাওয়ার জন্য ছবি করতে হবে। এরা বুঝল না, মুম্বই বা কলকাতা যা-ই হোক, ‘গদর২’-এর মতো ছবি করেই ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বাঁচবে। একমাত্র দক্ষিণী ‘ইন্ডাস্ট্রি’ কিন্তু একই পথেই হেঁটে চলল। ওখানে ভোরবেলা রজনীকান্তের ছবির জন্য পাঁচশো লোক আজও দাঁড়িয়ে থাকে।

ঋতুপর্ণা: দক্ষিণী ছবির মানুষেরা ওদের ইন্ডাস্ট্রিকে খুব শ্রদ্ধা করে।

চিরঞ্জিৎ: কিন্তু আমরা আমাদের দর্শককে অশ্রদ্ধা করতে শুরু করলাম। যেন দর্শক না নিলে আমার কিছু এসে যায় না! কিন্তু এই নতুন পরিচালকদের আমি বোঝাতাম, চ্যানেলে ‘পথের পাঁচালী’ বছরে এক বার দেখালে, আমাদের ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে’ দেখানো হয়েছে মাসে এক বার। তাই বলে কি ‘পথের পাঁচালী’কে কি ছোট করছি? কোনও দিনও না। কিন্তু চ্যানেল ওই ছবি দেখিয়ে বিজ্ঞাপন পাচ্ছে বার বার। সেই বিজ্ঞাপন নিয়ে আসা ছবি কোথায়?

Rituparna Sengupta and Chiranjit Chattopadhyay giving interview on the film “DABARU” based on famous chess player Suryashekhar Ganguly

চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।

প্রশ্ন: আপনার প্রশ্ন ধরেই বলি তবে! ‘বেলাশেষে’, ‘বেলাশুরু’ বা ‘হামি’, ‘প্রজাপতি’ এই ছবিগুলিকে তা হলে কী বলবেন?

চিরঞ্জিৎ: ‘প্রজাপতি’ ভাল ছবি। তবে যত হলে থাকা উচিত ছিল, তা হয়নি।

প্রশ্ন: কিন্তু সিঙ্গল স্ক্রিন তো কমে আসছে...

চিরঞ্জিৎ: নেই তো। কোথায় ছবি দেখবে লোকে? এই যে দেব বা জিৎ এরা সক্কলে সিঙ্গল স্ক্রিন থেকে তারকা হয়েছে। এখন চাইলে ওরা আর তারকা হতে পারত না। প্রেক্ষাগৃহ নেই তো, কে দেখবে? জিৎ তো ওই ধারার ছবি করে। খুব মুশকিল ওর জন্য! বাংলা ছবির বাজেট কমছে, আর দক্ষিণী ছবিতে হাজার কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে। আমি সেই কবে ৯ কোটি টাকা দিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে কেউটে’ করেছিলাম। সেই বাজেটে এখন আর বাংলা ছবিই হয় না।

প্রশ্ন: উইন্ডোজ়ের কথা কী বলবেন?

চিরঞ্জিৎ: উইন্ডোজ়ের নন্দিতাদি (রায়) আর শিবুর (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে আমার বহু দিনের পরিচয়। সেই ‘মুশকিল আসান’-এর সময় থেকে, ওদের আমি বলতাম এই ধারার ছবির কথা। নিজেদের ফর্মুলা বানিয়েছে ওরা, যা খুব সাফল্য পেয়েছে।

প্রশ্ন: ‘দাবাড়ু’ কী বলে?

ঋতুপর্ণা: অনেক বিষয় নিয়ে গল্প বলে। শুধু ‘দাবাড়ু’র গল্প নয়। নির্ভরতার গল্প বলে, যা মানুষের মধ্যে আজকাল আর দেখা যায় না।

প্রশ্ন: অনেক দিন পরে একেবারে ঘরোয়া লুকে ঋতুপর্ণা সাদামাঠা মা...

ঋতুপর্ণা: একেবারেই। এই ছবিতে আমি এমন একজন মা, যে নিজের জীবনকেও দাবার কোনও এক ঘুঁটির সঙ্গে জুড়ে লড়াই করছি। সন্তান তার সম্বল। এই মা নিজে দাবা খেলতে পারে। পরিচালক হিসাবে পথিকৃৎ (বসু) চমৎকার গল্প বলেছে। দাবাড়ুর দাদুর চরিত্রে এখানে টিটোদা (দীপঙ্কর দে)। তাঁর সঙ্গেও দাবাড়ুর মায়ের সম্পর্কটা গুরুত্বপূর্ণ।

চিরঞ্জিৎ: এই ছবিতে একটা সংলাপ আছে, যেখানে দীপঙ্কর দে নাতির দাবার কথা বলতে গিয়ে বলছেন, ‘‘ও কিছু কিছু নিজের চাল দেয়, যা আমিও বুঝি না।” এই সংলাপটি খুব নজর করার মতো।

প্রশ্ন: খবরে প্রায়ই দেখা যায় ভাল খেলোয়াড় টাকার অভাবে বিদেশে যেতে পারছে না...

চিরঞ্জিৎ: ‘দাবাড়ু’তে এই গল্প আছে। আর এই ঐতিহ্য আমাদের দেশে চলতেই থাকবে। এর পরিবর্তন নেই। তবে এই ছবিতে এই পরিস্থিতির দাপট কাটিয়ে উঠে এগিয়ে যাওয়ার গল্পও আছে।

ঋতুপর্ণা: এখন বাচ্চারা একা বাঁচে। ফোন নিয়ে সবাই গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ‘দাবাড়ু’ খোলা হাওয়ায় অনেক ধরনের সম্পর্কের কথা বলে। এই ছবি মেন্টাল এক্সারসাইজ়ের কথা বলে। এই পদ্ধতি আজকের দিনে কতটা প্রয়োজন সেটা ধরিয়ে দেয়।

Rituparna Sengupta and Chiranjit Chattopadhyay giving interview on the film “DABARU” based on famous chess player Suryashekhar Ganguly

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। —নিজস্ব চিত্র।

প্রশ্ন: আপনি তো সূর্যশেখরের মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন?

ঋতুপর্ণা: হ্যাঁ। দীপকদার (দাবাড়ুর কোচ) সঙ্গেও যে নির্ভরতার জায়গা দাবাড়ু ছেলেকে ঘিরে, সেটা এখানে অন্য ভাবে বলা হয়েছে। মা আর ছেলের অভিমানের সম্পর্কও ধরা আছে ছবিতে।

প্রশ্ন: এই অভিমান কি বাস্তবে ঋতুপর্ণা আর তাঁর ছেলের অভিমান?

ঋতুপর্ণা: কিছুটা তো বটেই। ছেলে এখন আমেরিকায়। টেক্সট করে ওকে বলি, “আমরাও কিন্তু আছি। একটু খোঁজ তো নেওয়া যায়। আমরা না থাকলে তোমার আর কেউ খোঁজ নেবে না!”

প্রশ্ন: বাচ্চাগুলো কেমন করেছে?

ঋতুপর্ণা: দু’জনেই অসম্ভব বুদ্ধি ধরে। সেটা ছবিতে ফুটে উঠেছে।

প্রশ্ন: চেন্নাইয়ের রাস্তায় দৌড়তে কেমন লাগল?

ঋতুপর্ণা: এক দিনের শুট ছিল। এখানে প্রযোজনা সংস্থার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। যে এক দিনের কাজ হলেও চেন্নাইয়ে গিয়ে ওরা শুটের ব্যবস্থা করেছিলেন। অনেক প্রযোজনা সংস্থা এটা এখন আর করতে চায় না।

চিরঞ্জিৎ: একটা কথা বলে রাখি। দেখুন, এত যে কথা বলছি, ভাল ভাল কথা, ধরে নেবেন না যেন, ছবির বিজ্ঞাপন করতে এ সব বলছি! এই বয়সে যা মনে আসে, সেটাই বলি।

প্রশ্ন: এই প্রযোজনা সংস্থা মনে করে, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত তাঁদের ছবির সঙ্গে যুক্ত হলে সেই ছবি লাভের মুখ দেখে...

ঋতুপর্ণা: আমি তো সেই ‘ইচ্ছে’ থেকেই এই হাউসের ছবির সঙ্গে যুক্ত। তার পরে তো উইন্ডোজ়ের অনেক জানলা খুলে গিয়েছে।

প্রশ্ন: শিবুর সঙ্গে ঝগড়া হল?

ঋতুপর্ণা: না। ও তো এ বারে পরিচালক ছিল না! তাই শুটিংয়েও আসেনি। ঝগড়াটা হবে কোত্থেকে!

প্রশ্ন: ‘দাবাড়ু’র শুটিংয়ে তো ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটেছিল?

ঋতুপর্ণা: ভয়ঙ্কর! একটা বড় বিপদ হয়ে যেতে পারত। একটি দৃশ্যে আমি কড়াতে খিচুড়ি রান্না করছি। যে হেতু ‘রিটেক’ নিতে হয়েছিল, ফলে শেষ টেক দিচ্ছিলাম যখন, খিচুড়িটা খুব গরম হয়ে গিয়েছিল। দৃশ্যটি খানিকটা এই রকম, মা খিচুড়ি রান্না করছে। কড়ার খিচুড়ির মধ্যে বল এসে পড়বে। খিচুড়ি কড়া থেকে ছিটকে গিয়ে পড়বে উল্টো দিকে। কিন্তু শুটিংয়ের সময় খিচুড়ি উল্টো দিকে না চলকে আমার মুখের দিকে ছিটকে যায়। বিশ্বাস করুন, ভাগ্যিস আমি হাত দিয়ে গাল আড়াল করেছিলাম! না হলে গাল পুড়ে যেত আমার। এখনও গলার নীচে পুড়ে যাওয়ার দাগ রয়েছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy